২০ নভেম্বর ২০১১-এর দৈনিক সমকালের ‘নারীস্থান’ পড়ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল দুটি ফিচারে। ‘প্রশংসনীয় উদ্যোগ’ নামের প্রথম ফিচারটি ভারী যান চালানোর প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নারী পুলিশদের নিয়ে। পড়ে উদ্দীপ্ত বোধ করলাম। ‘প্রথম প্রথম মনে হয়েছে--- আমরা কি বাস চালাতে পারব! ভয়ও লাগছিল অত বড় গাড়ি কীভাবে ম্যানেজ করব, এই ভেবে। কিন্তু এখন ভয় পুরোপুরি কেটে গেছে।’ এ কথা ১১ আর্মড নারী পুলিশের একজন সদস্যের, যিনি বেসিক ড্রাইভিং কোর্সে অংশ নিয়েছেন। এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়কও একজন নারী, আবিদা সুলতানা। তিনি বলছেন : ‘আমি আমার ব্যাটালিয়নের সব সদস্যকে সব দিক থেকে পারদর্শী করে তুলতে চাই। মহিলা পুলিশ কত আর কাজ জানবে--- এমন নেতিবাচক কথা যেন কেউ বলতে না পারে সেটাই চাই। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে নারী পুলিশ সদস্যদের এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।’ একই দিনে ছাপা নারীস্থানের আরেকটি ফিচার হলো ‘মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব : ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নারীরা’, যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশের মাটিতে চলমান ২০১৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের খেলার বর্ণনা উঠে এসেছে। আমাদের ক্রিকেটযোদ্ধা মেয়েরা এই বাছাইয়ের লড়াইয়ে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। তারা জাপান ও আয়ারল্যান্ডের নারীক্রিকেটারদের পরাস্ত করে ওয়ানডে ক্রিকেটের মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়েছে। উল্লেখ্য, এই ক্রীড়োৎসবে সমাগত পৃথিবীর দশটি দেশের ক্রিকেট টিমের কোচ, ম্যানেজার এবং ফিজিওরাও নারী। ক্রিকেটের পাশাপাশি যাঁদের কেউ কেউ চাকুরি করেন, সংসার-সন্তান সামলান ও পড়াশোনা করেন। ভাবছি, এই সংবাদ দেখলে বেগম রোকেয়া কী ভাবতেন? বলতেন কি যে, ‘আমরা সবই পারি’--- এরকম আস্থার জমিতে দাঁড়ানো এই নারীরা আমাদের আগামী সময়ের দিশা? হয়ত তিনি আশার স্বপ্ন বুনতেন আমাদের নারীদের নিয়ে। হয়ত এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভাবতেন, এখনকার দিনের স্ত্রীজাতির অবনতির প্রধান কারণ নারীর প্রজনন কর্মভার! এ অবস্থা থেকে এদের উত্তরণ ঘটাতে হবে।
‘উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী”র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?’ মতিচুর গ্রন্থভুক্ত ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামক প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া এই প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেক আগে, বিশ শতকের সূচনালগ্নে। তিনি লক্ষ করেছিলেন তাঁর সময়ের বঙ্গীয় নারী, বিশেষ করে সিংহভাগ মুসলিম নারী অলঙ্কারের ভারে জড়পিণ্ড হয়ে এক বিড়ম্বনাকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে জীবনে স্বামীর প্রভুত্ব সহ্য করে মুখ বুজে তার সেবা করাই একমাত্র জীবনাদর্শ। যে জীবনে স্বামীগৃহের তাবৎ গার্হস্থ্যকর্মে যন্ত্রবৎ নিমজ্জিত হয়ে থাকার অধিক নিজের হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মন ও চিন্তাশক্তিকে নিজেদের বিকাশে কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরনির্ভরশীল, অলঙ্কার-বিড়ম্বিত ও ভীরু নারীজাতির তিনি তুখোড় সমালোচনা করেন। উল্লিখিত প্রবন্ধে পরনির্ভর নারীসমাজের পশ্চাৎযাত্রার ছবি আঁকেন তিনি এভাবে : ‘আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখন কাজেই তাহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন। আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশুপক্ষীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি।’ অলঙ্কারে মুগ্ধ স্ত্রীলোকদের তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছু নহে’। বাইরের বিশালতার সাথে যুক্ত না-থেকে গৃহকোণে বন্দি সুশ্রী পুতুলের মতো জীবনযাপনকারী অনেক ভীরু নারীকে তীব্র ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়া থাকি!!... ব্যাঘ্র ভল্লুক ত দূরে থাকুক, আরসুলা, জলৌকা প্রভৃতি কীট পতঙ্গ দেখিয়া আমরা ভীতবিহ্বলা হই! এমনকি অনেকে মূর্চ্ছিতা হন।’ এই সমুদয় বৈশিষ্ট্যকে (পরনির্ভরশীলতা, অলঙ্কার-ভারাচ্ছন্নতা ও ভীরুতা) অনেক আগেই তিনি নারীর সম্মানজনক ও স্বাধীন জীবনের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভাগ্যিস করেছিলেন! নইলে হয়ত আমাদের দুর্দশার পথ আরো দীর্ঘায়িত হতো।
