দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ বরাবরই চাচ্ছিলেন বিরোধী দল সংসদে যাক, জনগণের পক্ষে থেকে সরকার ও তার কৃতকর্মের সমালোচনা করুক। কিন্তু সংসদে তাঁদের অনুপস্থিতি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। আশার কথা, দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে বিরোধী দল অংশ নিয়েছে। কিন্তু সংসদ সদস্যগণ তাঁদের বিতর্কে অসংসদীয় ও আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করে দেশবাসীকে হতাশ করে চলেছেন। জনগণের পক্ষে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের জন্য আনুষ্ঠানিক বিতর্কস্থল জাতীয় সংসদকে তাঁরা পরিণত করেছেন হৈ-হট্টগোলের কেন্দ্রে, যা কোনো অবস্থাতেই প্রত্যাশিত হতে পারে না। সংগত কারণেই বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন স্তরে ও মিডিয়ায় এসব আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, নারী আন্দোলনকর্মী, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে যে, পুরো সমালোচনাটাই ঘুরেফিরে চলে যাচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে।
কথা হলো, যাঁরা দলের মনোনয়ন নিয়ে সংসদে যাবার সুযোগ পেয়েছেন, সংসদ অধিবেশনে বিতর্কে অংশ নিতে পারছেন, তাঁরা সবাই সংসদ সদস্য, তা নির্বাচিত কি মনোনীত হয়ে যেভাবেই তাঁরা সংসদে আসুন না কেন। সংসদ অধিবেশনের নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালিবিধি আছে, সদস্যদেরও আছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি ও সদস্য হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে একজন কতটা সচেতন এবং নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কতটা যত্নবান থাকেন, তার ওপরে নির্ভর করে নির্দিষ্ট সদস্যের ভালোমন্দ, তিনি নারী নাকি পুরুষ তার ওপরে নয়। কিন্তু আলোচনাগুলো এমনভাবে হচ্ছে, যেন নারী বলেই তাঁরা এরকমটা করছেন, যা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ও মনোনীত হবার ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে হাস্যাস্পদ ব্যাপারে পরিণত করে।
আমরা দেখেছি, সরাসরি নির্বাচনে বিপুল ভোটে পুরুষপ্রার্থীদের পরাজিত করেও অনেক নারী সংসদে এসেছেন, ঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছেন ও করছেন। ফলে ঢালাওভাবে নারী সংসদ সদস্য মাত্রই সংসদে বসবার অযোগ্য, এরকম মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। মোটকথা নারী কি পুরুষ সদস্য যিনিই অসংসদীয় ও নেতিবাচক আচরণ করেন, তা ব্যক্তিগতভাবে কেবল তিনিই করেন, এর দায়দায়িত্বও কাজেই তাঁর নিজের, নারী বা পুরুষ সমাজের নয়। সুতরাং নারী সংসদ সদস্যদের মধ্যে যিনি/যাঁরা সংসদে অশ্লীল শব্দপ্রয়োগ করেছেন ও করছেন, নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন, তাঁদের আচরণের জন্য সংসদের ভিতরের ও বাইরের অন্য নারীদের মাথা হেঁট হয়ে যাবার কিছু নেই। অথচ নারী আন্দোলনেরও অনেকে এরকম অভিমত ব্যক্ত করছেন। আমরা মনে করি, একজন বা কয়েকজন নারীর কৃতকর্মের দায়িত্ব গোটা নারীসমাজের ওপরে বর্তাবার কোনো সংগত যুক্তি নেই; যেমন একজন বা কয়েকজন পুরুষের ব্যর্থতার দায়ও গোটা পুরুষ সমাজের ওপরে বর্তায় না। ব্যক্তির স্খলনকে ব্যক্তির স্খলন হিসেবেই দেখে আমাদের উচিত এই অকার্যকর ব্যবস্থার পেছনে নিহিত মূল সমস্যাটা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করা ও তা নিয়ে কথা বলা।
যাঁরা জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে দুই প্রধান দল ও অন্য দল থেকে মনোনীত হয়ে সংসদে আসেন তাঁদের রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখবার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহের। কারণ এঁরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে আসেন না। এঁদের মনোনীত করেন দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ, যাঁরা নিজেদের দাবি করেন জনস্বার্থে জীবন উৎসর্গকারী হিসেবে। অথচ আজ তাঁদের ভুল মনোনয়নের দায় বহন করতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাই না যে, দেশের বড় দুই দলের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে জানাশোনাসম্পন্ন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাঋদ্ধ ও নারীর সমানাধিকারে বিজ্ঞ নারী ছিলেন না। কাজেই দলসমূহের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সংশ্লিষ্ট দলের সংসদ সদস্যগণ, যাঁরা এই নারীদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন তাঁদের মনোনয়নের যোগ্যতা, অনুসৃত