Sunday 30 June 2013

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা : রোকেয়া কবীর

সাম্প্রতিক সময়ে ‘ট্রান্সপারেন্সি’ ও ‘অ্যাকাউন্টিবিলিটি’ শব্দ দুটো প্রায়শ বিভিন্নভাবে আমাদের সামনে আসছে। শব্দ দুটোর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। ব্যক্তি জীবন থেকেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরপর পরিবার, সমাজ, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র, সরকার সকল ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একান্ত প্রয়োজন। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু রাষ্ট্র ও সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। রাষ্ট্র ও  সরকারের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে এটা নাগরিক হিসেবে সকলের ন্যায্য প্রত্যাশা ও দাবি। এর মূল উদ্দেশ্য দুর্নীতি কমিয়ে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের ধারা গতিশীল করা। লক্ষণীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বলতে আসলে কী বোঝায় এবং রাষ্ট্র ও সরকার এটা অর্জনই-বা করতে পারে কীভাবে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি আছে।  আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং গণতন্ত্র বলতে বোঝায় সকলের সমান অধিকার, সমান সুযোগ, আইনের কাছে নাগরিকমাত্রের সমান আশ্রয়। অর্থাৎ বৈষম্যহীনতা গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যক শর্ত, যেখানে নাগরিকরা নির্ভয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে ও যেকোনো বৈধ কার্যকলাপ চালাতে পারবে। কিন্তু এই বিষয়গুলোকে আমরা অন্ধের হাতি দেখার মতো করে জানি, শুনি। যে কারণে এ সম্পর্কিত ধারণা জনে জনে ভিন্ন। ব্যক্তির বাইরে প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের মতো করে এ বিষয়গুলোকে ধারণ ও চর্চা করে থাকে।

যে দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, তারা ভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দিয়েছে; কাজেই যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন তারা তাদের মতো করে দেশ শাসন করবে। বড়জোর তারা নির্বাচনী ইশতেহারের কাছে তাদের দায়বদ্ধতার কথা বলে। আবার বিরোধী দল সরকারের কাজের বিরোধিতা করে সরকারের দোষত্রুটি বা ব্যর্থতা বৈধ-অবৈধভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরে সরকারকে ধরাশায়ী করে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় যাওয়াই গণতন্ত্র বলে ধরে নেয়। বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সরব অংশ মনে করে, জনগণের মতামত অনুযায়ীই সরকার দেশ পরিচালনা করবে। প্রথমেই মনে রাখা প্রয়োজন, জনগণ সরকার নির্বাচন করে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা (বা সরকার পরিচালনা) করার জন্য, ‘দেশ শাসন’ করার জন্য নয়-- আমরা আর কারো কলোনি (colony) নই যে কেউ আমাদের শাসন করবে।

এটা ঠিক যে, নির্বাচনী পদ্ধতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের সিংহভাগ নাগরিক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা জোটের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু সিংহভাগ মানে অবশ্যই শতভাগ না। দেশের সকল নাগরিক নির্দিষ্ট একটি দল বা জোটকে ভোট দেয় না। অনেক নাগরিক নির্বাচিত দল বা জোটের বিরুদ্ধেও ভোট দেয়। কিন্তু তবু, যখন নির্বাচিত দল বা জোট সরকার গঠন করে, তখন তারা কেবল তাদের দল বা জোটের সমর্থক বা ভোটারদেরই সরকার হয় না, সরকার হয় দেশের সকল নাগরিকের। সংগত কারণে দেশের সকল নাগরিকই সরকারের কাছে আইনের সমান আশ্রয়/প্রশ্রয় পাবার অধিকারী। এখন প্রশ্ন হলো সকল জনগণ বা সিংহভাগ জনগণের মতানুযায়ী সরকার কীভাবে দেশ চালাবে।

রাষ্ট্রের ১৬ কোটি মানুষের ১ কোটি মত, মোটাদাগে রেখা টানলেও কমপক্ষে ১০০টি মত। কিন্তু ১০০টি মত অনুযায়ী তো দেশ চলে না, চলতে পারে না । রাষ্ট্রকে যেকোনো বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অর্থাৎ একটি মতকে প্রাধান্য দিতে হয়। এই একটি মত কোন মত? অবশ্যই নির্বাচিত দল বা জোটের মনগড়া কোনো মত নয়।

রাষ্ট্রের বা সরকারের মত নির্ধারণ করবার জন্য রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিছু ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো আছে, প্রতিষ্ঠান আছে; যেমন আইনসভা (জাতীয় সংসদ), নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন) ও বিচারবিভাগ। নীতি ও  কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য গাইডিং প্রিন্সিপাল বা পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে আছে রাষ্ট্রের সংবিধান। এই সংবিধানের ভিত্তিতেই প্রণীত হয় আইন, বিধি, উপবিধি, প্রবিধি, কর্মপরিকল্পনা, বাজেট  ইত্যাদি এবং এর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক যেকোনো আইন-বিধি বাতিল হয়ে যায়। 

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ঘোষণার আলোকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী শোষণমুক্ত-বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে  ৩০ লক্ষ শহীদ, ৪ লক্ষাধিক যৌন নির্যাতনের শিকার নারী, ১ কোটি শরণার্থী ও সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি ঋণ বা কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ এই বাংলাদেশ। এরই বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের সংবিধান। এই সংবিধানের আলোকেই আমাদের পথ চলতে হবে। কারণ নীতি ও আদর্শগতভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছে, জাতীয় পতাকা দিয়েছে, জাতীয় সংগীত দিয়েছে, ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়েছে; যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা আইনগতভাবে পেয়েছি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পানীয়জল-স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা ভোগের অধিকার। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেই আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে এ কারণেও যে, আজ আমরা যাঁদের সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ বলে চিনি, যাঁরা রাজনীতিতে আছেন ও ক্ষমতায় যান, সংসদ সদস্য হন, সংসদ নেতা ও উপনেতা হন, বিরোধী দলীয় নেতা ও উপনেতা হন, মন্ত্রী হন, বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, সরকারি-বেসরকারি খাতে যাঁরা উচ্চপদে আসীন, যাঁরা সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে আছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশই এই জীবনের স্বাদ পেতেন না যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা আমাদের সেই বিষয়টিই শিক্ষা দেয়। সুতরাং বৈষয়িক স্বার্থের খাতিরে হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সশ্রদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা তাঁদের প্রত্যেকের ইমানি দায়িত্ব। এর অন্যথা হলে তাঁদের বেঈমান বলে চিহ্নিত করলে যৌক্তিকভাবে কারো আপত্তি করার সুযোগ থাকে না।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে যাঁরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান তাঁদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হলো বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধান অনুযায়ী জনগণই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।” কাজেই নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে এবং যাঁরা বিরোধী দলে থেকে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালনা করায় ভূমিকা রাখবে, তাঁদের প্রত্যেকেরই রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রতি জবাবদিহির বিষয় থেকে যায়। সেজন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই রাষ্ট্রের সার্বভৌম গাইড তথা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হওয়া উচিত, যে ইশতেহারের মাধ্যমে ভোটপ্রার্থী দল নির্বাচিত হলে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে এবং সংবিধানকে রক্ষায় দলটি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বচ্ছ ধারণা দেবে। ক্ষমতায় আসীন হবার পর রাষ্ট্র ও তার জনগণের উন্নয়নের জন্য সরকার যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, সেখানে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু রাখার এখতিয়ার সরকারের নেই। যখন বাজেট ঘোষণা করা হবে তখনো ওই ভিত্তিতেই সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন এবং বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিতকরণসহ সকলের আয়-রুজির ব্যবস্থার দিকে নজর রাখতে হবে। এমনকি যাঁরা বিরোধী দলে থেকে সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করবেন তাঁদেরও করতে হবে ওই একই অবস্থান থেকে। একইভাবে নির্বাচন কমিশন, জাতীয় সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই সংবিধানের প্রতি অনুগত থেকে এবং সংবিধান সমুন্নত রাখায় একই লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। যেমন কোনো রাজনৈতিক দল যদি গণতন্ত্রের অপব্যবহার করে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার মতো অসাংবিধানিক দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে, তবে তাকে সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কিংবা কেউ যদি দেশের কোনো নাগরিকের জন্মস্থান বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন, তা-ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানবিরোধী হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কার্যকরী  ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না-পারায় সংবিধান অনুযায়ী তাদের ভূমিকা পালন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তেমনই জাতীয় সংসদের কার্যক্রমও জনগণকে হতাশ করছে।

গণতন্ত্রে সবারই মতপ্রকাশের অধিকার আছে; কিন্তু নিজের মতকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া বা অন্যের অধিকারকে খর্ব করে এমন মত গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। নাগরিকদের মধ্যে কে আস্তিক কে নাস্তিক, কে নামাজ পড়ে কে পড়ে না, কে ঘোমটা দেয় কে দেয় না এসব দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব না। কেউ ধর্মকর্ম না-করলে, নাস্তিক হলে, তার শাস্তি যদি থাকে তবে সে বিষয়ে যার যার ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা সিদ্ধান্ত নেবেন। সৃষ্টিকর্তা এর জন্য কাউকে পেয়াদা করে পাঠান নি। বড়জোর ধর্মীয় নেতাদের এক্ষেত্রে দায়িত্ব হতে পারে তাদের ধর্মের পথে আহ্বান করা, কিন্তু কোনোভাবে জোর প্রয়োগ করার অধিকার তাদের নেই। তাঁরা যদি এটা মানেন যে, আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান তবে তাঁর ওপরেই এসব বিচারের দায়িত্ব দিয়ে তাদের নিজ নিজ কর্মে মনোনিবেশ করা উচিত। একইভাবে সংবিধান অনুযায়ী সরকারেরও নাগরিকদের ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের ওপরে দায়িত্ব অর্পিত আছে আইন না-মানলে, দুর্নীতি করলে, চুরি-ডাকাতি করলে, বেআইনি কাজ করলে তার বিচার করা ও বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে তার জন্য শাস্তি বিধান করা। যথাযথভাবে এ কাজ করতে সরকার জনগণ ও সংবিধানের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী এ কাজ না-করলে সরকারের কার্যকলাপ দেখভালে নিয়োজিত স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ, বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনসমূহ, বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ ও নাগরিকগণ প্রশ্ন তুলতে পারেন। আইন অনুযায়ী আদালত সরকারের বিরুদ্ধে রুলও জারি করতে পারেন। কিন্তু নাগরিকদের ধর্মকর্মের মতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র, সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল বা যেকোনো পর্যায়ের নাগরিকদের প্রশ্ন তোলা অসাংবিধানিক। আমরা দেখছি এখানে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার চরম ব্যত্যয় ঘটছে এবং নাগরিক সমাজ এখানে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে; যথাযথভাবে সোচ্চার হচ্ছে না।
সুতরাং কোনো রাজনৈতিক দল ধর্মকে ব্যবহার করে দেশের নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সংবিধান অনুযায়ী ওই দলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এরকম কার্যকলাপের রেকর্ড থাকলে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের সুযোগ পাবে না, আর যারা ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, এই মর্মে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালায় শর্ত যুক্ত হওয়া উচিত। 

এ প্রসঙ্গে আরো বলা দরকার যে, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন নারীসমাজের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। যাঁরা এই আসন অলঙ্কৃত করে আছেন, তাঁদের নারী আন্দোলনের কাছে ও নারী আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের নারীসমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা। যদি তা না-করে তাঁরা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেন, তবে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এটা হবে তাঁদের দায়বদ্ধতার অভাব। সেই ক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিতার প্রশ্নও সামনে আনতে হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে কারো এ ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জাতীয় সংসদে তাঁদের সাম্প্রতিক অসংসদীয় কার্যকলাপ নারীসমাজসহ দেশের সকল মানুষকে স্তম্ভিত করছে। নারীসমাজ ও নারী আন্দোলন, সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের দলের লাঠিয়াল হিসেবে দেখতে চায় না। বরং দেখতে চায় তাঁরা জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দেশ, দেশের মানুষ বিশেষ করে নারীসমাজ ও দেশের সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন।   

Monday 27 May 2013

পোশাকশ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা

প্রায় ৬,০০০ পোশাক কারখানা আর ৩৬ লাখ কর্মরত শ্রমিক নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাক শিল্প, শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই যেখানে নারী। কিন্তু কারখানা-মালিক আর শ্রমিকরাই এই খাতের একমাত্র দেশীয় কুশীলব নন। প্রায় ২,০০০ কোটি ডলারের এই খাতের পেছনে সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং নীতিমালা এই খাতে বিগত তিন দশকে বড়ো ভূমিকা পালন করে এসেছে; যা অধিকাংশ সময় আলোচনায় আসে না। এই খাতে জনগণের অর্থে প্রদত্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সুফল এ পর্যন্ত ৩৬ লাখ শ্রমিকের বদলে প্রধানত মালিকদের স্বার্থ রক্ষায়ই ব্যয়িত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া, বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ও অবহেলাজনিত কারণে সবচেয়ে বড়ো-বড়ো দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে পোশাক কারখানাগুলোতেই; যার শিকার হয়েছে এই খাতে কর্মরত শ্রমিক এবং তাদের পরিবার-পরিজনরাই। গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার পাঁচটি পোশাক কারখানার ১১২৭ জন শ্রমিকের প্রাণহানি, কয়েক শত নিখোঁজ এবং আড়াই হাজার গুরুতরভাবে আহত হবার ঘটনা এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন। তাই, আজ শ্রমিকদের মঙ্গলের জন্য করণীয় নির্ধারণের এবং জনগণের অর্থ আরো কার্যকরভাবে ব্যবহারের, বিশেষত মালিকদের পরিবর্তে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজে লাগাবার বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে।

পোশাকশিল্প খাতের অব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকদের প্রতি সরকার ও মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি 

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের সাম্প্রতিক বিকাশের পেছনে সমভাবে অন্যতম ভূমিকা আছে এ খাতে কর্মরত নারী-পুরুষ শ্রমিকদের। দুঃখজনকভাবে এই শ্রমিকদের খুব কম মজুরিতে এবং নিপীড়নমূলক কর্মপরিবেশে কাজ করতে হয়। শ্রমিকস্বার্থ রক্ষায় সরকারি উদাসীনতা, দরকষাকষির জন্য ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিসহ শ্রমিক-মালিক স্বার্থরক্ষায় ভারসাম্যহীন একদেশদর্শী পরিবেশ মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ দেয়ায় শ্রমিকরা জীবনধারণ-উপযোগী ন্যূনতম মজুরি ও সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভয়ানকভাবে। এসব কারণে একতরফা শ্রমিক শোষণের সুযোগ নিয়ে মালিকরা সম্পদের পাহাড় গড়লেও শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তার কোনো উন্নতি হয় নি। গত প্রায় দুই দশকে কয়েকবার মজুরি সমন্বয় করা হলেও মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় আয়ের হিসাবে তাদের শ্রমের দাম প্রকৃতঅর্থে বাড়ে নি। একইভাবে নিশ্চিত হয় নি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম আবাসন, চিকিৎসা, যাতায়াত, নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তার মতো মৌলিক বিষয়গুলোও।

৮০’র দশকে গড়ে ওঠা এ শিল্পে প্রথমবারের মতো ১৯৯৪ সালে শ্রমিকদের জন্য মাত্র ৯৬০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০০৬ সালে তা ১ হাজার ৬৬২ টাকা ও ২০১০ সালে ৩০০০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। সকল ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তিন বছর ধরে এই মজুরিই বহাল রয়েছে। শ্রমিক অধিকার কনসোর্টিয়ামের (ডব্লিউআরসি) তথ্যমতে, এই মজুরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। এখানে শ্রমিকদের গড় মজুরি ঘণ্টাপ্রতি ২৪ সেন্ট, যেখানে পাকিস্তানে বাংলাদেশের দ্বিগুণ ৫২ সেন্ট, কম্বোডিয়ায় ৪৫ সেন্ট, ভিয়েতনামে ৫৩ সেন্ট ও চিনে ১ দশমিক ২৬ ডলার।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যেখানে ‘লিভিং ওয়েজ’কে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে একজন শ্রমিকের মাসে ৩০০০ টাকা বেতন কোনো অবস্থাতেই বর্তমান বাজারে ‘লিভিং ওয়েজ’ বা জীবনধারণ-উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে না। আশার কথা, সাভার দুর্ঘটনার পর অতি সম্প্রতি বর্তমান সরকার নতুন করে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে, যে বোর্ডের সুপারিশ পহেলা মে থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের গ্রুপ বিমা ও ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা রেখে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। আশা করা যায়, এসব বিধান অনতিবিলম্বে কার্যকর করবার ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পোশাক কারখানায় বিদ্যমান অব্যবস্থাপনার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো, দেশের পোশাক কারখানাগুলোর একটা বড়ো অংশই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অমান্য করে নির্মিত আবাসিক ভবনে স্থাপিত, যেখানে জীবনের নিরাপত্তা বিধানকারী সামগ্রী (পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিকল্প সিঁড়ি, সতর্কতা সংকেত প্রদান যন্ত্র, ইত্যাদি) ও ব্যবস্থা (বাধাহীন প্রশস্ত নির্গমন পথ, দৃশ্যমান স্থানে বহির্গমন চিহ্ন, সর্বদা তালামুক্ত গেট, আত্মরক্ষার মহড়া, ইত্যাদি) অংশত বা সম্পূর্ণত অনুপস্থিত। এসবে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মালিকশ্রেণির নির্মম অবহেলাই প্রকাশ পায়। যে কারণে একের পর এক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো দুর্ঘটনায়, তা সে অগ্নিকাণ্ড, অগ্নি আতঙ্ক, বা ভবনধস যাই হোক, ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককেই হতাহত হতে হচ্ছে। এবং দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি এরকম ঘটনায়ই মালিকপক্ষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিচারের আওতার বাইরে থেকে যান। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে মালিকরা বিমাসুবিধা পেলেও আহত ও নিহত শত-সহ¯্র শ্রমিকের জন্য কোনো বিমাসুবিধা থাকে না। প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বড়ো বড়ো বিপর্যয়ের পর মালিকপক্ষের ক্ষতিপূরণ আহত শ্রমিক ও নিহতদের আত্মীয়স্বজন বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও পায় না। যদি কেউ পায়ও সে ক্ষতিপূরণ আন্তর্জাতিক মানদ-ে যথার্থ হওয়া দূরে থাক, যেকোনোভাবে পুনর্বাসনের নিশ্চয়তাটুকুও দেয় না। ফলে বাধ্য হয়ে জনগণের পয়সায় সরকারকেই নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবার উদ্যোগ নিতে হয়। এভাবে মালিকদের গাফিলতির দায়দায়িত্ব-- ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ব্যয়, উদ্ধার কাজের ব্যয়-- সরকার বা জনগণকেই বহন করতে হয়।

জীবনের পাশাপাশি চাকুরির নিরাপত্তাহীনতাও পোশাক কারখানার এক বেদনাকর বাস্তবতা। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র পর্যন্ত দেয়া হয় না। নিয়মিত বেতন ও অতিরিক্ত কাজের পাওনা নিয়ে শ্রমিকরা নিয়মিত হয়রানি ও অনিশ্চয়তার মুখে থাকেন। শ্রমিকদের আবাসন সমস্যা তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা। মাসিক বেতনের সিংহভাগ ব্যয় করে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। উপরন্তু, চলতি বাজার দরের সাথে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কোনো সমন্বয় ছাড়াই তাদেরকে অতিরিক্ত ঘর ভাড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়ের ধকল পোহাতে হয়, যা কার্যত তাদের জীবনমানকে ক্রমশই নিম্নমুখী করে রাখে। অধিকাংশ কারখানায় নারীশ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না; সংবাদসূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় একাধিক অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিক আহত হন, যাদের দুজন দুর্ঘটনাস্থলেই সন্তাব প্রসব করেন। নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে খুব কম পোশাক কারখানাতেই। এছাড়া নারীশ্রমিকদের চলাচলের নিরাপত্তাহীনতাও একটি বড়ো সমস্যা; এজন্য তাদের নিয়মিতভাবে যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণ-হত্যার মতো সহিংসতার শিকার হতে হয়।

এখানে অতি সংক্ষেপে পোশাকশ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে যা বিবৃত হয়েছে, তার সমাধানে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নেয়া পোশাক খাত এবং এখানে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

মালিকপক্ষের প্রতি সরকারি সম্পদ ও সুবিধাপ্রবাহ

পোশাক খাত নিয়ে যেকোনো আলোচনাতেই কারখানা-মালিকরা নিজেদের উদ্যোক্তা ভূমিকাকে বড়ো করে হাজির করে থাকেন। এই খাতে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ সবার অবদানকে খাটো ও অস্বীকার করার জন্য তারা নিয়মিতভাবে সকলকে দোষারোপ করে থাকেন। এই খাতের ভূমিকা ও গুরুত্ববিষয়ক যেকোনো আলোচনায় সাধারণত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি সচেতনভাবে সামনে না-এনে তা এড়িয়ে যাওয়া হয় বা আড়াল করা হয়। বিশেষ-বিশেষ সময়ে, বিরল কিছু গবেষণায়, সরকারি পরিসংখ্যানে এগুলো আচমকা সামনে উঠে আসে। অতি সম্প্রতি পোশাকশিল্প তো বটেই, দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতের সবচেয়ে বড়ো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটার পর, বলা যায় যে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমে ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা’ বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও পরিসংখ্যান এবং গবেষক, সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তা প্রমুখের স্পষ্ট কথাবার্তা সাধারণ মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়েছে (সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদনসমূহ উল্লেখ্য) । দেশ-বিদেশের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যমে  বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এর মালিকদের জীবনযাত্রা, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ প্রভৃতি নিয়ে আলোড়ন তৈরি করা প্রতিবেদন জনসমক্ষে উঠে আসছে।

দেখা যায়, শ্রমিকরা অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হলেই নিজেদের ‘দুরবস্থা’, বিদেশি ষড়যন্ত্র, শ্রমিক অসন্তোষ, অবকাঠামোগত নানা অভিযোগ তুলে মালিকগোষ্ঠী মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মালিকরা প্রায়ই ‘জিরো ক্যাপিটাল’ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে রপ্তানির কাজ পেলে ব্যাংকই পুঁজির ব্যবস্থা করে দেয়; যেমন বিদেশ থেকে কাপড় বা সুতা আনতে অথবা দেশের মধ্য থেকে তা সংগ্রহ করতে ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’ অথবা স্থানীয় ঋণপত্রের অর্থ ব্যাংকই জোগায়। আনুষঙ্গিক উপকরণ (এক্সেসরিজ) আনতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পান পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। আবার ইসিসি বা এক্সপোর্ট ক্যাশ ক্রেডিটের (রপ্তানির জন্য নগদ ঋণ) নামে এলে শ্রমিকের মজুরির অর্থও জোগায় ব্যাংক। ব্যাক টু ব্যাক ও ইসিসির সুদের হার ১৩ শতাংশ। দেশের অন্য কোনো খাতের উদ্যোক্তাদের এই ঋণ নিতে সুদ দিতে হয় অনেক বেশি।

একমাত্র পোশাক খাতের জন্যই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কোনো এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ছাড় দিয়েছে। কেবল তা-ই নয়, পোশাক খাতের ২৭০টি রুগ্ণ শিল্পের আসল ঋণ ও সুদ মওকুফ এবং ঋণকে ব্লক (একটি হিসেবে রেখে) করে রেখে নতুন সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন-- বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-- বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের একতরফা প্রচারণা চালিয়ে সরকারের ওপর সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের এই প্রভাব এবং রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে মালিকরা প্রথম থেকে ‘নীতি-সহায়তা’ নামের আড়ালে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করে আসছে জনগণের করের টাকায়।

বিগত পাঁচ বছরে রপ্তানিমুখী বস্ত্র খাতের মালিকেরা সরকারি কোষাগার থেকে চার হাজার ২১৫ কোটি টাকার নগদ সহায়তা নিয়েছেন। চলতি অর্থবছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, ৯২৩ কোটি দুই লাখ টাকার নগদ সহায়তা নিয়েছেন বস্ত্র ও পোশাক খাতের মালিকেরা। গত অর্থবছরে (২০১১-’১২) এ খাতে ১ হাজার ৪১২ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। এর আগের বছর এ পরিমাণ ছিল ৮৭৭ কোটি ১১ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অর্থকরী খাত সরকারকে যে পরিমাণ কর দেয়, তার দশ ভাগের এক ভাগও পোশাক খাত থেকে সরকার পায় না। পোশাকশিল্প মালিকদের কাছ থেকে সরকার আয়করও পায় অতি সামান্য। অর্থাৎ, উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরাই সবচেয়ে বেশি করসুবিধা পেয়ে থাকেন। রপ্তানির সময় উৎসে কর হিসেবে মাত্র দশমিক ৮ শূন্য শতাংশ দিলেই সব ধরনের কর থেকে দায়মুক্তি পায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি। উৎসে করই চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হয়। গত অর্থবছর পর্যন্ত এই কর হার ছিল দশমিক ৬ শূন্য শতাংশ। তিন বছর আগে এই হার ১ দশমিক ২ শূন্য শতাংশ করার ঘোষণা থাকলেও পোশাকশিল্প মালিকদের চাপের মুখে তা কমানো হয়েছে।

চলতি ২০১২-’১৩ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকপ্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা কর পেয়েছে এনবিআর। আগের পুরো অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে তাঁরা নগদ সহায়তা নিয়েছেন ১ হাজার ৪১২ কোটি সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বিপরীতপক্ষে, এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) নিবন্ধিত দেশের শীর্ষ ও বড়ো ৩৫০টি প্রতিষ্ঠান ও এদের পরিচালকেরা গত অর্থবছরে (২০১১-’১২) মোট ৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। এর আগের অর্থবছরে দিয়েছেন সাত হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।

শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ড-সুবিধাও পায়। অর্থাৎ এই সুবিধার আওতায় প্রয়োজনীয় সুতা, কাপড়সহ কাঁচামাল আনতে কোনো শুল্ক দেন না মালিকেরা। এমনকি তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচ্ছন্ন রপ্তানি খাতগুলোও (প্যাকেজিং, এক্সেসরিজ, ইত্যাদি) এই সুবিধা পায়। এনবিআরের নিজস্ব এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৭-’০৮ থেকে ২০১১-’১২ অর্থবছরের মোট এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বন্ড-সুবিধা নিয়েছে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরা। এর বাইরেও গত তিন দশক ধরেই তৈরি পোশাক খাতকে কর অবকাশ সুবিধা (ট্যাক্স হলিডে) দিয়ে এই শিল্পটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাছাড়া, তৈরি পোশাক খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতি আনতে মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দেন উদ্যোক্তারা, যেখানে অন্য খাতের যন্ত্রপাতি আনতে ৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।

সরকারি কোষাগার থেকে শুধু নগদ সুবিধা, বিবিধ ধরনের কর সুবিধা, শুল্ক মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা ভোগ করেই ক্ষান্ত নয় পোশাক খাত, এরা বৃহদাকারের আর্থিক দুর্নীতির সাথেও যুক্ত রয়েছে। ব্যাংক খাতে বড়ো-বড়ো অনিয়ম-জালিয়াতির বেশির ভাগই করা হয়েছে পোশাক খাতকে দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহার করে। আর সব ক্ষেত্রেই পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক গ্রুপের কেলেঙ্কারি এর শীর্ষস্থানীয় উদাহরণ। এই খাতের বিকাশে বন্ড-সুবিধা চালুর পর, করমুক্ত কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি করে বড়ো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে এ খাতের অনেক মালিকের সংশ্লিষ্টতার কথাও সর্বজনবিদিত।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক পণ্যের বাজার ও ক্রেতাগোষ্ঠীর দায়দায়িত্ব

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের সিংহভাগ ক্রেতা ইউরোপ-আমেরিকার খ্যাতনামা পোশাক ব্রান্ডগুলো, যেগুলোর মধ্যে আছে ওয়াল-মার্ট, প্রাইমার্ক, এইচ অ্যান্ড এম, গ্যাপ, ইন্ডিটেক্স, টেস্কো, ম্যাংগো, জেসি পেনি, হেনস অ্যান্ড মারুইজ, দ্যা চিলড্রেন্স পেন্স, জো ফ্রেশ, বেনেট্টন, সিয়ার্স, প্রভৃতি। রানা প্লাজায় অবস্থিত ৫টি গার্মেন্টস কারখানায়ও মূলত পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ীই পোশাক তৈরি হতো। ‘সস্তা মূল্য, ভালো মান, বিশাল উৎপাদন ও অগ্রিম সেবা’ চাহিদার সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এসব প্রতিষ্ঠানের মূল সুবিধাভোগী তারাই। বাংলাদেশি শ্রমিকদের সস্তা শ্রমে উৎপাদিত এসব পণ্যই তারা উন্নত দেশগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় গড়ে চলেছে। অভিযোগ রয়েছে, পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করার তাগিদ থেকেই রানা প্লাজায় ফাটল ধরা পড়ার পরও শ্রমিকদের জোর করে কারখানার কাজে যেতে বাধ্য করেন এর মালিকেরা। সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহের এই চাপ সবসময়ই মোকাবেলা করতে হয় মালিক-শ্রমিকদের। কাজেই পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিকা- ও ভবনধসে একের পর এক হাজার হাজার শ্রমিকনিধনের দায়দায়িত্ব আন্তর্জাতিক ব্রান্ড মালিক ও পোশাক ক্রেতারাও এড়াতে পারেন না। রানা প্লাজার বেদনাকর ঘটনার পর পৃথিবীব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠবার পর বেশ দেরিতে হলেও কোনো কোনো ব্রান্ড সহানুভূতি জানিয়েছে ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সহানুভূতি ও ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুফল দেবে না, যদি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নিজেদের দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়।

আশার কথা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র উদ্যোগে জেনেভাভিত্তিক ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রিঅল পৃথিবীর বড়ো বড়ো পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে একটা চুক্তিতে আনতে সক্ষম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় আগামি পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও উন্নত করা হবে, যার অর্থ জোগাবে এই কোম্পানিগুলো এবং তত্ত্বাবধান করবে আইএলও। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সামান্য হলেও দায়িত্ববান হতে দেখা গেল। যদিও চুক্তিতে এখনো অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান স্বাক্ষর করে নি। অথচ সকল ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানেরই এক্ষেত্রে দায় অনুভব করা উচিত। বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিসহ আইএলও ও ইন্ডাস্ট্রিঅলের সাথে মিলে সকল ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে এই চুক্তির আওতায় আনবার জন্য ভূমিকা রেখে পোশাক খাতের সকল পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে বলে আমরা মনে করি। তাতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বাজারও হারাবে না, শ্রমিকদের জীবন ও কর্মের অধিকারও রক্ষা পাবে।

পোশাক খাতের মালিক ও শ্রমিকদের অবস্থার এই বিপরীত চিত্র এবং ক্রেতাগোষ্ঠীর দোদুল্যমান ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় নিচের সুপারিশসমূহ তুলে ধরছি :

শ্রমিকদের মজুরি, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, বিমা, রেশন ও অন্যান্য সুবিধা
  1. চলতি বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে এবং প্রতি বছরের মুদ্রাস্ফীতি হারের সাথে সমতা বিধান করে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আইএলও-প্রস্তাবিত ‘লিভিং ওয়েজ’, তথা স্বাভাবিক জীবনধারণ-উপযোগী হওয়া ন্যায়সংগত। মজুরি বোর্ডের ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হওয়া দরকার। 
  2. তৈরি পোশাক খাতে সরকারি সম্পদ ও সুবিধাপ্রবাহ এককভাবে মালিকদের স্বার্থে না-হয়ে সমহারে তা শ্রমিকদের স্বার্থেও ব্যবহার করা দরকার। কারখানা মালিকদের কর, নগদ সহায়তা, শুল্ক রেয়াত, সুদের হার, ঋণ মওকুফ প্রভৃতি খাতে যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়, সকল ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশ কমিয়ে সে অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য আবাসন সুবিধা, হাসপাতাল, শ্রমিকদের আবাসস্থলের কাছে তাদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় প্রভৃতি নির্মাণ করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন।
  3. সকল কারখানায় শ্রমিকদের শ্রম আইন মেনে নিয়োগপত্র প্রদান করা এবং কর্মরত নারীশ্রমিকদের সরকারি বিধানমতো মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করা বাধ্যতমূলক করা দরকার বলে আমরা মনে করি। গর্ভধারণজনিত কারণে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচনা করারও বিধান রাখা দরকার।
  4. পোশাকশ্রমিকরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বাবা-মা-সন্তান পরিজনকে রেখে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাতে মূল্যবান অবদান রাখেন। সেই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং তাদের স্বল্প আয় ও পেছনে ফেলে আসা পরিজনদের কথা বিবেচনা করে সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরের ন্যায় কারখানাবহুল এলাকায় নারীশ্রমিকদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করা দরকার। এসব বাস ব্যবহারকারী নারীশ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেখানো সাপেক্ষে বাসভাড়া অর্ধেক হিসেবে নির্ধারিত হতে পারে। এছাড়া, সাধারণ পরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ সকল পোশাকশ্রমিকের ক্ষেত্রে অর্ধেক ভাড়া চালু করার বিধান করা দরকার। 
  5. সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা ও ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা চালু করবার সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়। আইনটি সংসদে উত্থাপিত হবার আগে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যাচাইবাছাই করে একে আরো যুগোপযোগী করে তোলা ও পাসের পর দ্রুত যথাযথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া দরকার। 
  6. নির্বাচনী অঙ্গীকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার গত বছর ঘোষণা দিয়েছিল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করবার। কিন্তু বিজিএমইএ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দরকষাকষির কারণে আজো তা চালু হয় নি। আমরা মনে করি, বাড়িভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে পোশাকশ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
  7. পোশাক কারখানার ৮০ শতাংশ নারীশ্রমিকের জন্য প্রত্যেক কারখানায় আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও মনিটরিং 
  1. কারখানাগুলোতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে কি না, শ্রম আইনের বিধি-বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, বেতন-ভাতা ও সুযোগসুবিধা দেবার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকে বৈষম্য করা হচ্ছে কি না, কারখানা-অভ্যন্তরে নারীশ্রমিকরা নির্যাতিত হচ্ছে কি না-- সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ের মনিটরিং জোরদার করা ও সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সেজন্য মনিটরিং কমিটিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
  2. মনিটরিং কমিটির ওপরে মালিক শ্রেণির কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকা যৌক্তিক নয়। মনিটরিং কমিটিতে থাকবেন কেবল শ্রমিক, ক্রেতাগোষ্ঠী ও সরকারের প্রতিনিধি; কিন্তু কিছুতেই বিজেএমইএ বা বিকেএমইএ তথা মালিকদের প্রতিনিধি রাখা যাবে না। এই কমিটি মালিকদের কাছ থেকে যাতে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুবিধা নিতে না পারে তা-ও নিশ্চিত করা দরকার। 
  3. মূলত পোশাক খাতকে বিবেচনায় রেখেই জনগণের অর্থে শিল্প পুলিশ নামে আলাদা বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। কার্যত দেখা যাচ্ছে, দুঃখজনকভাবে এই বাহিনী কেবল শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। আজ পর্যন্ত কখনোই এই বাহিনীকে কোনো কারখানামালিকের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে শিল্প পুলিশকে ন্যায়সংগতভাবে মালিকদের অন্যায় প্রতিরোধেও সমভাবে সক্রিয় হওয়া দরকার। এছাড়া শিল্প পুলিশকে নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানেও বিশেষভাবে তৎপর হতে হবে। তারা যাতে মালিকদের পক্ষ হয়ে শ্রমিক নিপীড়নে ব্যবহৃত না হয়, বরং শ্রমিকদের যাতায়াত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে তা নিশ্চিত করা জরুরি। শিল্প পুলিশ যাতে কারখানা মালিকদের গাড়ি ব্যবহার বা মালিকশ্রেণির কাছ থেকে অন্য কোনো সুবিধা নিতে না-পারে সে ব্যবস্থাও করা দরকার। 
দায়দায়িত্ব, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং স্বচ্ছতা
  1. আইএলওর সহায়তায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মেনে ব্যবসা করতে বাধ্য করা উচিত, যাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের জন্য একেকটা মৃত্যুকূপ হয়ে উঠতে না-পারে। তাছাড়া, দুর্ঘটনা ঘটবার পর নিজেদের দায়দায়িত্ব ভুলে বাংলাদেশ থেকে আর পোশাক কিনবে না, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এরকম হুমকি ন্যায়সংগত নয়। বরং তাদের উচিত তাদের জন্য পোশাক সরবরাহকারী কারখানাগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কর্মপরিবেশ উন্নত করা ও শ্রমিকদের ‘লিভিং ওয়েজ’ বিবেচনায় রেখে পোশাকের মূল্য নির্ধারণ করে তা কিনে নেয়া। 
  2. যেসব কারখানা মালিক শ্রমিকদের আবাসন, যাতায়াতের জন্য পরিবহন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিনিয়োগ করবেন, কেবল তাদের ক্ষেত্রেই সরকারি ‘নীতি-সহায়তা’ বা আর্থিক রেয়াত প্রযোজ্য হতে পারে। 
  3. শ্রমিকদের জীবননাশের কারণ হয়েছে, এ যাবৎ সংঘটিত এমন সকল গার্মেন্টস দুর্ঘটনার প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা এবং হতাহতদের আন্তর্জাতিক মানের যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেয়া জরুরি। ক্ষতিপূরণের অর্থের জোগান কিছুতেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে নয়, বরং মালিকপক্ষের মুনাফালব্ধ অর্থে ও ক্রেতাগোষ্ঠীর সহায়তায় পরিশোধ করবার ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
  4. রানা প্লাজার দুঃখজনক শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের পর, আন্তর্জাতিকভাবে পোশাক ক্রেতারা শ্রমিকদের কল্যাণার্থে তহবিল গঠন প্রভৃতির মতো উদ্যোগ নেবার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, কখনোই শ্রমিক কল্যাণ বা তাদের স্বার্থে সক্রিয় ছিল না এমন ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব তহবিলের ব্যাপারে হঠাৎ করে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা এ ধরনের উদ্যোগ ও ওকালতি নিয়ে সন্দিহান। শ্রমিকদের কল্যাণে যেকোনো আন্তর্জাতিক তহবিল স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সরকার-তহবিলদাতা-আইএলও-শ্রমিক সংগঠনগুলোর যৌথ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়া উচিত। এখানে মালিকদের সংগঠনকেও সম্পৃক্ত করা উচিত নয়। মধ্যপ্রাচ্যর একাধিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে প্রত্যাগত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জাতিসংঘ তহবিল যেমন সরকার স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালনা করেছে, এক্ষেত্রেও তা করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
  5. বছরে তৈরি পোশাক খাতে কত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলো, শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ কত ব্যয় হলো, পোশাকশিল্প মালিকরা সরকারকে কত কর দিলেন এবং এই খাতে সরকারকে কত টাকা বিনিয়োগ করতে হলো স্বচ্ছতার স্বার্থে তার বছরওয়ারি হিসাব গণমাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার।

এই প্রবন্ধটি গত ২৭ মে ২০১৩ বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত 'তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় করণীয়' শীর্ষক আলোচনাসভায় মূল আলোচনাপত্র হিসেবে উত্থাপিত হয়।

Monday 20 May 2013

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও হেফাজতে ইসলাম : রোকেয়া কবীর

 মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়; ৩০ লক্ষ শহীদ, ১ কোটি উদ্বাস্তু ও ৪ লক্ষাধিক নারীর ধর্ষণের শিকার হবার ভিতর দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অর্জন করেছি। বাংলার নারী-পুরুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, ১৯৭২-এ তার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান, যে সংবিধান সুস্পষ্টভাবে ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ-লিঙ্গ-জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার সংরক্ষণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ নারী-পুরুষ সমানাধিকার। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম বা অন্য কোনোকিছুর নামে এই অধিকার খর্ব করার কারো কোনোরকম সুযোগ নেই। কারণ, রাজাকার-আলবদর ও কিছু কুলাঙ্গার বাদে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ ও আদিবাসী সম্প্রদায়, তথা জনগণের সকল অংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অশেষ কষ্টের বিনিময়ে এই দেশকে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর কবলমুক্ত করেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই এই বাংলাদেশের জন্ম।
এটা সুবিদিত যে, এই দেশের নারীসমাজের মধ্যে একজনও রাজাকার ছিল না, আলবদর ছিল না। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে একজনও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায় নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরে অংশ নেয়াসহ সকল ফ্রন্টেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের ধকল সয়েছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আজ কোনো প্রতিক্রয়াশীল গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, নারীসমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সকল দিক থেকে ক্রম অগ্রসরমান এই দেশকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে কেউ তাদের সে সুযোগ দেবে না। বরং নারীসমাজসহ সকল জনতা মিলে তাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করবে।

২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করে, যে প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েও গেছে। দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী গণহত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজকারীরা যুদ্ধাপরাধী, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। নারী ও যুবসমাজসহ দেশের আপামর জনগণ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে’-- এই নির্বাচনী অঙ্গীকারের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোটকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। বর্তমানে সরকার সে দায়িত্বই পালন করছে। অবিলম্বে চিহ্নিত সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আদালতের রায় কার্যকর করতে হবে-- এই দাবি আপামর জনগণের, এই দাবি নারীসমাজসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন মতাবলম্বী সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের।

কিন্তু আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, চলমান বিচারপ্রক্রিয়া বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আজ বিভিন্ন অজুহাত তোলা হচ্ছে। সেই অজুহাতের একটি হচ্ছে, ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্যে আরেক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বলছেন যে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নন, তবে বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষী, যে লক্ষ্যে, যে চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই চেতনার বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে দেশকে সামরিক শাসনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে রক্তগঙ্গা বইয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত রাজাকার-আলবদরদের সংগঠক জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে এবং ধর্মকে ঘুষ হিসেবে ব্যবহার করেছে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা জায়েজ করার জন্য। এর মধ্য দিয়েই দেশকে বা দেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে এই সামরিক শাসকরাই। ওই সময়ই কার্যত জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এর দায়ভার জিয়া ও এরশাদের ওপরই বর্তায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার যে বক্তব্য আসছে, সেটি অবান্তর।

নারীসমাজ, আদিবাসী সম্প্রদায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ছাত্রসমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্র জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, জাতীয় শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন নীতি রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করেছে। এসব নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি ও আইনসমূহকে আরো যুগোপযোগী করে তোলার জন্য যখন দেশের মানুষ সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কাজ করছে, তখন চিহ্নিত গোষ্ঠীটি ধর্মকে ব্যবহার করে বারবার এর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে এবং দেশে আবারো পাকিস্তানের আদলে তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে দৃঢ়মূল করতে বিভিন্ন সহিংস পন্থা অবলম্বন করছে। ৭৫-এর পর থেকেই এরা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ও দেশের ভেতরের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মুনাফার অর্থে বিপুল সংখ্যক মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে শক্তি সংহত করে চলেছে। প্রচুর কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে। একই উৎসের সহায়তায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে চলেছে এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তালেবানি ধারাকে আরো বেগবান করেছে। এই গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ক্রমাগত সহিংস প্রসারমান প্রচেষ্টাই বাংলাদেশ থেকে এই পাকিস্তানমার্কা রাজনীতির অবসান ও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে আরো অপরিহার্য করে তুলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন অবসানের পরপরই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে ব্যাপক ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এখন ওই দাবির বাস্তবায়ন চলছে।

বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা একটি বিষয় লক্ষ করছি। আমাদের প্রধান বিরোধী দল, যারা জামায়াতকে আগেই তাদের সরকারের অংশ করেছে, এখন হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ অবলম্বন করে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ হেফাজতকে সমর্থন দেবার জন্য জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্যও রাখছেন। আমরা ৬ এপ্রিলে ঘোষিত হেফাজতের ১৩ দফা দেখেছি, যে দাবি কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষেই মানা সম্ভব নয়। এর পর ৫ মে তাঁরা যে বক্তব্য রেখেছেন, তার প্রায় পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী। এই গোষ্ঠী নারীর সমানাধিকার দূরে থাকুক নারীর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা রাখে না, তা হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের বক্তব্যের একটা অংশ তুলে দিলেই পরিষ্কার হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্বোধন করে তিনি বলেন, “একের পর এক এই বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান আপনি। তাই, অন্তত ২৫টি কোরানের আয়াতবিরোধী সিডও ছনদে স্বাক্ষর করেছেন। নারীনীতি এই দেশে প্রবর্তন করেছেন। পাস করেছেন, আইনে পরিণত করেছেন। আপনি কি জানেন না? এর পরিতাপে বাংলাদেশ হবে জারজের লীলাক্ষেত্র। ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকান আপনার ছেলেরা আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে থাকেন। আপনি ভালো করেই জানেন। আমার থেকে বেশি জানেন, কম জানেন না। সেই দেশের পরিসংখ্যানে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ সন্তান জারজ সন্তান। আপনি বাংলাদেশে সিডও ছনদ আইনকে, সিডওকে আইনে পরিণত করে, কোরানবিরোধী নারীনীতি বাস্তবায়ন/পাস করে বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান। আর এখানে ধোঁয়া তুলেন নারীর অধিকার, নারীর অধিকার। নারীদেরকে বেশ্যা বানাইয়া নারীর অধিকার রক্ষা করা যায় না। নারীর ইজ্জত বেশ্যা বানাইয়া হয় না। নারীর ইজ্জত হয় কুলবধূ, গৃহবধূ বানায়ে। সতীত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতায় নারীর ইজ্জত হয়। সতীত্ব হরণের মাধ্যমে নারীর ইজ্জত রক্ষা হয় না।”

গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার কোনো মানুষ, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র এই ধরনের ঘৃণ্য বক্তব্য (hate speech) সমর্থন করতে পারে না। এই যাদের বক্তব্য, এই যাদের মনমানসিকতা, সেই মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ করতে চায়, তাদের মানসিকতাও কারো কাছে আর অস্পষ্ট থাকে না। তাদের এ ধরনের বক্তব্য প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মকে ব্যবহার করে যারা রাজনীতি করছেন, যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন এবং দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীসহ এদেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীকে দেখছি শোরগোল তুলতে। এমনকি এদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে পৃথিবীব্যাপী মিথ্যা অপপ্রচারের একটা গোয়েবলসীয় মেশিনও চালু করে নিয়েছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যারা নিরন্তর ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে নিরন্তর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, বাসে-সিএনজিতে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে, তাদের পক্ষ অবলম্বন করা কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যৌক্তিক? নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এরা প্রতিনিয়ত যে ঘৃণ্য কার্যক্রম (hate campaign) চালিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো অবস্থায়ই তাদের এই কার্যকলাপ সমর্থনযোগ্য নয়। এজন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাদের সমর্থকদেরও বিচারের আওতায় আসতে হয়।  

লক্ষণীয় যে, এই অপশক্তির অধিকারের পক্ষের সোচ্চার বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার ছাড়া অন্য কোথাও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রসঙ্গ তুলছেন না। তারা কখনো এটা বলেন না যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ধর্মের নামে অন্যের অধিকার, অন্যের মানবাধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কারো নেই। আন্তর্জাতিক নিয়মে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠীটি অন্যের অধিকারের ওপর ন্যূনতম শ্রদ্ধা না-দেখিয়ে তাদের নিজেদের মত অন্য সবার ওপরে চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

এমনকি ৫ মে হেফাজতে ইসলাম যে ৬ শতাধিক কোরান পুড়িয়েছে, তা নিয়েও এই সমালোচক শ্রেণিকে কোনো কথা বলতে দেখি নি। এই বর্বরতা যে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সমর্থনযোগ্য নয়, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায় নি। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন ও করা সমর্থন করেন এমন কোনো সংগঠনকেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখি নি। কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপ যখন ব্যবসা করতে নেমে প্রচুর লোককে ঠকায়, তখন যে ‘বিসমিল্লাহ’র অপমান হয়, এটা নিয়েও এই গোষ্ঠীর কাউকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় নি। অথচ আমেরিকায় যখন একজন কোরান পোড়াবার হুমকি দেয়, তখন আমরা বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এবং মৌলবি সম্প্রদায়কে হৈচৈ করে মাঠে নামতে দেখেছি। কাজেই এরা যে ধর্মের ব্যবহার করে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে, এটা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট।

আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে, রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে, সামাজিক সংগঠন পরিচালনা করতে চাইলে, আইনের আশ্রয় পেতে চাইলে, শাসন ক্ষমতায় যেতে চাইলে তাদের আচার-ব্যবহার-কার্যকলাপ-বক্তব্যও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হতে হবে।  
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা বলতে চাই, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নারীবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তি ও দলের বিরুদ্ধে আপনাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনসহ সকল জায়গায় নারী-পুরুষ সমান অধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ণিত একটি আন্তর্জাতিক মানের নারীনীতি বাংলাদেশের জন্য প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সিডও সনদের ২টি ধারার ওপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অতি সত্বর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

আমাদের দেশে যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেটা মোটেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। তথাকথিত ধর্মশিক্ষার নামে গরিবদের জন্য বর্তমান মানের মাদ্রাসা শিক্ষা চালু রাখা চলবে না। শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষায় বাংলা, অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি পড়াবার ব্যবস্থা করে এই শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। আরবিকে এখানে একটি ভাষা হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থ না-শিখিয়ে শুধু তোতাপাখির মতো মুখস্থ করালে চলবে না। এরকম ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা অর্থ বুঝে সেসব পড়তে পারে। এর ফলে ভুল বুঝিয়ে তাদের সহজে বিপথগামী করা যাবে না। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার সকল পর্যায়ে সংস্কার সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এছাড়া, মাদ্রাসা ও মসজিদ যার টাকায়ই প্রতিষ্ঠিত হোক, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার প্রদত্ত বিনা পয়সার পানি-বিদ্যুৎসহ দেশ-বিদেশের কোন উৎস থেকে বছরে কত টাকা আয় হয় এবং কোন খাতে কত ব্যয় হয়, তার পরিষ্কার হিসেব থাকতে হবে এবং প্রতিবছর তার অডিট হতে হবে। একইভাবে নারী ও দরিদ্র জনগণের জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে, যাতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর ১৫ হাজার মাকে জীবন দিতে না হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পানীয় জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ, যা জিডিপির ৪৬ শতাংশ। উন্নয়নের পথের অন্তরায়গুলো দূর করে একটি সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। গৃহে ও কর্মস্থলে সর্বক্ষেত্রে তাদের কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। প্রতিটি রান্নাঘরে গ্যাস ও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের গার্হস্থ্য কর্মভার লাঘবে উদ্যোগ নিতে হবে।

নারীসমাজ এদেশের শ্রমিক সমাজের সুবিধাদির ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রয়োগ চায়। আমরা জানি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে অহরহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ান, দেশের মানুষকে যেসব জিনিস কিনে খেতে হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা দেন না। আমরা দাবি করছি, শ্রমিকদেরও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বেতন দিতে হবে। কর্মস্থলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে। আইএলও কনভেশন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নারীসমাজের পক্ষ থেকে আমরা জোর দাবি জানাতে চাই। যারা ধর্মকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে রগকাটার রাজনীতি করে, ধর্মকে ব্যবসায়ের হাতিয়ার বানায়, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের ওপরে নির্যাতন-নিষ্পেষণ-জুলুম চালায়, রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি করে, তাদের পেছনে আপনারা অর্থ ঢালবেন না। মডারেট মুসলিম বানিয়ে তুলবার জন্য বিভিন্ন সময় তাদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আপনারা উন্নয়নবিরোধী একটা অপশক্তিকেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। মডারেট মুসলিম বানাবার জন্য চেষ্টা-চরিত্র করে আপনারা একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, নারীর সমান অধিকারবিরোধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারবিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সমান নাগরিকত্বের শিক্ষা তাদের দেন না। বরং পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিয়ে থাকেন, যাতে তারা আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে। এমতাবস্থায়, আপনাদেরও কোনো অধিকার থাকে না বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকারের ব্যবস্থা দাবি করার।

আমাদের দাবি, নারীসমাজ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ শ্রমিক, কৃষক সকলের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সকলের জন্যই এক নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য শুধু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বলেন, সেসব বুদ্ধিজীবী ও ব্যক্তিবর্গের প্রতিও আমরা নারীসমাজের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য রাখতে চাই যে, গণতন্ত্র শুধু কিছু পুরুষের জন্য নয়। গণতান্ত্রিকভাবে সব কাজে সবার সমান অধিকার আছে। কাজেই কারো বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালাবার অধিকার কারো থাকতে পারে না। এতে সমর্থন দেয়া মানে হলো আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। সেক্ষেত্রে এই দেশের নারীসমাজ আপনাদের আর একটুও জায়গা দেবে না, বরং আপনাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে। কারণ আমরা চাই নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ।

সরকারি দল হোক বা বিরোধী দল হোক বা কোনো সামাজিক সংগঠন হোক, ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে ন্যূনতম শর্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর নিচে নেমে কোনো আলাপ-আলোচনা (bargain) বা সমঝোতার সুযোগ কারো নেই।