Thursday, 22 October 2020

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা : মূল্যবোধ-এর স্বরূপ : রোকেয়া কবীর

সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বিরোধী যে তুমুল আন্দোলন চলছে তাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সকল আলোচনা ও কথাবার্তায় কয়েকটি বিষয় ঘুরেফিরে সর্বদাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’, ‘পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়’ অন্যতম প্রধান দুই বিষয়। এ ছাড়াও ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধকে ‘মা-বোনের সম্ভ্রম বা ইজ্জতহানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আরো আছে ধর্ষণকে ‘পাশবিক নির্যাতন’ হিসেবে চিহ্নিত করা। এ প্রপঞ্চগুলো নিয়ে মোটা দাগে কিছু ভাবনা বা কারণ খোঁজার চেষ্টায় এই সংক্ষিপ্ত লেখা।

প্রথমত, আমার জানামতে পশুপাখির যৌন মিলনে ধর্ষণ-এর মতো কোনো চর্চা নেই। প্রাণিজগৎ ও তার প্রজনন নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন বা কাজ করেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় এ মতের সমর্থনও পেয়েছি। তাই ‘পাশবিক’ নির্যাতন কথাটার যর্থাথতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং যুক্তি অনুযায়ী তা ফেলে দেওয়ার নয়। 

‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’, ‘মেয়েকে পাত্রস্ত’ করা কিংবা ছেলের বিয়ে করতে যাওয়ার সময় মাকে প্রণাম করে বলা যে, ‘মা, আমি তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি’— এগুলোর সবই নারী বা কন্যাসন্তান সম্পর্কে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে তুলে ধরে। যে সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক— সে সমাজের পরিবারপ্রধান পুরুষ পিতাটিরই যদি কন্যাসন্তানকে ‘দায়’ হিসেবে দেখতে হয় এবং তার জন্য সমাজে ‘দায়গ্রস্ত’ হয়ে থাকতে হয়, সে সমাজের এই অবস্থাই সাক্ষ্য দেয় একজন কন্যাকে, নারীকে কী হিসেবে দেখা হয়। আর পরিবারের ভিতরেই তারা বাবা, ভাই, চাচা, মামা, শ^শুরসহ অন্য নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হন। পাশাপাশি তাদের রাস্তাঘাট, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গায়ই যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সুতরাং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ-এর অবক্ষয় কথাটির যৌক্তিকতা কতটুকু, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রশ্নটির সুরাহা হওয়া দরকার। কারণ এসব আপ্তবাক্যের আড়ালে মূল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। কন্যাসন্তানকে দায় হিসেবে দেখার মূল কারণ যে উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকা, এ সত্যটিকে কখনোই সামনে আনা হয় না। 

ছোটবেলায় চাচার সঙ্গে বিকেলবেলায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া আমার একটি আনন্দময় শখ ছিল। একদিন চাচা একটু বেশি পরিপাটি হয়ে বের হওয়ার সময় আমি সঙ্গী হতে চাইলাম। কিন্তু উত্তর পেলাম, তিনি তার এক ‘দোস্ত’-এর ছেলের জন্য পাত্রী/কন্যা পছন্দ করতে যাচ্ছেন এবং সেখানে বয়স্ক অভিভাবকরাই শুধু যাবেন। আমার খুব মন খারাপ হলো। তখন চাচাকে বললাম তারা যে দোকানে ‘কন্যা’ পছন্দ করতে যাচ্ছেন সেই দোকানটির নাম নিয়ে আসতে। সুপ্ত ইচ্ছা ছিল পরদিন স্কুল থেকে আসার পথে সে দোকানে গিয়ে ‘কন্যা’ বা পাত্রী দেখে আসব। আমার এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই আমার ‘গাধা’ত্ব দেখে প্রচুর হেসেছিলেন আর আমি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম। এখন মনে হয় গাধার মতো আমার ওই কথাটিই একটি কঠোর সত্য সমাজে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। যেমন, মেয়ের গায়ের রং, চুল, নাক, মুখ-এর গড়ন ইত্যাদি যত সুন্দর হবে, বিয়ের বাজারে তার মূল্য ততই বেশি। এ ছাড়াও তাকে দেখা হয় ভোগের বস্ত, সন্তান উৎপাদনের কারখানা, পরিবারের বিভিন্ন কাজ ও সেবাদান এবং সবার জন্য বিনাবেতনের জোগানদাতা হিসেবে। 

আমাদের দেশের প্রগতিশীল অনেকেই বলেন, বাজার অর্থনীতি নারীকে পণ্য হিসেবে মিডিয়ায়, সমাজে তুলে ধরছে। কথাটা ঠিক, কিন্ত অর্ধসত্য। পরিবার, সমাজ নারীকে যেভাবে দেখে বাজার সেই মনমানসিকতাকেই পুঁজি করে মুনাফা লোটে। ছোটবেলা থেকেই আমরা বিভিন্ন ওয়াজ ও খুতবায় শুনে আসছি যে, পুণ্য করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে এবং সেখানে বিভিন্ন সুস্বাদু ফল, পানীয় ইত্যাদির সাথে ৭০টি হুর-পরিও পাওয়া যাবে। আর সর্বশেষ এখন তো দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্যাসেট ও হেফাজতের বদৌলতে নারী ছিলাকলা বা তেঁতুল হিসেবে অনেকেরই মানসপটে। এ ছাড়াও, ‘স্বামীর পায়ের তলায় বেহেশত’— এই ওয়াজ বা খুতবা হরহামেশাই দেওয়া হয়। এসব যারা শোনেন তাদের মধ্যে শুধু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিতরাই নন, অনেক উচ্চশিক্ষিত ধনী লোকও থাকেন। থাকেন অনেক রাজনীতিবিদও, যাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। তারাও এর প্রতিবাদ করেন না, ভাবেন না এ অবস্থায় তাদের মা, বোন বা মেয়ে ৭০ জনের পর ১ জন হবেন। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের অনেকেই ভাবেন না এই সমস্ত বক্তব্য সংবিধানবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যারা ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’-এর রাজনীতি করছেন, তারাও এর বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। মূল বিষয় হচ্ছে আমরা যুক্তি-বুদ্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এরূপ, যা আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি খাটাতে বা প্রশ্ন করতে শেখায় না। তা না হলে কিছুদিন আগেও ফতোয়া দেওয়া হতো ছবি তোলা হারাম, কোরান-হাদিসে নিষেধ আছে। এ সম্পর্কিত আরজ আলী মাতুব্বর-এর জীবনের ঘটনাটি আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয় যে, যখন কোরান-হাদিস নাজেল হয়েছে, তখন ক্যামেরা বা ছবি তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই কোরান-হাদিসে তার উল্লেখ থাকবার প্রশ্ন আসে না। 

মাত্র ৪/৫ দিন আগে এক টিভিতে নিয়মিত প্রচারিত এক ধর্মবিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হুজুরকে একজন প্রশ্ন করলেন, যে রুমে টিভি আছে সে রুমে নামাজ হবে কি না এবং হাদিসে এ বিষয়ে কী নির্দেশ দেওয়া আছে? প্রশ্নকর্তা নিশ্চিয়ই অশিক্ষিত নন, তবু তার মাথায় আসে না যে ইসলাম যখন প্রবর্তিত হয় ও কোরান-হাদিস যখন লিপিবদ্ধ হয়, তখন টিভি ছিল না; তাহলে এ বিষয়ে কোরান-হাদিসে কীভাবে নির্দেশ থাকবে? 

সবশেষে এটুকুই বলতে চাই, আমাদের অসচেতনতা শুধু বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমেই দূরীভূত হবে তা নয়, যেমন এনজিও সেক্টর, রাষ্ট্রের প্রশাসন, আইন বিভাগ, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ যে যেখানেই কর্মরত আছেন, তারা সবাই তুলনামূলকভাবে উচ্চশিক্ষিত। তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, সব সেক্টরে নিয়োজিতদেরই জেন্ডার এবং মানবাধিকার বিষয়ে সংবেদনশীল করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। কারণ ‘মূল্যবোধ’, ‘পরিবারের সম্মান’, ‘নারীর ইজ্জত’— এ বিষয়সমূহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে না দিয়ে সমস্যার মূলসমূহকে বিশ্লেষণ করেই আমরা কী ধরনের ‘মূল্যবোধ’ চাই, কী ধরনের ‘গণতন্ত্র’ চাই, কী ধরনের ‘শিক্ষা’ চাই— সেগুলো স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

Monday, 5 October 2020

বিচারহীনতা ও সামাজিক সংস্কৃতির মৌনতা : অব্যাহত নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন : রোকেয়া কবীর

ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানির খবরে প্রতিদিনকার পত্র-পত্রিকাই সয়লাব থাকে। এসব খবরের কিছু নমুনা, যেমন বৃদ্ধ কর্তৃক শিশু ধর্ষণ, প্রেমিক কর্তৃক ধর্ষণ, ডাক্তার কর্তৃক রোগী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, অফিসের বস কর্তৃক সহকর্মীকে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ, গাড়িচালক ও কন্ডাক্টর কর্তৃক নারী যাত্রী ধর্ষণ। আমরা উদ্বেগজনকভাবে দেখছি ছাত্রীর ধর্ষক হয়ে উঠছে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গীর্জার পাদরী। এমনকি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-পরিজন তথা দুলাভাই, বাবা, চাচা, মামা, শ্বশুর, দেবর, ভাসুরের লালসার হাত থেকেও নারী ও শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের কর্মী ও বিভিন্ন কিশোর গ্যাং, শ্রমিক সংগঠনের কর্মী— কে নয় এই ধর্ষণযজ্ঞে শরিক? এ যেন ঠগ বাছতে গা উজাড় হবার জোগাড়। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন এতিমখানা, মাদ্রাসা ও হোস্টেলে বাচ্চা ছেলেদের উপর বলাৎকার। তবে আজকের এই লেখা নারীর উপর ধর্ষণ ও হয়রানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। 

সবাই জানে, যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার সবটাই সংবাদ হয় না। অর্থাৎ পত্র-পত্রিকায় আমরা যেসব সংবাদ দেখি, তা সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার একটা অংশ মাত্র। সাধারণত মামলা হলেই ঘটনার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় আসে। অথবা পত্র-পত্রিকায় আসলে মামলা হয় এবং পুলিশ প্রশাসন একটু তৎপর হয়। কিন্তু সব ধর্ষণ ঘটনায় মামলা হয় না, কারণ মামলা করায় অনেক ঝামেলা। মামলা চলাকালীন ভিকটিম নারীকেই জেরার নামে যেভাবে হেনস্থা করা হয় তার জন্যও অনেকে মামলার ঝামেলায় যেতে চান না। তা ছাড়া মামলা করেও অনেক ভিকটিম বিচার পায় না ও বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করে। অনেক সময় প্রভাবশালীরা সালিশের নামে ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, ভিকটিমকে কলংকের ভয় দেখিয়ে সালিশের মাধ্যমে ঘটনার নিষ্পত্তি করে। ধর্ষকের বিচার না করে সালিশ-এর মাধ্যমে সমঝোতা বা ধর্ষক-এর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে, অনেক সময় এই অপমান সইতে না পেরে ভিকটিম আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

ধর্ষণ ঘটনায় প্রায়ই সবকিছু ছাপিয়ে ঘটা করে ভিকটিম নারী বা মেয়েটি কী ধরনের পোশাক পরেছিল, কীভাবে চলাফেরা করত, কোথায়-কোথায় যেত, তার ছেলেবন্ধু ছিল কি না, রাতে বাইরে বের হতো কি না, সিগারেট খেত কি না ইত্যাদি আলোচনা প্রাধান্য পায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ধর্ষণ ঘটনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা, যেন কেউ আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে, স্বাধীনভাবে  চলাফেরা করলে, ছেলেবন্ধু থাকলে বা রাতে বাইরে বেরোলে ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়। এমনকি আমরা দেখি, কোনো অপরাধ করে যদি কোনো নারী বিচারে সোপর্দ হয়, সেখানেও অপরাধ-এর চাইতে সবার কাছে অভিযুক্ত নারীর পরিধেয় ও জীবনাচরণই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও অনেক সময় এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং বিকৃত মানসিকতার এসব ব্যক্তিদের কৌতূহলের খোরাক জুগিয়ে চলে।    

এরকম বাস্তবতায় প্রায় সব মহলে আলোচনায় উঠে আসে যে ধর্ষকের কঠোর বিচার হয় না বলেই এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাহলে সৌদি আরবে কঠোর শাস্তি শিরচ্ছেদ-এর পরও আমাদের নারীকর্মীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে দেশে ফিরত না। একথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবিধানে দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এটা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির একটা বড় কারণ। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রশ্রয়, যখন যে ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নাম ব্যবহার বা তাদের আশ্রয় ও প্রশাসনের আশ্রয় বা নির্লিপ্ততা ইত্যাদিও আরেক বড় কারণ। তবে আমরা অনেকেই জানি, কেবল কঠোর বিচার দিয়েই ধর্ষণ থামানো যাবে না। কারণ ধর্ষণের অন্যতম মূল কারণ আমাদের সমাজ মানসিকতা। যে মানসিকতায় নারীকে মর্যাদাশীল মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না, ভোগের সামগ্রী হিসাবে দেখা হয়। এর মূলে রয়েছে পুরুষের সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ— পরিবার, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সব সংগঠন, ধর্মীয় সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ। এই আধিপত্যবাদ সমাজ, সংস্কৃতি ও মনোজগতে এমন ভাবনা সৃষ্টি করেছে যে পুরুষ যা চায় তা পাওয়ার অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। সেটা অধস্তন হিসেবে নারী জোগাতে বাধ্য। সেটা বিকৃত যৌনক্ষুধা বা অন্য যে কোনো সেবাই হোক না কেন। এর একটা উদাহরণ স্বৈরাচারী এরশাদ-এর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন নারীর সঙ্গে যে সম্পর্ক সে খবরে তখনকার গণমাধ্যম সয়লাব ছিল। ঐ সময়ে নির্বাচনে রংপুরে তার পক্ষের মিছিলের জোয়ারে একজন সাংবাদিক এক নারীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এরশাদের এই চরিত্রের কথা জেনেও আপনারা তাকে ভোট দেবেন? উত্তর ছিল— “এরশাদ আমাগো রংপুরের ছাওয়াল। ছাওয়াল গো এ রকমের অভ্যাস থাকেই, এটা দোষের কিছু নয়”। এবং এই মাসসিকতায়ই বাস বা টেম্পোর হেল্পার পর্যন্ত নারীদের গায়ে অবলীলায় হাত চালায় এবং অন্য যাত্রীরা তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে না, এটাকে গ্রহণও করে। তা না হলে সামান্য ঘটনায় তথাকথিত “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” লেগেছে এই অজুহাতে যেখানে হাজার হাজার লোক নিমেষেই রাস্তায় নেমে পড়তে পারে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করার জন্য, সেখানে সিলেট এমসি কলেজের ঘটনায় কেন মানুষ এগিয়ে এল না? এর প্রধান কারণ একটাই— নারীকে মানুষ না ভাবা, সমান নাগরিক হিসাবে তার সমমর্যাদা অস্বীকার করা থেকেই এই অবস্থার সৃষ্টি। 

সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানেও যে প্রবণতা কাজ করে তা হলো একজন নারী একজন পুরুষ একসাথে দেখলেই তাদের সম্পর্কের প্রতি অনাবশ্যক কৌতূহল। এবং তথাকথিত অনৈতিকতার এই  মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে, অনৈতিকতার অজুহাত দাঁড় করিয়ে ধর্ষণের তথাকথিত যৌক্তিকতা দাঁড় করানো। খবরে প্রকাশ, ঘটনার শিকার নারী তার স্বামীর সাথে নিজেদের গাড়িতে করে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সিলেটের টিলাগড়ে অবস্থিত এমসি কলেজে গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারা কিছু কেনার জন্য নেমেছিলেন। সেখানে এসে অভিযুক্ত ধর্ষকরা অনাবশ্যকভাবে তারা স্বামী-স্ত্রী কিনা এই  প্রশ্ন করে ও স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন মিলে ওই নারীকে জোর করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

প্রশ্ন হলো দুজন নারী-পুরুষ একত্র কোথাও বেড়াতে গেলে বা বাইরে বেরোলে তাকে কেউ এরকম জেরা করতে পারে কি না? সে অধিকার কারো নেই। দুজন নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা বা বন্ধু যাই হোক, তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা বা হয়রানি করার কোনো  অধিকার কারো নেই। এমন হয়রানি পুলিশরাও মাঝে মাঝে করে থাকে, দুজন ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলে এ ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করে এবং টাকা আদায় করে। এমনকি পুলিশ সদস্যদের এরকম অপতৎপরতা আমরা প্রায়ই দেখি পার্কে, নদী তীরে ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। আইনের লোক হয়ে পুলিশের এরকম বেআইনি তৎপরতা সাধারণ মানুষকেও এসবে উৎসাহিত করে। পুলিশ সদস্যদের তৎপর হওয়া আইনত যে সমস্ত ঘটনায় দরকার এরকম অজস্র ঘটনা সবসময় চারপাশে ঘটছে। কিন্তু সেসব ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। তাদের চোখের সামনে দিয়ে খুন, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা ও দুর্নীতির আসামি ঘুরে বেড়ায়। সব মানুষ তাদের দেখতে পায় কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। সাধারণ নাগরিকদেরও করবার মতো অনেক কাজ আছে, কিন্তু তারা সেসব করে না। যেমন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের পাশের আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দার বরাতে জানা যায়, রাতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু তারা সেখানে এগিয়ে আসেনি। আবাসিক এলাকার লোকজন দলবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে হয়ত ওই নারী ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেত। তাই পরিবার, সমাজ, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নারীকে সমান চোখে দেখতে পারার যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বা চিন্তাধারা তা ছড়িয়ে দিতে হবে। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। আর এখানে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারা যদি এই ধর্ষকদের তাদের নাম ভাঙাতে না দেয় এবং এই সমস্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে কাজ করেন, তখন সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তখন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং এ সমস্ত ঘটনা কমে আসবে। তাহলেই আমাদের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল হবে।

করোনার হাতি হয়ে ওঠার গল্প : রোকেয়া কবীর

করোনাভাইরাস-এর আবির্ভাব গত ডিসেম্বর থেকে চীনে শুরু হলেও সারা পৃথিবীতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় মূলত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে। বাংলাদেশে বলতে গেলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মিডিয়ায় এর ওপর রিপোর্টিং সবার চোখে পড়ার মতো করে আসতে থাকে। ভাইরাসটির আকার এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তা দেখতে অত্যন্ত শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। তা এ হেন অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নস্যি কণা— যা ধূলিকণারও অধম আকারের দিক থেকে, সে কীভাবে হাতি হয়!

জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, কোরিয়া, এমনকি কিউবা, ব্রাজিল, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাইরোলজিস্ট, ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানি থেকে শুরু করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) সবার থেকে এই ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায়, মানুষকে কীভাবে কাবু করে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে অনেক নির্দেশনা, অনেক গবেষণার ফলাফল আমরা এই যুগের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনই পাচ্ছি। এত ধরনের মতামত এসেছে যে প্রায় সময়ই দেখা যাচ্ছে একজনের মতের সঙ্গে অন্যের অভিমত মিলছে না। এমনকি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হু যে স্বাস্থ্য নির্দেশনা দিয়েছে, তা থেকে পরে প্রতিষ্ঠানটি সরে এসেছে। এটা শুধু হু না, ভাইরোলজিস্ট, বায়োলজিস্ট, ডাক্তার, মহামারি বিশেষজ্ঞ সবারই একই অবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথমে হু-এর কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে যে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিরাই মাস্ক পরবে। এখন সেটা উলটে গেছে। ঠিক তেমনি জাপান ও কোরিয়ায় প্রচলিত কিছু ওষুধ, অথবা ভারতের হোমিওপ্যাথিক অথবা ভেষজ কোনো ওষুধ কীভাবে কার্যকর বলে রায় দেওয়া হলো এবং পরবর্তী সময়ে তা নাকচ করা হলো, এগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি। টিকা আবিষ্কারের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী আমরা পাচ্ছি, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয় নি। কবে হবে তাও জানতে পারছি না। অনেকে আন্দাজের উপর নির্ভর করেই কথা বলছেন। এই অবস্থা দেখে আমরা অন্ধের হাতি দেখার গল্প মনে করতে পারি।

অন্ধের হাতি দেখার মতোই করোনা সম্পর্কে যে যতটা জেনেছে, সে ততটা বলছে। করোনার অবয়ব, গঠনপ্রণালি, কীভাবে এটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, মানুষের ভিতরের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কীভাবে বিকল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তার সার্বিক চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা এখনো কোনো সুস্পষ্ট চিত্র পাচ্ছি না। এখনো এটি অন্ধের হাতি দেখার মতো অবস্থাতেই রয়ে গেছে। 

আমরা ছোটবেলা থেকে ‘গরিবের দ্বারে হাতির পা পড়া’ প্রবাদটি জানি। এটি হয়ত এ কারণে এসেছে যে, আগের দিনে রাজা-জমিদাররা কোনো দরিদ্র প্রজার উপরে কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হলে প্রজার বাড়িতে এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্য হাতি পাঠিয়ে দিতেন। রাজা বা জমিদারের হাতির যত্ন-আত্তি সঠিকভাবে বা রাজা/জমিদারের মান অনুযায়ী করতেই হবে। গরিবের জন্য এটা যে কত বড়ো শাস্তি তা কে না বুঝতে পারে! রাজার হাতি প্রতিপালন করতে গিয়ে দরিদ্র প্রজার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত। একইভাবে করোনাভাইরাস মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র মানুষের দ্বারে পা রাখায় তার জীবন ও জীবিকা দুইই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। এই হাতি এমন হাতি, সে যে দিক দিয়েই যাচ্ছে, তা সে রাজার বাড়ি হোক বা প্রজার বাড়ি হোক, রাজার ফুলবাগান হোক বা প্রজার পর্ণকুটির হোক, তার পায়ের নিচে সকলই ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রও এই হাতির পায়ের নিচে পর্যুদস্ত। আর আমাদের মতো দেশের অবস্থা কী তা তো আমরা নিজেরাই দেখছি। এখন আর কোনো প্রেসিডেন্ট বা রাজা অথবা কোনো বড়োলোকই এই হাতিকে তাদের দরজায় রেখে গৌরব বা সম্মানিত বোধ করবেন না।

এই হাতি এমন হাতি যার কোনো মাহুত দরকার পড়ছে না, বল্লম দরকার পড়ছে না, যুদ্ধাস্ত্র দরকার পড়ছে না। এমনকি তার কারো প্রতি ‘খামোশ’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে হচ্ছে না। তারপরও সারা পৃথিবীই তার কাছে খামোশ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই কানোভাইরাসটিকে হাতির চেয়ে কম বলা যাচ্ছে কি?

এবার আসা যাক করোনাভাইরাস-এর মোকাবেলা প্রসঙ্গে। এই ভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য যেহেতু কোনো ধরনের অস্ত্র, অর্থাৎ কোনো টিকা এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় নি, কাজেই আমাদের নিজ বাড়ির দুর্গে অবস্থান করতে হচ্ছে এবং ঘরের বাইরে বের হলে প্রয়োজনীয় বর্ম, অর্থাৎ মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার ইত্যাদি পরিধান করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শারীরিক সক্ষমতা তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, মনোবল চাঙ্গা রাখতে, সবসময় হাত সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত রাখতে, মাস্ক পরতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে। জানানো হচ্ছে, যতক্ষণ করোনার প্রতিষেধক না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন এভাবেই জীবনযাপন করতে হবে; এবং এগুলোতেও যখন তেমন কাজ হচ্ছে না, তখন সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’-এ থাকতে হচ্ছে বা হবে।  

অনেকে ঠাট্টা করে বললেও বিষয়টি অতি সত্যি যে পুরুষতান্ত্রিক ভাইরাসের দাপটে নারীরা সারাজীবন বাড়ির ভিতরে লকডাউন অবস্থায় থাকে। এই লকডাউন অবস্থায় থাকা সত্তে¡ও পুরুষতন্ত্রের ভাইরাস দ্বারা ঘরের ভিতরে নারীদের জখম হতে হয়, প্রাণ দিতে হয়। আবার বাড়ির বাইরে বের হতে হলে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য হিজাব, স্কার্ফ, বোরকা ইত্যাদি পিপিই পরেও অনেক সময় তাদের শেষরক্ষা হয় না। তারা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার হন, এমনকি তাদের প্রাণও দিতে হয়। 

কার্যকর টিকা না আসায় করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় যেমন শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার কথা বলা হচ্ছে, তেমনি পুরুষতান্ত্রিকতার ছোবল থেকে নারীসমাজের রেহাই বা মুক্তির জন্যও তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, যার অপর নাম এমপাওয়ারমেন্ট, তার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে নির্মূল করার জন্য যে ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কার্যকর ওষুধ, সে সম্পর্কে সারা পৃথিবীর নীতিনির্ধারকরাই কোনো কথা বলছেন না। বরং নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর দক্ষতা বা স্কিল ইত্যাদি বাড়ানোর মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকছেন। 

কারোনাহাতির দাবড়ানি খেয়ে এ বিষয়ে আমাদের চোখের পর্দা যদি কিছুটা হলেও সরে এবং নারীর জীবন লকডাউন থেকে মুক্তি পায় সে কামনাই শুধু করতে পারছি।

করোনাকালের মিনিগল্প : রোকেয়া কবীর

গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম ভাগে আমরা যখন ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা লিখতে হতো। তার মধ্যে একটি ছিল ‘গ্রিক সভ্যতা ক্রীতদাসদের দান’, আরেকটি ছিল ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’ (গরুর রচনা লেখার পাশাপাশি)। শুধু গ্রিক সভ্যতা বা রোমের গড়ে ওঠা না, তাজমহল থেকে শুরু করে পিরামিডসহ পৃথিবীর যেসব বড় বড় স্থাপনা, বড় বড় স্কাল্পচার তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা ‘সভ্যতা’র নিদর্শন বলি, এর সবই ওই দাসদের দান। এমনকি আমরা যেটাকে সভ্যতার যুগ বলি, সেই যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সম্পদশালী হয়েছে এবং বর্তমানে দেশটিতে যতটুকুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানেও ক্রীতদাসদেরই অবদান। 

এই কথাটি মনে পড়ল সম্প্রতি ডেইলি স্টারে বিজিএমইএ’র সভাপ্রধান ড. রুবানা হকের একটি বিবৃতি দেখে। বিবৃতিটি উনি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিক শোষণ এবং করোনার সময়েও শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের অমানবিক আচরণের যে অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষ থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেই অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে। বিবৃতির শেষ দিকে উনি যা লিখেছেন তা বাংলায় সংক্ষেপে তর্জমা করলে দাঁড়ায়— ‘পোশাক শিল্পের মালিকরা বা বিজিএমইএ কখনো ‘নিও লিবারালিজম’ সাপোর্ট করে না, শ্রমিকদের শোষণ বা নির্যাতন করে না।’ আমরা জানি, রুবানা হক একজন সফল ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাই শুধু নন, তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী; অত্যন্ত ভদ্র এবং খুব মেপে কথা বলেন। ‘আকলমন্দ কে লিয়ে ইশরায় কাফি’, এই সূত্রে আমি আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত (মিনি) আকারেই বলছি : 