পদ্ধতি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রভৃতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ। কোন ভিত্তিতে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ শিক্ষিত নারীরা সংরক্ষিত আসনের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পেলেন না অথচ অযোগ্য ও অদক্ষরা মনোনীত হয়ে নারীসমাজ ও জনগণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে এ ধরনের শিষ্টাচার-বহির্ভূত আচরণ করবার সুযোগ পাচ্ছেন, তা জানতে চাইবার অধিকার নারীসমাজসহ সকলেরই আছে। মনোনয়নপদ্ধতির এই ঘাপলা নিয়ে কথা না বলে নারীদের ব্যক্তিপটভূমি নিয়ে কথা বলে, নারীরা এলেই এমন হয় জাতীয় দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যর্থতার এই দায় থেকে পার পেতে পারে না।
আমরা উদ্বেগের সাথে দেখছি, বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী আন্দোলনের ফলে নারীর জন্য যে সুযোগগুলো বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে, প্রায়ই তাকে ঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে অপব্যবহার করছে। আর এ ধরনের অপব্যবহারে নারীসমাজকে কেবল নির্দিষ্ট সুযোগের সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতই করা হয় না, বরং নারীর প্রতি জনমত নষ্ট করার সুদূরপ্রসারী অপচেষ্টাও করা হয়, যার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সংকীর্ণতারও যোগ আছে বলে আমরা মনে করি। সুতরাং আমরা বলতে চাই, যে রাজনৈতিক দল এ ধরনের নারীদের সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছে, এ ঘটনার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তাদের, যা এড়াবার কোনো সুযোগ তাদের নেই। পাশাপাশি আমরা মনে করি, এজন্য দায়ী সংসদের হুইপিং সিস্টেমও। জাতীয় সংসদে কার্যকর কোনো হুইপিং সিস্টেম আদৌ আছে কি না, থাকলে হুইপগণ কী দায়িত্ব পালন করছেন, সে প্রশ্নও এখানে উঠিয়ে রাখা দরকার। আমরা মনে করি, দল থেকে পিঠ চাপড়ানো না হলে, হুইপিং সিস্টেম সহায়তা না করলে এঁরা জাতীয় সংসদে অসংসদীয় কার্যকলাপের সুযোগ ও সাহস পেতেন না।
যাঁরা সংসদে অশ্লীল ও অসংসদীয় কথা বলেছেন, নেতিবাচক আচরণ করেছেন, তাঁদের সংসদ থেকে প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট দলগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ করা না হলে আমাদের সন্দেহ থেকে যাবে যে, দল থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই কয়েকজন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের ব্যয়বহুল ও গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনকে অযাচিত বিতর্কের দিকে ঠেলে দিয়ে ব্যর্থ করে দিচ্ছেন।
আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, সংরক্ষিত আসনে মনোনীত সদস্যদের সিংহভাগই নারীর সমানাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠা কিংবা বৃহত্তর জনস্বার্থে সংসদে বা সংসদের বাইরে কোথাওই কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। এ ধরনের বিবেচনা থেকেই নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের একটি চাওয়া হলো সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন। সরাসরি নির্বাচন হলে জনগণ দলগুলোর নির্বাচকমণ্ডলির অপরিণামদর্শিতার কুফল ভোগ করতে বাধ্য না থেকে দেখেশুনে যোগ্য নারীদেরই তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পাঠাতে পারবে। সেরকম ক্ষেত্রে আশা করা যায়, সংসদে এ ধরনের আপত্তিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হবে না। তবে যতদিন আমরা সরাসরি নির্বাচনের দিকে যেতে না পারছি ততদিন সংরক্ষিত আসনের সদস্য মনোনয়নে প্রার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতাকেই যাতে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আমরা আশঙ্কা করি, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অ্যাফারম্যাটিভ অ্যাকশন বা ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি প্রবর্তন ও চালু রাখার কার্যকর কোনো মানেই থাকবে না।
আমরা আশা করব, মনোনয়ক দলের ‘পোষা লাঠিয়াল’ হিসেবে টেবিল চাপড়ানো ও অনাবশ্যক গলা চড়ানো বন্ধ করে সংরক্ষিত আসনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জেনে মনোনীত সংসদ সদস্যগণ নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সমানাধিকার, নারী-পুরুষ সমতা, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে উদ্যোগী হবেন এবং নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের অর্জনকে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকবেন।