Showing posts with label নারীনীতি. Show all posts
Showing posts with label নারীনীতি. Show all posts

Monday, 20 May 2013

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও হেফাজতে ইসলাম : রোকেয়া কবীর

 মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়; ৩০ লক্ষ শহীদ, ১ কোটি উদ্বাস্তু ও ৪ লক্ষাধিক নারীর ধর্ষণের শিকার হবার ভিতর দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অর্জন করেছি। বাংলার নারী-পুরুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, ১৯৭২-এ তার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান, যে সংবিধান সুস্পষ্টভাবে ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ-লিঙ্গ-জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার সংরক্ষণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ নারী-পুরুষ সমানাধিকার। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম বা অন্য কোনোকিছুর নামে এই অধিকার খর্ব করার কারো কোনোরকম সুযোগ নেই। কারণ, রাজাকার-আলবদর ও কিছু কুলাঙ্গার বাদে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ ও আদিবাসী সম্প্রদায়, তথা জনগণের সকল অংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অশেষ কষ্টের বিনিময়ে এই দেশকে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর কবলমুক্ত করেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই এই বাংলাদেশের জন্ম।
এটা সুবিদিত যে, এই দেশের নারীসমাজের মধ্যে একজনও রাজাকার ছিল না, আলবদর ছিল না। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে একজনও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায় নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরে অংশ নেয়াসহ সকল ফ্রন্টেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের ধকল সয়েছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আজ কোনো প্রতিক্রয়াশীল গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, নারীসমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সকল দিক থেকে ক্রম অগ্রসরমান এই দেশকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে কেউ তাদের সে সুযোগ দেবে না। বরং নারীসমাজসহ সকল জনতা মিলে তাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করবে।

২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করে, যে প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েও গেছে। দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী গণহত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজকারীরা যুদ্ধাপরাধী, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। নারী ও যুবসমাজসহ দেশের আপামর জনগণ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে’-- এই নির্বাচনী অঙ্গীকারের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোটকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। বর্তমানে সরকার সে দায়িত্বই পালন করছে। অবিলম্বে চিহ্নিত সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আদালতের রায় কার্যকর করতে হবে-- এই দাবি আপামর জনগণের, এই দাবি নারীসমাজসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন মতাবলম্বী সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের।

কিন্তু আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, চলমান বিচারপ্রক্রিয়া বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আজ বিভিন্ন অজুহাত তোলা হচ্ছে। সেই অজুহাতের একটি হচ্ছে, ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্যে আরেক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বলছেন যে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নন, তবে বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষী, যে লক্ষ্যে, যে চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই চেতনার বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে দেশকে সামরিক শাসনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে রক্তগঙ্গা বইয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত রাজাকার-আলবদরদের সংগঠক জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে এবং ধর্মকে ঘুষ হিসেবে ব্যবহার করেছে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা জায়েজ করার জন্য। এর মধ্য দিয়েই দেশকে বা দেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে এই সামরিক শাসকরাই। ওই সময়ই কার্যত জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এর দায়ভার জিয়া ও এরশাদের ওপরই বর্তায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার যে বক্তব্য আসছে, সেটি অবান্তর।

নারীসমাজ, আদিবাসী সম্প্রদায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ছাত্রসমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্র জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, জাতীয় শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন নীতি রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করেছে। এসব নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি ও আইনসমূহকে আরো যুগোপযোগী করে তোলার জন্য যখন দেশের মানুষ সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কাজ করছে, তখন চিহ্নিত গোষ্ঠীটি ধর্মকে ব্যবহার করে বারবার এর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে এবং দেশে আবারো পাকিস্তানের আদলে তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে দৃঢ়মূল করতে বিভিন্ন সহিংস পন্থা অবলম্বন করছে। ৭৫-এর পর থেকেই এরা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ও দেশের ভেতরের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মুনাফার অর্থে বিপুল সংখ্যক মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে শক্তি সংহত করে চলেছে। প্রচুর কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে। একই উৎসের সহায়তায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে চলেছে এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তালেবানি ধারাকে আরো বেগবান করেছে। এই গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ক্রমাগত সহিংস প্রসারমান প্রচেষ্টাই বাংলাদেশ থেকে এই পাকিস্তানমার্কা রাজনীতির অবসান ও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে আরো অপরিহার্য করে তুলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন অবসানের পরপরই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে ব্যাপক ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এখন ওই দাবির বাস্তবায়ন চলছে।

বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা একটি বিষয় লক্ষ করছি। আমাদের প্রধান বিরোধী দল, যারা জামায়াতকে আগেই তাদের সরকারের অংশ করেছে, এখন হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ অবলম্বন করে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ হেফাজতকে সমর্থন দেবার জন্য জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্যও রাখছেন। আমরা ৬ এপ্রিলে ঘোষিত হেফাজতের ১৩ দফা দেখেছি, যে দাবি কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষেই মানা সম্ভব নয়। এর পর ৫ মে তাঁরা যে বক্তব্য রেখেছেন, তার প্রায় পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী। এই গোষ্ঠী নারীর সমানাধিকার দূরে থাকুক নারীর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা রাখে না, তা হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের বক্তব্যের একটা অংশ তুলে দিলেই পরিষ্কার হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্বোধন করে তিনি বলেন, “একের পর এক এই বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান আপনি। তাই, অন্তত ২৫টি কোরানের আয়াতবিরোধী সিডও ছনদে স্বাক্ষর করেছেন। নারীনীতি এই দেশে প্রবর্তন করেছেন। পাস করেছেন, আইনে পরিণত করেছেন। আপনি কি জানেন না? এর পরিতাপে বাংলাদেশ হবে জারজের লীলাক্ষেত্র। ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকান আপনার ছেলেরা আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে থাকেন। আপনি ভালো করেই জানেন। আমার থেকে বেশি জানেন, কম জানেন না। সেই দেশের পরিসংখ্যানে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ সন্তান জারজ সন্তান। আপনি বাংলাদেশে সিডও ছনদ আইনকে, সিডওকে আইনে পরিণত করে, কোরানবিরোধী নারীনীতি বাস্তবায়ন/পাস করে বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান। আর এখানে ধোঁয়া তুলেন নারীর অধিকার, নারীর অধিকার। নারীদেরকে বেশ্যা বানাইয়া নারীর অধিকার রক্ষা করা যায় না। নারীর ইজ্জত বেশ্যা বানাইয়া হয় না। নারীর ইজ্জত হয় কুলবধূ, গৃহবধূ বানায়ে। সতীত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতায় নারীর ইজ্জত হয়। সতীত্ব হরণের মাধ্যমে নারীর ইজ্জত রক্ষা হয় না।”

গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার কোনো মানুষ, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র এই ধরনের ঘৃণ্য বক্তব্য (hate speech) সমর্থন করতে পারে না। এই যাদের বক্তব্য, এই যাদের মনমানসিকতা, সেই মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ করতে চায়, তাদের মানসিকতাও কারো কাছে আর অস্পষ্ট থাকে না। তাদের এ ধরনের বক্তব্য প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মকে ব্যবহার করে যারা রাজনীতি করছেন, যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন এবং দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীসহ এদেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীকে দেখছি শোরগোল তুলতে। এমনকি এদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে পৃথিবীব্যাপী মিথ্যা অপপ্রচারের একটা গোয়েবলসীয় মেশিনও চালু করে নিয়েছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যারা নিরন্তর ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে নিরন্তর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, বাসে-সিএনজিতে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে, তাদের পক্ষ অবলম্বন করা কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যৌক্তিক? নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এরা প্রতিনিয়ত যে ঘৃণ্য কার্যক্রম (hate campaign) চালিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো অবস্থায়ই তাদের এই কার্যকলাপ সমর্থনযোগ্য নয়। এজন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাদের সমর্থকদেরও বিচারের আওতায় আসতে হয়।  

লক্ষণীয় যে, এই অপশক্তির অধিকারের পক্ষের সোচ্চার বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার ছাড়া অন্য কোথাও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রসঙ্গ তুলছেন না। তারা কখনো এটা বলেন না যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ধর্মের নামে অন্যের অধিকার, অন্যের মানবাধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কারো নেই। আন্তর্জাতিক নিয়মে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠীটি অন্যের অধিকারের ওপর ন্যূনতম শ্রদ্ধা না-দেখিয়ে তাদের নিজেদের মত অন্য সবার ওপরে চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

এমনকি ৫ মে হেফাজতে ইসলাম যে ৬ শতাধিক কোরান পুড়িয়েছে, তা নিয়েও এই সমালোচক শ্রেণিকে কোনো কথা বলতে দেখি নি। এই বর্বরতা যে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সমর্থনযোগ্য নয়, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায় নি। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন ও করা সমর্থন করেন এমন কোনো সংগঠনকেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখি নি। কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপ যখন ব্যবসা করতে নেমে প্রচুর লোককে ঠকায়, তখন যে ‘বিসমিল্লাহ’র অপমান হয়, এটা নিয়েও এই গোষ্ঠীর কাউকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় নি। অথচ আমেরিকায় যখন একজন কোরান পোড়াবার হুমকি দেয়, তখন আমরা বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এবং মৌলবি সম্প্রদায়কে হৈচৈ করে মাঠে নামতে দেখেছি। কাজেই এরা যে ধর্মের ব্যবহার করে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে, এটা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট।

আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে, রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে, সামাজিক সংগঠন পরিচালনা করতে চাইলে, আইনের আশ্রয় পেতে চাইলে, শাসন ক্ষমতায় যেতে চাইলে তাদের আচার-ব্যবহার-কার্যকলাপ-বক্তব্যও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হতে হবে।  
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা বলতে চাই, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নারীবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তি ও দলের বিরুদ্ধে আপনাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনসহ সকল জায়গায় নারী-পুরুষ সমান অধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ণিত একটি আন্তর্জাতিক মানের নারীনীতি বাংলাদেশের জন্য প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সিডও সনদের ২টি ধারার ওপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অতি সত্বর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

আমাদের দেশে যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেটা মোটেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। তথাকথিত ধর্মশিক্ষার নামে গরিবদের জন্য বর্তমান মানের মাদ্রাসা শিক্ষা চালু রাখা চলবে না। শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষায় বাংলা, অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি পড়াবার ব্যবস্থা করে এই শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। আরবিকে এখানে একটি ভাষা হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থ না-শিখিয়ে শুধু তোতাপাখির মতো মুখস্থ করালে চলবে না। এরকম ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা অর্থ বুঝে সেসব পড়তে পারে। এর ফলে ভুল বুঝিয়ে তাদের সহজে বিপথগামী করা যাবে না। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার সকল পর্যায়ে সংস্কার সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এছাড়া, মাদ্রাসা ও মসজিদ যার টাকায়ই প্রতিষ্ঠিত হোক, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার প্রদত্ত বিনা পয়সার পানি-বিদ্যুৎসহ দেশ-বিদেশের কোন উৎস থেকে বছরে কত টাকা আয় হয় এবং কোন খাতে কত ব্যয় হয়, তার পরিষ্কার হিসেব থাকতে হবে এবং প্রতিবছর তার অডিট হতে হবে। একইভাবে নারী ও দরিদ্র জনগণের জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে, যাতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর ১৫ হাজার মাকে জীবন দিতে না হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পানীয় জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ, যা জিডিপির ৪৬ শতাংশ। উন্নয়নের পথের অন্তরায়গুলো দূর করে একটি সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। গৃহে ও কর্মস্থলে সর্বক্ষেত্রে তাদের কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। প্রতিটি রান্নাঘরে গ্যাস ও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের গার্হস্থ্য কর্মভার লাঘবে উদ্যোগ নিতে হবে।

নারীসমাজ এদেশের শ্রমিক সমাজের সুবিধাদির ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রয়োগ চায়। আমরা জানি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে অহরহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ান, দেশের মানুষকে যেসব জিনিস কিনে খেতে হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা দেন না। আমরা দাবি করছি, শ্রমিকদেরও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বেতন দিতে হবে। কর্মস্থলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে। আইএলও কনভেশন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নারীসমাজের পক্ষ থেকে আমরা জোর দাবি জানাতে চাই। যারা ধর্মকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে রগকাটার রাজনীতি করে, ধর্মকে ব্যবসায়ের হাতিয়ার বানায়, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের ওপরে নির্যাতন-নিষ্পেষণ-জুলুম চালায়, রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি করে, তাদের পেছনে আপনারা অর্থ ঢালবেন না। মডারেট মুসলিম বানিয়ে তুলবার জন্য বিভিন্ন সময় তাদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আপনারা উন্নয়নবিরোধী একটা অপশক্তিকেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। মডারেট মুসলিম বানাবার জন্য চেষ্টা-চরিত্র করে আপনারা একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, নারীর সমান অধিকারবিরোধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারবিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সমান নাগরিকত্বের শিক্ষা তাদের দেন না। বরং পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিয়ে থাকেন, যাতে তারা আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে। এমতাবস্থায়, আপনাদেরও কোনো অধিকার থাকে না বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকারের ব্যবস্থা দাবি করার।

আমাদের দাবি, নারীসমাজ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ শ্রমিক, কৃষক সকলের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সকলের জন্যই এক নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য শুধু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বলেন, সেসব বুদ্ধিজীবী ও ব্যক্তিবর্গের প্রতিও আমরা নারীসমাজের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য রাখতে চাই যে, গণতন্ত্র শুধু কিছু পুরুষের জন্য নয়। গণতান্ত্রিকভাবে সব কাজে সবার সমান অধিকার আছে। কাজেই কারো বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালাবার অধিকার কারো থাকতে পারে না। এতে সমর্থন দেয়া মানে হলো আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। সেক্ষেত্রে এই দেশের নারীসমাজ আপনাদের আর একটুও জায়গা দেবে না, বরং আপনাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে। কারণ আমরা চাই নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ।

সরকারি দল হোক বা বিরোধী দল হোক বা কোনো সামাজিক সংগঠন হোক, ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে ন্যূনতম শর্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর নিচে নেমে কোনো আলাপ-আলোচনা (bargain) বা সমঝোতার সুযোগ কারো নেই।



Monday, 9 May 2011

নারীর জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন : নয়া উদারবাদী পন্থা নয়, প্রয়োজন পরিষেবা ও নারী অধিকারের প্রসার - ওমর তারেক চৌধুরী

প্রেক্ষাপট : নয়া উদারবাদের হাতে দরিদ্র, নারী ও পরিষেবা খাতের রক্তক্ষরণ

গত শতকের ৮০-র দশক থেকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মতো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মুরুব্বি প্রতিষ্ঠানসমূহ ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ নামে পরিচিত একটি রক্ষণশীল মতাদর্শিক কাঠামোর মাধ্যমে বিশ্বের ঘাড়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছিল। ‘নয়া উদারবাদী’ এই ব্যবস্থায় ‘কাঠামোগত সমন্বয় নীতি’র মাধ্যমে আসলে সামাজিক সেবাখাতে ব্যয় কমাতে এবং জনহিতকর বা কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রমগুলোর বিলুপ্তি সাধনে বাধ্য করা হয়েছে বহু দেশের সরকারকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো ও প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছে নানাভাবে। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর ওপর এর অভিঘাত পড়েছে সবচেয়ে নির্মমভাবে। নয়া উদারবাদী পন্থার অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা বা সরকারি ভূমিকার বিলুপ্তি ঘটানোর শর্ত। নয়া উদারবাদে সরকারসমূহকে বাধ্য করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় খাতের বিলোপ ঘটিয়ে জনগণের সম্পত্তি জলের দরে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিতে; রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নাগরিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিতে; এবং পানীয় জল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গণপরিবহণ, বন্দর, যোগাযোগ ইত্যাদির মতো পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিসগুলোর সেবাদান নিশ্চিত করার বৈশিষ্ট্যের বদলে মুনাফা করার জন্য এই খাতগুলোকে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিতে। এ সবই হচ্ছে এই জনবিরোধী মতাদর্শের আবশ্যিক অঙ্গ। অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প ও কৃষিখাতে আত্মনির্ভরশীলতা নিশ্চিত রাখার বিপরীতে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কর ও শুল্কব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে সরকারগুলোর হাত মোচড়ানো ছিল নয়া উদারবাদী পন্থার প্রধান প্রধান দিক।