তিনি নিজেই জানেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রফিট, সারপ্লাস ভ্যালু বা উদ্বৃত্ত মূল্যের যে থিউরি, যা কার্ল মার্কস বলে গেছেন; সেটা প্রমাণ করার জন্য পদ্ধতি অর্থনীতিবিদ বা রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার দরকার নেই। মোটাদাগে বলা যায়, আমরা দেখেছি বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অতি অল্প সময়ে কীভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই ফুলেফেঁপে ওঠার জন্য অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে যে প্রফিট অ্যাকিউমুলেটেড বা পুঞ্জীভূত হয়েছে, তার পিছনে শ্রমিকদের শ্রম শোষণই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যেমন মোটাদাগে বলা যায়, এই শিল্পের যত মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল দরকার, তার নগণ্য অংশ বাদ দিয়ে প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তার জন্য যে মূল্য তা পাই পয়সা হিসেবে পরিশোধ করেই সেগুলো আমদানি করতে হয়। তাহলে তাদের প্রফিট বা লাভটা কোথা থেকে আসে? এটা সকলেই জানে যে, শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে যে মার্জিনটা থাকে সেখান থেকেই এই প্রফিটটা আসে। তারা যে দাবিটা করেন যে তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে, বিশেষ করে নারীদের চাকুরির সংস্থান করে দিয়েছেন, সেটা তাদের প্রতি দয়া বা নারী অধিকারের প্রতি সম্মানবোধ থেকে নয়, বরং কিছুটা কম ঝামেলায় তাদের কম বেতন দিয়েই পার পাওয়া যাবে এই বিবেচনাটাই এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। আর লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ না দিলে হাজার কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করা যাবে না। সেই কারণেই তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের লাভের অংকটা বাড়ানোর জন্য।

আর বাজারে যে মিথটা চালু করতে তারা সফল হয়েছেন যে, গার্মেন্টস মালিকরাই এই দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনীতিকে সচল রাখায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন এটা ঠিক নয়। এই বক্তব্য যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ আগেই বলেছি, মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল সব বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং সেটা বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করেই। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা যেটা দেশে আসে সেটা শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে তারা যে প্রফিটটা পান, যে সারপ্লাস ভ্যালুটা তৈরি হয় সেটা থেকেই অর্জিত হয়। সুতরাং এখানে শ্রমিকের অবদানই প্রধান। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রধান অবদান যে গার্মেন্টস মালিকদের নয়, এটা কেবল আমার বক্তব্য নয়; ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। পৃথিবীতে ধনী দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ধনীক সৃষ্টির যে দ্রুতগতি সেখানে বাংলাদেশের স্থান সামনের সারিতে, এটা কয়েক মাস আগে বৈশ্বিক জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।    

‘ও মা, রাজা ন্যাংটা’— এই গল্পটি আমরা অনেকেই জানি। নিউইয়র্কে করোনার করাল থাবা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ায় ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্কের গভর্নরের অতি সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য এই গল্পটিকে মনে করিয়ে দেয়। তার মন্তব্যটির সংক্ষিপ্ত তর্জমা হলো— ‘যুদ্ধের সময় যখন আমাদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা অর্থাৎ সৈনিকদের হাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও মারণাস্ত্রের কখনো কোনো অভাব হয় না (যেমন বন্দুক, কামান, ট্যাংক, ফাইটার প্লেন, পারমাণবিক বোমা ইত্যাদি), সেখানে বর্তমানে করোনার মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধের যারা সম্মুখ সারির সৈনিক অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই, করোনা সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কীটের প্রচণ্ড অভাব দেখতে পাই। কারণ তার জন্য অর্থের কোনো সংস্থান নেই।’ তার এই বক্তব্য বর্তমানে প্রচলিত অর্থনীতি এবং ‘গণতন্ত্র’-এর নামে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার (গভর্নমেন্ট বাই দা পিপল, ফর দা পিপল, অব দা পিপল) আসল চেহারা কিছুটা হলেও উন্মুক্ত করেছে এবং এই প্রপঞ্চের অসারতা প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রের কোথায় প্রায়োরিটি তাকে অত্যন্ত প্রকটভাবে উন্মোচন করেছে। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাকেই তুলে ধরে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এটা গোটা পৃথিবীরই চিত্র।

করোনাকালেই আমরা দেখছি, বাংলাদেশে বক্স খাটের নিচে ‘ভোজ্যতেলের খনি’। এই ঐতিহ্যের গল্প যদিও এদেশে নতুন না, তবু এই গল্প আমাদের ‘মানুষের উপরে কখনো বিশ্বাস হারাতে নেই’— এই বক্তব্যের ভিত্তিকে আবারো প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়।  

যা হোক, এই হতাশার মধ্যেও একটি ইতিবাচক সুর দিয়ে এই মিনিগল্পের ইতি টানি, সেটি হলো— বিশ্বে নারী নেত্বত্ব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন, যা আমরা বিশ্ব গণমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছি। 

করোনাকালের শিক্ষা : রোকেয়া কবীর

বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে যে অভ্যাস চালু করতে পারে নাই, করোনা তা পেরেছে। মানুষ এখন হাত ধোয়ার ব্যাপারে অনেক সচেতন হয়েছে। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ের যে হাইজিন, সামাজিক যে শিষ্টাচার (হাঁচি, কাশি, নাক ঝাড়া, থুথু ফেলা) মানুষ তা শিখছে; বাসার সুইচবোর্ড, দরজার হ্যান্ডেল পরিষ্কার করা শিখছে; সামাজিক ও ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখা যে দরকার সেটা শিখছে। বাংলাদেশে আমরা সাধারণত এরকমটা দেখি না। এখানে একজনের ঘাড়ের ওপরে অন্যজনের নিঃশ্বাস পড়ে। সভা-সমিতিতে বসার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম দূরত্বটা রক্ষা করতে হয় সে শিক্ষা আমাদের ছিল না প্রায়, যা আমরা এখন পাচ্ছি। এই শিক্ষাকে অভ্যাসে পরিণত করে যদি আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে।  

একটা বড়ো শিক্ষা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্য কোথাও দেখি না যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে নারীসমাজ, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে। এটাকেই আমরা নারীর জন্য উপযুক্ত স্থান ভাবি। এখন করোনা বিস্তার রোধ করার জন্য যখন পুরুষদেরও ঘরে থাকতে হচ্ছে, তখন এটাকে তাদের বন্দি জীবন হিসেবে ভাবা হচ্ছে। আমরা দেখছি তারা দুয়েকদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠছেন ও ভাবছেন এই অবস্থা আর কতদিন! ঘরে থাকতে হওয়ার এই অবস্থাটি কি তাদের এই উপলব্ধিটুকু দেবে যে নারীর চার দেয়ালে বন্দি জীবন কতটা দুর্বিষহ? নারীর এই বন্দি জীবন সম্পর্কে কি তারা এখন নতুন করে ভাবছেন বা ভাববেন? 

ঘরে আটকে থাকায় তাদের হাতে কোনো কাজ নেই বলে যখন তারা হাহুতাশ করছেন, তখন তারা কেন ঘরের কাজ, যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাপড় কাচা, ধোয়া-মোছা, রান্নাবান্নার কাজগুলো শিখছেন না ও করছেন না? এ সময়ে নারীর ঘরের কাজের চাপ সাধারণ সময়ের চাইতে আরো বেড়েছে। ঘরের কাজে সমানভাবে তারাও অংশ নিলে তিন দিক থেকে লাভবান হওয়া যেত ১. পুরুষদের ঘরে থাকার সময়ের সদ্ব্যবহার হতো, ২. তারা ঘরের কাজকে নিজেদের কাজ মনে করতে পারত এবং ৩. নারীদের কাজের ভার কিছুটা কমত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি আমরা যদি ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করে যেতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। 

মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যে খবর পাচ্ছি— সারা পৃথিবীতেই এ সময়ে নারীর ওপর কাজের চাপ বাড়ার পাশাপাশি নির্যাতনও বাড়ছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, পড়াশোনায় সহযোগিতা করার জন্য যে ব্যবস্থাপনা সেটা শুধু নারীদের ওপরে না চাপিয়ে এ দায়িত্বও পুরুষরা নিতে পারে। নির্যাতনের যে কথাগুলো মিডিয়ায় এসেছে ও আসছে সে ব্যাপারেও আমাদের পুরুষরা সচেতন হতে পারে। 

ঘরে হাঁপিয়ে ওঠার অজুহাতে অনেক সময় পুরুষরা ঘরে থাকার নিয়ম উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে সোশ্যালাইজেশনে যাচ্ছেন এবং ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ফিরে এসে ঘরের নারী ও শিশুদের সংক্রমিত করছেন।  যেহেতু এ সময়ে নারীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না, কাজেই এই সংক্রমণের জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়, অথচ তাদের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে।     

করোনাকালে আরো যে শিক্ষাগুলো আমাদের সামনে এসেছে তা হলো, এখন আমরা দেখছি সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কত কম! এটা উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত যে দেশের দিকেই তাকাই না কেন সর্বত্রই একই চিত্র। সবার চোখের সামনেই এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং একটা জোর তাগিদ এসেছে যে জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র এবং সমাজকে কোথায় কোথায় অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এই শিক্ষাটাকে দুর্যোগ উত্তরণের পরেও আমাদের ধরে রাখতে হবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে, সেটা আমূল পালটে শিক্ষার উন্নত মান নিশ্চিত করা এবং কোন কোন খাতে কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে সেটা এখন স্পষ্ট হয়ে এসেছে। সাধারণ স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান, বিশেষ করে জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান, যেগুলো জীবনযাপন এবং বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি করে, সে শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা দরকার। জনগণের সেবা দেবার জন্য স্বাস্থ্যখাতে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ সবার দক্ষতাবৃদ্ধিসহ সংখ্যাবৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তাও এখন সামনে এসেছে। তা ছাড়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনগণেরও সচেতনতা ও দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম থাকা দরকার। 

আরেকটি বিষয়েও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে যে সমস্যা এখন হচ্ছে তা সমাধান করার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের সহ সকল শ্রমিকের জন্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরাসরি তাদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। তাতে শুধু দুর্যোগের সময় না, স্বাভাবিক সময়েও বেতন-ভাতা নিয়ে যেসব অভিযোগ আসে, যেমন নিয়মিত বেতন না হওয়া এবং বেতন কাটা, এ বিষয়গুলো একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।  

যে কোনো সংকটজনক অবস্থা মানুষকে এমন কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দেয়, যা বিভিন্নভাবে মানুষের কাজে লাগে। আমাদের জীবনযাপনের মান উন্নত করে সকল মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলো নিয়মিতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়েও এই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আমাদের কাজে দেয়।  

আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং কর্মক্ষেত্রে নারী : রোকেয়া কবীর

আজ  ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বে প্রতি বছর বিশেষ গুরুত্বের সাথে এই দিবসটি উদযাপন হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দিবসটি উদযাপনের উদ্দেশ্যে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সর্বত্রই এর কার্যক্রম জুড়ে থাকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তাদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা এবং নারীর সমানাধিকারবিরোধী রীতি-প্রথা-সংস্কৃতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ। আর এসব কাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য অতি অবশ্যই নারীর বিরুদ্ধে বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা।    

নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সমঅধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম’। এই প্রতিপাদ্যে বর্তমান প্রজন্মকে নারীর সমান অধিকারের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গোতেরেস এবারের টঘঈঝড৬৪ বিষয়ক একটি প্রস্তুতিমূলক সভায় বলেছেন, বেশ কয়েক শতাব্দী আগে দাসপ্রথা যেমন মানব সভ্যতার ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে রেখেছে, বর্তমানেও সভ্যতার অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রভূত উন্নয়ন সত্তে¡ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নারীর প্রতি যে বৈষম্য বিদ্যমান তা একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে।  

সদ্য প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এর নারীর অবস্থা জরিপের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা পৃথিবীতে দক্ষিণ এশিয়া হলো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অসমতার প্রশ্নে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। যদিও নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সামনের সারিতে, তথাপি এখানে নারীর অগ্রগতি যে হারে হচ্ছে, তাতে বৈষম্যমুক্ত একটা অবস্থায় পৌঁছুতে আরো ৭১ বছর লাগবে।     

এটা সবারই জানা, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের সঙ্গে শ্রমিক নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসটি গভীরভাবে সম্পৃক্ত, যার সূচনা হয় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। সেবার মজুরিবৈষম্য লোপ, যৌক্তিক কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন কারখানার শ্রমিক নারীরা। সেই মিছিলে আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর নিপীড়ন নেমে এসেছিল। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে আগত নারী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। এর পরের বছর ৮ মার্চকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। সেই থেকে নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। 

শ্রমিক নারীদের আন্দোলনের ঘটনার সূত্রে আজকের আন্তর্জাতিক নারী দিবস; তার ১৬৩ বছর পরও কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি মজুরিবৈষম্য এখনো আছে। মজুরিবিহীন গার্হস্থ্য কাজ ও অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি অনেক আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রেও এখনো নারীদের ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম দিতে হয়। তদুপরি নারীর জন্য অনেক কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এখনো অনিরাপদ ও অমানবিক। কাজেই কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থা বিষয়ে আলোকপাত করা এখনো প্রাসঙ্গিক। এ লেখায় তা নিয়েই কিছু কথা বলবার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। 

১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘ নারী দিবস উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে আসছে। এ সময়ের মধ্যে একে একে যেসব প্রতিপাদ্য ঘোষিত হয়েছে তার মধ্যেও কয়েকটি সরাসরি নারীর উপার্জনমূলক কাজের পথ প্রশস্ত করার সাথে যুক্ত, যেমন ‘নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ’; ‘সমান অধিকার, সমান সুযোগ : সকলের অগ্রগতি’; ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ— মর্যাদাপূর্ণ কাজে নারীর অংশগ্রহণের মহাসড়ক’, ইত্যাদি। 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উপার্জনমূলক কাজের চাইতে মজুরিবিহীন পুনরুৎপাদনমূলক কাজেই মূলত নারীদের যুক্ততা। পুরুষের আধিপত্যবাদী সমাজ মানসিকতা নারীদের এই অবস্থায় দেখতেই অভ্যস্ত। সমাজ মানসিকতা এখনো এই অবস্থাটি টিকিয়ে রাখবার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। তবু আজকের দিনের নারী একান্ত বাধ্য না হলে রক্ষণশীল মানসিকতায় আবদ্ধ থাকতে আগ্রহী নয় বলে দিনে দিনে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৯-এর মে মাসে বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্ট্যাটেসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ-২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মোট ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫ সরকারি চাকরিজীবীর মধ্যে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৭ জন নারী, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১০ সালে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। সরকারি চাকরিতে নারীদের এই বৃদ্ধির চিত্র খুবই আশাব্যঞ্জক, যদিও শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির মোট চাকরিজীবী ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৫ জনের মধ্যে নারী মাত্র ৩১ হাজার ৪৩২ জন। এই চিত্র বদল হওয়া আবশ্যক।

বেসরকারি খাতের চাকরিতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প খাত নারীর অংশগ্রহণের একটি বড়ো ক্ষেত্র। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, করপোরেট খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাত। এগুলোর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতেই নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষাবঞ্চিত ও স্বল্প শিক্ষিত নারীদের শ্রমের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১৮ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তৈরি পোশাকশিল্প খাতে নারী আছেন মাত্র ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, অথচ ২০১৩ সালে করা একই সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এই খাতে নারী অংশগ্রহণের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। 

এই অবস্থাটি তৈরি হওয়ার পেছনে একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় কাজ করছে। খাতটিতে অটোমেশন তথা প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ার সাথে সাথে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ কমছে। সুযোগের সমতার অভাবে দক্ষতা অর্জনে নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। শ্রমিক নারীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারখানার তরফেও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। অন্যদিকে যন্ত্রনির্ভরতার বাইরের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কাজে সাধারণত নারীদের যুক্তই করা হয় না মালিকদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। খাতটিতে এখন আগের তুলনায় বেতন বেড়েছে। তাতে এক সময় যেখানে পুরুষদের আগ্রহ কম ছিল, এখন এ কাজে তাদের আগ্রহও বেড়েছে। ফলে প্রতিযোগিতায় পুরুষরাই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার যেসব গ্রামাঞ্চল থেকে শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প শিক্ষিত মেয়েরা গার্মেন্টস-এ কাজ করতে আসত, সেসব জায়গার কোথাও কোথাও রক্ষণশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রচারণাও প্রভাব রাখছে। তদুপরি কারখানাগুলো এখনো যৌন হয়রানিমুক্ত নয়। শ্রমিক নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী টয়লেটের অনুপস্থিতিও রয়েছে অধিকাংশ কারখানায়। 

এই অবস্থায় বিকল্প হিসেবে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নারী বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ নারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত হয়েছেন। ২০০৪ সালের পর থেকে তা ক্রমেই বেড়েছে। অধিকাংশ শ্রমিক নারী যেসব দেশে কর্মরত আছেন তার মধ্যে সৌদি আরব শীর্ষস্থানে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের মধ্যে আছে কুয়েত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, মরিশাস, মালয়েশিয়া, প্রভৃতি। দেশে কৃষির পরিসর ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাওয়া, গার্মেন্টসে সুযোগ কমে যাওয়া এবং বিদেশে বেতন বেশি হওয়ার কারণে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে বিদেশের কাজে আগ্রহও বাড়ছে। তবে সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ও লাশ হয়ে নারীদের ফিরে আসার ঘটনায় ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম হয়েছে। ফিরে আসাদের একাংশ নির্মম যৌন নির্যাতনের শিকার হবার অভিযোগ করেছেন। অনেকে স্থানীয় ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা না থাকা, নির্দিষ্ট কাজে পারদর্শিতা না থাকা, ওখানকার খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, প্রতিশ্রুত বেতন না পাওয়া ও বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হওয়ার কারণেও ফেরত এসেছেন। যদিও বিদেশে নিয়োজিত শ্রমিক নারীদের সংখ্যা এবং এ খাত থেকে তাদের মাধ্যমে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণের তুলনায় ফিরে আসা নারীদের হার কম, তবু এ ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ভালো একটা জীবনের আশায় কাজের জন্য বিদেশে গিয়ে একজন নারীর নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসাও প্রত্যাশিত নয়। শ্রমিক নারীদের গন্তব্য দেশে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে যারা নিয়োজিত আছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগও রয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাহার করে প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় যত্নবান হবেন এমন কর্মী নিয়োগ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া বৈধ উপায়ে ছাড়া প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে কেউ যাতে দালালদের মাধ্যমে অর্থ খরচ করে বিদেশে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। যেসব এলাকার নারীদের মধ্যে বিদেশে যাবার প্রবণতা বেশি সেখানে সচেতনতা কার্যক্রমও চালানো দরকার, যাতে তারা সবকিছু জেনেবুঝে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিদেশে যেতে পারেন। 

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)-এর শর্ত অনুযায়ী সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি ও সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে নারীর উপার্জনমূলক কর্মের স্বাধীনতাকে নিষ্কণ্টক করতে হবে। পাশাপাশি সব ধরনের কর্মক্ষেত্রকে নারীর জন্য নিরাপদ করে তুলতে হবে। সেজন্য নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন প্রভৃতি খাতেও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি। 

২০২০-এ বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার ২৫ বছর পূর্ণ হলো। এবারের নারী দিবস এই ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনাকে ঘিরে উদযাপিত হচ্ছে। এই কর্মপরিকল্পনায় যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে শ্রমিক নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্যুও রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সেগুলো এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যুবসমাজকে চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হবার সুপরামর্শ দিয়েছেন। তবে নারীদের উদ্যোক্তা হতে হলে পায়ের নিচে মাটি থাকতে হয়। কৃষিকাজ করতে হলে যেমন এ সম্পর্কিত সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পেতে নিজের নামে জমি থাকতে হয়, তেমনি অন্যান্য শিল্প বা ব্যবসা গড়ে তুলতে হলে ব্যাংকঋণ পেতে হয়। আবার ব্যাংকঋণ পেতে হলে সম্পদের মালিকানা থাকতে হয়, সেটা উত্তরাধিকার থেকে আসে। সুতরাং নারীসমাজের বহুদিনের দাবি নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে পিতামাতার সম্পদে সকল সন্তানের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। 

নারীর সমঅধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম : রোকেয়া কবীর

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আই এম জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি : রিয়ালাইজিং ওমেন’স রাইটস’ বাক্যটিকে— বাংলায় আমরা বলছি ‘নারী অধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই প্রতিপাদ্য। কারণ ইউএন ওমেন-এর যে ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনের সাথে এই প্রতিপাদ্য সম্পর্কিত, তা এসেছে এমন কিছু উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে, বাংলাদেশও যার অন্যতম অংশীদার। ২০২০ সাল বেইজিং ডিক্লারেশন এবং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন, সংক্ষেপে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন-এর ২৫তম বার্ষিকী। ১৯৯৫-এ গৃহীত এই দলিলটি নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে অগ্রসরমান রোডম্যাপ হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত। এ ছাড়াও, এ বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ-এর নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা (ডব্লিউপিএস) বিষয়ক রেজুলেশন ১৩২৫-এর ২০ বছর, নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নিবেদিত জাতিসংঘ-এর বিশেষায়িত সংস্থা ইউএন ওমেন-এর ১০ বছর এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ৫ বছর পূর্তি।  

যে উদ্বেগজনক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ২০২০-এ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে এটা সর্বত্র উপলব্ধ হয়েছে যে, কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটছে বেদনাকরভাবে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই পরিপূর্ণভাবে লিঙ্গসমতা অর্জন করতে পারে নি। আইন, নীতি ও সংস্কৃতিতে থাকা নারী-পুরুষ সমতার বাধাগুলো কম-বেশি সকল দেশেই এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল বা পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ভীষণভাবে প্রকট। এখনো সর্বত্রই নারী ও কিশোরীরা অবমূল্যায়িত। বেশি কাজ করেও তাদের উপার্জন কম। এখনো তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কোনো মূল্য পায় না। বাড়িতে ও বাড়ির বাইরের জনপরিসর তাদের জন্য এখনো নিষ্কণ্টক ও নিরাপদ নয়। 

সার্বিক বিবেচনায় নারীর জীবনে অনেক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও তাদের এগিয়ে চলার পথ বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি প্রতিকূল। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে এখানে সতত জোরদার করে চলেছে ধর্মীয় আধিপত্য। এই দুয়ে মিলে এখানে এমন এক সংস্কৃতি ক্রমবিকাশমান, যেখানে নারী ও তার জীবনযাপনের বিরুদ্ধে যত্রতত্র হেইটস্পিচ বা ঘৃণ্য উক্তি করেও কাউকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় না। অথচ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সুরে সুর মিলিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান নারীর প্রতি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈষম্য না করবার অঙ্গীকার করেছে। তদুপরি, সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের আন্তর্জাতিক সনদ সিডও বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ।

চীনের বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে লিঙ্গসমতার পক্ষে সক্রিয় নারীদের এক বৃহৎ সম্মিলন ঘটেছিল। সেই সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কৌশলগত ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, সেগুলো হলো দারিদ্র্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, সহিংসতা, সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনীতি, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, গণমাধ্যম, পরিবেশ এবং মেয়েশিশু। বিগত ২৫ বছরে এই ১২টি ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী অর্জন একেবারে কম নয়, তবে সময়ের বিবেচনায় ২৫ বছরের অর্জন হিসেবে তা এখনো নগণ্য। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে এখনো এর প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়েই কথা বলতে হয়। এমন একটিও ক্ষেত্র নেই, যেখানে আরো শ্রম, শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ না করলেও চলে। 

তবে আশার কথা যে বর্তমানে সারা বিশে^ই বিভিন্ন বয়সী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েদের পক্ষে কথা বলছেন, যাদের একটা অংশ নতুন প্রজন্মের। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন একটা ছাঁচে গড়ে তুলবার জন্য কাজ করছেন, যা মানবাধিকার ও লিঙ্গসমতা অর্জনে সহায়ক হবে, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।  

ইউএন ওমেন তাদের ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনে লিঙ্গসমতার আন্দোলনে অগ্রবর্তী প্রবীণ সংগ্রামীদের সাথে পরবর্তী প্রজন্মকেও যুক্ত করেছে, যাতে সব বয়স ও লিঙ্গের মানুষ একত্রিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত অসমাপ্ত কাজগুলো করে ভবিষ্যতের জন্য নারী ও মেয়েদের অধিকারগুলো আদায় করে নিতে পারে। সেজন্য জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি ক্যাম্পেইন জোর দিয়েছে সমান কাজে সমান বেতন, মজুরিবিহীন সেবামূলক ও গার্হস্থ্য কাজ ভাগাভাগি করে করা, যৌন হয়রানি এবং নারী ও মেয়েদের প্রতি হওয়া সকল প্রকার সহিংসতার অবসান, নারী ও মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব ও তাদের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের ওপর। 

আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকালেও বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষদের একটা অংশকে নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলনে সক্রিয় ও নিষ্ঠাবান দেখতে পাই। তবে উদ্বেগজনকভাবে ব্যাপার হলো পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর কণ্ঠ কখনো কখনো এই অংশের চাইতে বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে, যারা নারীদের এখনো কেবল পুরুষদের সেবাদাসী হিসেবেই দেখতে চায়। এই গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নারীর উচ্চ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ এবং উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হবার অধিকারের বিপক্ষে বিষোদগার করে চলেছে এবং নির্যাতকদের পক্ষে গেয়ে চলেছে নানারকম সাফাই। এতদিন কেবল বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও অডিও ক্যাসেট তাদের কথা বলার ক্ষেত্র হলেও এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ফ্রি ইউটিউবের কল্যাণে তারা ভিডিও হয়ে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অংশের অপপ্রচার থামানো না গেলে এদেশে নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত তো হবেই না, বরং আরো ধীরগতির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে রাষ্ট্র ও সরকারের জোরালো ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল শর্ত দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য তা দূর করা। পাশাপাশি এদের কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে নারী সহায়ক অংশের কণ্ঠস্বর আরো উচ্চকিত হওয়া দরকার, যাতে আরো অনেক মানুষের কাছে নারীর সমঅধিকারের বার্তাটি পৌঁছে এবং আরো অনেক মানুষ দায়িত্ব বোধ করেন নারীর সমান অধিকারবিরোধী অংশের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে। সেজন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতে পারে এবারের নারী দিবসে আমাদের প্রধান অঙ্গীকার। 

পাশাপাশি আইনিভাবেও এই অংশের মোকাবেলা করবার প্রয়োজন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যুক্ত সরকারের একটা বিভাগ অনলাইন কার্যক্রম মনিটর করবার কাজে রত আছে। অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে নারীবিরোধী এ জাতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এই বিভাগের সক্রিয় তৎপরতা দেখা যায় না, যা এক ধরনের প্রশ্রয়ের নামান্তর। অন্তত দৃষ্টান্তমূলকভাবেও যদি দুয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যেত, তাহলে এ ধরনের অপতৎপরতার রাশ টেনে ধরা সহজ হতো। আশা করি এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যত্নবান হবে, কারণ বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯-এ নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক অ্যাকশন প্ল্যানও গ্রহণ করেছে, যা তাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। তা ছাড়া, সিডও সনদ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার অধীন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নারীবিরোধী অংশের ক্রমশ বিকশিত হবার সুযোগ উন্মুক্ত রেখে এসব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অর্জন কিছুতেই সম্ভব নয়।