তিনি বলেছেন, ‘অনেকে মনে করেন যে, পুরুষের উপার্জিত ধন ভোগ করে বলিয়াই নারী তাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক।’ আমরাও মনে করি যে কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক, তবে সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কারণ পুরুষ-সহায়ক সমাজধর্ম ও সমাজসদস্যদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নিয়মিত উপার্জনে নিয়োজিত অনেক শিক্ষিত নারীকেও এ সমাজে পুরুষের প্রভুত্ব ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়, ‘অকর্মণ্য’ পুরুষেরাই যখন তাদের ‘স্বামী’ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রোমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাইদ যেমনটি ছিলেন। অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘স্বামী’পুরুষের প্রভুত্ব ও অত্যাচার বেশি মাত্রায় সহ্য করতে হয় অর্থনৈতিক উপার্জনের সাথে যুক্ত নন এমন নারীদের। অবনত স্ত্রীজাতির এই অবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনে বেগম রোকেয়া নারীদের উপার্জনশীল করে তুলবার ব্যাপারে প্রচণ্ড তাড়া বোধ করেছেন। যে কারণে কেবল পাশ-করা বিদ্যাশিক্ষা না-করে অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করা, হস্ত দ্বারা সৎকার্য করা, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন, কর্ণ দ্বারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং স্বাধীনভাবে উপার্জনে নিযুক্ত হবার উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে প্রণোদিত করতে চেয়েছেন ও পথ দেখিয়েছেন, যাকে বেগম রোকেয়া ‘স্বাধীন ব্যবসায়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ‘আবশ্যক হইলে আমরা লেডী-কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-ব্যারিস্টার, লেডী-জজ সবই হইব।’
বেগম রোকেয়ার দেখানো পথ ধরে আজ আমাদের সমাজ অনেক বদলেছে। ‘লেডী-কেরানী’ তো এখন শত শত, এমনকি ‘লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট’, ‘লেডী-ব্যারিস্টার’ ও ‘লেডী-জজ’ও বিরলদৃষ্ট নয়। আমাদের নারীরা আজ অনেক অপ্রচলিত পেশায়ও নিয়োজিত হয়েছেন ও হচ্ছেন। বিজ্ঞান ও কারিগরি সাধনা, বিমান ও অন্যান্য যান চালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও ফটোগ্রাফি, সামরিকবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন, জনপ্রশাসন পরিচালনা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব পালন, ক্রিকেট-ফুটবল-মুষ্ঠিযুদ্ধ প্রভৃতি খেলাধুলায় নিযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক নারী আজ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, যেটা তাঁর সময়ে প্রায়-অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল।
লক্ষণীয় যে, আজ এতকিছুর পরও নারীজাতির সবিশেষ উন্নতি হয় নি ও হচ্ছে না। পরনির্ভরশীল, অলঙ্কার-বিড়ম্বিত ও ভীরু নারী আমাদের সমাজে এখনো আছেন। একশ বৎসরেরও আগের সমাজে একজন মুসলিম নারী যে ধরনের বন্দি জীবনযাপন করতেন, আজো আমাদের অনেক নারী সেভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এখনো বিপুলসংখ্যক নারীর জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে মজুরিবিহীন ‘স্বামী’র গৃহকার্য, তথা প্রজনন ও গার্হস্থ্য কর্মভারে পীড়িত হয়ে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে একের পর এক সন্তান জন্মদান ও পরিবারের সকল সদস্যের জীবনপ্রবাহ সচল রাখতে পরিবার-অভ্যন্তরস্থ যাবতীয় কাজের দায় সামলাতে গিয়ে তাদের নিজেদের জীবনের দিকে ফিরে তাকাবার কোনো অবকাশই মিলছে না। এদের জীবনে কোনো বিনোদন নেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে যুক্ততা দূরে থাক, সবকিছু সামলে মেলে না প্রতিবেশীর বাড়িতে একটু বেড়াতে যাবার ফুরসৎ। পরিবারে ভিতরে সার্বক্ষণিক সক্রিয়তার পরও বৃহত্তর নাগরিক সমাজে তাদের পরিচয় ‘নিষ্ক্রিয় মানুষ’ হিসেবে। কারণ বৃহত্তর সমাজে তাদের কোনো ভূমিকা রাখবারই সুযোগ নেই। সমাজ অনেকাংশে তাকে সেই স্পেস দেয় না।
বেগম রোকেয়ার সময়ের বাংলায় জনসংখ্যা কোনো সমস্যা ছিল না। পরিবারের ভিতরের পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমের বিনিময়মূল্যও ততদিনে হিসেব করে ওঠা যায় নি কিংবা তখন এ দাবি তোলারও দিন আসে নি যে, গার্হস্থ্যকর্মের ভার কেবল নারীর নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সকল সদস্যের। আজ এদেশে জনসংখ্যা এক বড়ো সমস্যা। আজ আমরা জেনে গেছি পরিবারের ভিতরে উৎপাদিত হয়ে ভিতরেই খরচ হয় এরকম উৎপাদনের পেছনে ব্যয়িত শ্রমের অর্থমূল্য কত বিপুল। কাজেই এখন বেগম রোকেয়ার থেকে এগিয়ে আমাদের ভাবতে হবে নারীর কাঁধ থেকে এই সনাতনী কর্মভার কমাবার বিষয়ে। এই ভার কমিয়ে বিপুল পরিমাণ নারীকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে সক্রিয় নাগরিক হবার সুযোগ করে দেয়া গেলে গৎবাঁধা গ্লানিকর জীবন থেকে উত্তরিত হয়ে ব্যক্তিনারী জীবনকে আনন্দময় একটা ব্যাপার বলে আবিষ্কার করে উঠবে।
আশা করি এ কথায় কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করবেন না যে, পরিবারের সন্তান সংখ্যা কমলে সন্তানের খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অর্থ বিনিয়োগে পরিবারের সংগতি বাড়বে। কমবে নারীর প্রজননতন্ত্রসংশ্লিষ্ট অসুস্থতা এবং মা ও শিশুমৃত্যুর হার। তাছাড়া নারীর বিভিন্নমুখী উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ততার ভিতর দিয়ে পরিবারে ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা চালু হবারও একটা অবকাশ তৈরি হবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কমবে নারী নির্যাতন। আর এরকম পরিস্থিতিতে সচেতন নারী ক্ষমতায়নের সিঁড়ি খুঁজে পাবে।
সমাজে এরকম অবস্থা সৃষ্টি করা গেলে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও অনেক বড়ো সুফল আসবে বলে আশা করা যায়। প্রথমত এতে জনসংখ্যার ভার কমবে। আর তাতে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয়জল ও জ্বালানি খাতে নাগরিকদের চাহিদা মিটাতে ক্রমবর্ধমান চাপ অনেকটা হ্রাস পাবে। রাস্তা, বাসস্থান ও অবকাঠামো উন্নয়নে জমির ওপর এবং বন, জলাভূমি ও পরিবেশের ওপরে চাপ কমবে। এক্ষেত্রে দুর্যোগের পরিমাণ হ্রাস পাবে বলেও আশা করা যায়। অন্তত দুর্যোগের ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলায় জনসাধারণ ও রাষ্ট্র অনেক বেশি সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারবে। সবিশেষ রাষ্ট্রের জনগণের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ ও হার বৃদ্ধি পাবে এবং সব মিলিয়ে নাগরিকদের জীবনমানে আসবে দৃশ্যমান ইতিবাচক উন্নয়নের জোয়ার।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বেগম রোকেয়া পরিবার ও সমাজশৃঙ্খল থেকে বঙ্গীয় নারীর নিজের ভিতরে মুক্তি চেয়েছিলেন। সে মুক্তি আজ কমবেশি আসতে লেগেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের যে একাংশ নারী শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে স্বাধীনভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন, তাদের ভূমিকাকে আরো নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি শিক্ষা ও উপার্জনমুখী কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত বৃহদাংশ নারীকে এই স্রোতে শামিল হবার সুযোগ করে দিতে পারলে বেগম রোকেয়ার প্রত্যাশা পরিপূর্ণতা পাবে। আমরা নিশ্চয়ই তা করতে চাই!