এই হাত মোচড়ানোর জন্য চালু করা হয় কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি বা স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (স্যাপ)। সকল ধরনের ঋণ, অনুদান বা কর্মসূচির সঙ্গে স্যাপ-এর বাস্তবায়ন একটি অপরিহার্য শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। প্রথমত, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় দাতাসংস্থার চাপে অবাধ বাণিজ্য বা মূলত আমদানি নীতি উদারীকরণ, রাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়িত্ব খর্ব করা, সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচন, রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া এবং রাষ্ট্রীয় ভরতুকি প্রত্যাহার করার মতো নয়া উদারবাদী নীতি সংস্কারের শর্ত অত্যাবশ্যকীয় করা হয় স্যাপ বাস্তবায়নের জন্য। ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসনের জমানায় বিশ্বব্যাংক ক্রমশ বেশি মাত্রায় এই ধরনের কর্মসূচি নিয়ে স্থান করে নিতে শুরু করে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ প্রায় দুই দশক ধরে প্রত্যক্ষভাবে স্যাপের নিগড়ে থেকে শিল্প, কৃষি, আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো পরিষেবা খাতে প্রচুর রক্তক্ষরণের শিকার হয়। সেই নীতি পরিমণ্ডল থেকে আমাদের সরকারের এখনো বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, দেশ পরিচালনাকারীরাও নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে এর থেকে বের হয়ে আসতে চায় না। মূলত পিআরএসপি বা দ্রারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র ইত্যাদি চটকদার মুখোশের আড়ালে জনবিরোধী নয়া উদারবাদী সেই পন্থা এখনো অনুসৃত হয়ে আসছে সেজন্য।

দেশীয় অর্থনীতি, কৃষি ও শিল্পের ভিত্তি ধ্বংসের উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে, নয়া উদারবাদী পন্থায় স্যাপের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিগত ৯০-এর দশকে শুধু পাটশিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল ৫০ শতাংশ; যা কার্যত এ খাতে নিয়োজিত ঋণের টাকার অপচয় বৈ কিছু নয়। সে সময় বন্ধ করে দেয়া হয় ১৮টি পাটকল এবং ছাঁটাই করা হয় ২০,০০০ শ্রমিককে। নয়া উদারবাদী এই সংস্কার কর্মসূচি পরবর্তী দশকেও অব্যাহত থাকে; যার ফলে বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধ হয়ে গেলে ১৩ হাজারের বেশি দক্ষ শ্রমিক এক ধাক্কায় তাদের জীবনজীবিকা থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়। স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে শ্রমিক পরিবারের সন্তানরা; এই কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পুরো একটি জনপদে কার্যত রাতারাতি ধস নামে নানাভাবে। শুধু একটি শিল্পখাতের ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিককে জীবিকাচ্যুত করার ফলাফল, এসব শ্রমিকের পরিবার, বিশেষ করে নারী সদস্যদের ওপর এর প্রভাবের মাত্রার তীব্রতা আমরা কেবল অনুমান করে নিতে পারি।

বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী হিসেবে একাধিকবার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বেগম মতিয়া চৌধুরী বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন যে, স্যাপের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে বিলুপ্ত করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, ভরতুকি, সম্প্রসারণ সেবার মতো সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করার ফলে কৃষিখাতে উৎপাদনশীলতা থেকে শুরু করে ভেজাল, দুর্নীতি, পরিবেশগত বিপর্যয়ের মতো ক্ষতিকর দিকগুলো এই খাতের সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে। খাদ্যের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে উপেক্ষা করে উর্বর আবাদি জমি বিনষ্ট করার মাধ্যমে রফতানির জন্য চিংড়ি চাষের মতো ক্ষতিকর পন্থাকে উৎসাহিত করে ব্যাপক আকারের পরিবেশ ও সামাজিক বিপর্যয়ের সূচনা করা হয়। এসব প্রবণতার অন্যতম শিকার হয় দেশের দরিদ্র ও নারী জনগোষ্ঠী।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে স্যাপের কারণে। সর্বসাধারণের জন্য প্রচলিত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুনাফার জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত গড়ে তোলার নীতি-পরিবেশ তৈরি করা হয়। শিক্ষাখাতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। এই পর্যায়ে সরকারিভাবে শিক্ষাখাত যে পরিমাণে উপেক্ষিত হয়, তার ফল এখনো বয়ে যেতে হচ্ছে দেশকে। প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে একটি পরিসংখ্যানই হয়ত এই উপেক্ষার তীব্রতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। অতি সম্প্রতি বর্তমান সরকার নতুন ১৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেবার আগে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে সরকারি উদ্যোগে নতুন কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অপরদিকে স্যাপ নীতি-পরামর্শের অধীনে ক্রমাগতভাবে বেসরকারি মালিকানায় পরিকল্পিতভাবে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাদানের দায়িত্ব ছেড়ে দেবার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হলেও এসব ক্ষেত্রে সেবার মান নিশ্চিত করার জন্য সরকারি তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করা হয় নয়া উদারবাদী ভাবধারার সঙ্গে সংগতি রেখে। ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত না-করে ঢালাওভাবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে একদিকে সেবাপ্রাপ্তি যেমন ব্যয়বহুল হয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি গড়ে ওঠেনি জবাবদিহিতার কোনো বাধ্যবাধকতা। সর্বোপরি ক্ষুণ্ন হয়েছে মানুষের অধিকার ভোগ করার বিষয়গুলো। ‘সুশাসন’ কথাটি নয়া উদারবাদের অন্যতম একটি প্রিয় বুলি হলেও, এসব ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রাখাই শ্রেয় বলে বিবেচিত হয় বেসরকারি মালিকানার পৃষ্ঠপোষকতার স্বার্থে। ‘সুশাসন’ কথাটি জমা রাখা হয় কেবল রাষ্ট্রীয় খাতকে ‘অদক্ষ’, ‘অপব্যয়ী,’ ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ইত্যাদিতে অভিহিত করে একটি দানবিক চেহারা দেবার জন্য।

বাংলাদেশে জনবিরোধী নয়া উদারবাদী অর্থনীতির নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ সারসংক্ষেপ করে বলেছেন : ‘...জ্বালানি খাতে জাতীয় সক্ষমতার অবক্ষয় ও বিদেশি মালিকানার সম্প্রসারণ,... আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি, মিল থেকে মলমুখী (শপিং) অর্থনৈতিক তৎপরতার বিস্তার, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ বহু শিল্পকারখানা বন্ধ, বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পানির দামে বিতরণ, রেলওয়ে সংকোচন, দখল ও লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় জনগণের সাধারণ সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর, কৃষিখাতে হাইব্রিড বীজসহ কোম্পানি নির্ভরতা বৃদ্ধি, চোরাই টাকার তৎপরতা বৃদ্ধি, কাজ ও মজুরির নিরাপত্তা সংকোচন, বাণিজ্য ঘাটতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধি এবং নতুন ধনিক শ্রেণির জন্ম ও বিকাশ।’ এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বিষাক্ত ছোবলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রক্তক্ষরণের এবং উন্নয়নের চাকা উলটোদিকে ঘুরিয়ে দেবার মাত্রাটি অনুধাবন করা যেতে পারে।

নয়া উদারবাদের স্থানিক ও বৈশ্বিক চেহারা

উপরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় নয়া উদারবাদের যে চেহারার সামান্য আভাস আমরা পেলাম, সেটি শুধু বাংলাদেশের একক কোনো ছবি নয়। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া এবং বিশেষত একের পর এক সমাজতান্ত্রিক দেশে পটপরিবর্তনের পর নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক মতাদর্শ পরিপূর্ণ শক্তিতে সারা পৃথিবীর ওপরই চেপে বসে নগ্নভাবে। কিন্তু তার আগেই মার্গারেট থ্যাচার ও রোনাল্ড রেগানের জমানায় এর নগ্ন চেহারা দেখা দিতে থাকে ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো দেশগুলিতে। সেই জমানায় এর প্রধান আঘাত নেমে আসে সেখানকার শ্রমজীবী মানুষের ওপর। নয়া উদারবাদ শ্রমজীবী নারী-পুরুষের অবদানকে অস্বীকার করে, তাদের মঙ্গল ও উন্নয়নে সকল ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করার জন্য প্রবর্তন করে ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ নামক মন্ত্র। যার প্রকৃত মানে হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়, শিক্ষা থেকে প্রসূতি সেবা-- সবকিছু ‘মুক্তবাজার’ থেকে কিনে নিতে হবে। নয়া উদারবাদ এই মন্ত্র জপলেও মন্ত্রটি সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে কার্যকর করতে খুবই অনিচ্ছুক। তার ভূরিভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে আমাদের দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার অজুহাত তুলে দেশের বিভিন্ন শিল্পের জন্য ২০০৯-’১০ অর্থবছরের বাজেটে ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় প্রণোদনা প্যাকেজ হিসেবে। সমভাবে ‘২০১০-’১১ অর্থবছরের বাজেটে রফতানি বাণিজ্যে বৈরী অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় ২,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ প্রস্তাব করা হয়েছে।’ এ ধরনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্কের দাবি রাখে অবশ্যই। এর বিপরীতে সংক্ষেপে প্রশ্ন তোলা যায় যে, এসব ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সাধারণ মানুষের অর্থে বহন করা হলেও আর্থিক সহায়তা পাওয়া খাতগুলোর সাধারণ শ্রমজীবী নারী-পুরুষরা কি এই ‘ফ্রি লাঞ্চে’র কোনো হিস্যা পাবেন? তা অবশ্যই পাবেন না। এ ধরনের ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বিতরণ নিয়ে নয়া উদারবাদের প্রবক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই চিন্তিত নয়। তারা তখনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, যখন সরকারি খরচে গরিব মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবার কথা ওঠে, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয় বা নাগরিক সেবার জন্য বিআরটিসির মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কথা বিবেচনা করা হয়।

বৈশ্বিক পরিসরেও এমন অবস্থা বিরাজমান। সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দায় পাশ্চাত্যের দেশগুলির দুর্নীতিপরায়ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ধার করার জন্য সেসব দেশের সাধারণ মানুষের অর্থ বা ‘ফ্রি লাঞ্চ’ একইভাবে ব্যয় করা হয় (গত ডিসেম্বরে শুধু ব্রিটেনের ব্যাংকগুলিকে বাঁচাবার জন্য বরাদ্দ করা হয় ৮৫০০ কোটি পাউন্ড, আমেরিকান কর্মকর্তারা অনুমান করছেন যে
চূড়ান্তভাবে এ খাতে তাদের, প্রকৃতঅর্থে সাধারণ মানুষের, ব্যয় দাঁড়াবে ২৩,০০০,০০০,০০০,০০০ ডলার)। আমেরিকার পাঁচটি মোটরগাড়ি কোম্পানির প্রধানরা ব্যক্তিগত জেট প্লেনে চড়ে (!) মার্কিন কংগ্রেসে হাজির হয়েছিলেন ‘বেইলআউট প্যাকেজ’ নামক ভিক্ষা নেবার জন্য। এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্টের ব্যয় হয়েছে ১,০৭৬,৬৫২,০৭৫,৩২৮ মার্কিন ডলার। বিশেষ করে বিগত তিন দশক ধরে সরকারি ভরতুকির মুণ্ডুপাত করা হলেও সাধারণ মানুষের টাকায় বেসরকারি খাতকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে নয় উদারবাদের প্রবক্তরা ‘ফ্রি লাঞ্চ’-এর প্রবচনটি অবলীলায় ভুলে যেতে কুণ্ঠিত হয় না।

অথচ, ২০০০-এ যখন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হবার সময় ঠিক হয়েছিল যে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলি এমডিজি বাস্তবায়নের জন্য তাদের জাতীয় আয়ের ০.৭০ শতাংশ বরাদ্দ করবে। এক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্র“তি পাওয়া যায়নি। ২০০৮-এ শুধু ডেনমার্ক, লুক্সেমবুর্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও সুইডেন তাদের প্রতিশ্র“তি রক্ষা করেছে এক্ষেত্রে। বর্তমানে এই প্রতিশ্র“তির ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে ০.৩০ শতাংশ। সহায়তাদানের অন্যান্য খাতেও রয়েছে এমন ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতেও বিশ্বব্যাপী সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, নারী ও শিশুর অগ্রগতি, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিছু করতে বিশেষ আগ্রহী নয় নয়া উদারবাদী পন্থার অনুসারী দেশগুলি। সম্ভবত, উত্তর ও দক্ষিণের দেশগুলির জনগণের চাপই তাদেরকে বাধ্য করতে পারে উন্নয়ন খাতে সম্পদ নিয়োজিত করতে।

এমডিজির আবির্ভাব ও রক্তক্ষরণ-শুশ্রূষার সম্ভাবনা

নয়া উদারবাদী ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ যখন ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে বল্গাহীনভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নকে কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সেই সময় নতুন সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণে জাতিসংঘ তাদের বিগত কয়েক দশকের বিভিন্ন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ’সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র ধারণটি নিয়ে এগিয়ে আসে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৫৫তম সভাটি মিলেনিয়াম অ্যাসেমব্লিতে রূপ নেয়। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের ১৫৬টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে ১৮৯টি দেশ সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করে ‘সহস্রাব্দ ঘোষণা’ এবং ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’। পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অসুস্থতা, অক্ষরজ্ঞানহীনতা, পরিবেশের অবক্ষয় এবং নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে, সময়-নির্ধারিত ও পরিমাপযোগ্য উপায়ে আটটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রণীত হয় ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’। ইতঃপূর্বে জাতিসংঘ কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের অধিকার রক্ষাবিষয়ক সনদের চেতনার সাথে সংগতি রেখে প্রণীত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ কিছুমাত্রায় হলেও নয়া উদারবাদী মডেলের সৃষ্ট ক্ষতকে সারাতে অবদান রাখবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে আশা করার কারণ রয়েছে। পনের বছরব্যাপী এই লক্ষ্যমাত্রার দুই-তৃতীয়াংশ সময় অতিক্রান্ত হবার সন্ধিক্ষণে অনেক দেশের ক্ষেত্রেই তেমন লক্ষণাবলি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও আমাদেরকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতির প্রমাণ উপহার দিচ্ছে। নয়া উদারবাদী মতাদর্শের অভিঘাতে জর্জরিত ও তিক্ত অবস্থার সামনে মানব ও সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে এসব অর্জন কিছুটা হলেও স্বস্তির অবস্থা তৈরি করেছে। আটটি লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত যে ১৮টি লক্ষ্যমাত্রা বা টার্গেট অর্জনের (৫০টি পরিমাপযোগ্য সূচক বা ইন্ডিকেটর) জন্য বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ, তার মধ্যে যেগুলিতে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে : ১. চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল (ছয়টি সূচকের মধ্যে তিনটিতে সঠিক পথে ও দুটিতে নেতিবাচক। সকল ক্ষেত্রেই কিছু সূচক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।), ২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন (তিনটি সূচকের মধ্যে একটিতে সঠিক পথে ও একটিতে নেতিবাচক), ৩. নারী-পুরুষ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন (পাঁচটি সূচকের মধ্যে তিনটিতে সঠিক পথে ও দুটিতে নেতিবাচক), ৪. শিশুমৃত্যুহার হ্রাস (তিনটির সূচকের মধ্যে তিনটিতেই সঠিক পথে), ৫. মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন (সাতটি সূচকের তিনটিতে নেতিবাচক, কোনো ইতিবাচক অবস্থা নেই), ৬. এইআইভি/ এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধ (দশটি সূচকের মধ্যে আটটিতে সঠিক পথে), ৭. টেকসই পরিবেশ (দশটি সূচকের মধ্যে তিনটিতে সঠিক পথে ও একটিতে নেতিবাচক)। এই দশ বছরে সহস্রাব্দ লক্ষ্য অর্জনের যে দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো, তা হচ্ছে : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলেশিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবল স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সংখ্যাগত সমতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এবং ১৯৯০ সালের তুলনায় শিশুমৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ হ্রাস করা গিয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এমন ইতিবাচক অর্জন সাধিত হয়েছে এশিয়ার ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, ভুটান, লাওস, নেপাল, চীন, কম্বোডিয়া; আফ্রিকার বতসোয়ানা, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, মালাউই, জাম্বিয়া, ইরিত্রিয়া, মালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সেনেগাল, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, মোজাম্বিক, ইথিওপিয়া, নাইজার, তাঞ্জানিয়া, গায়েনা; উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা ও গুয়াতেমালায়।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে নয়া উদারবাদী কাঠামোর মধ্যেই বা সেই কাঠামোর নৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ না-করেই প্রণীত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন লক্ষমাত্রার (আইডিজি) সাথে এর যেমন সাজুয্য রয়েছে, তেমনি এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে সমন্বয় করার প্রয়াস। এখানে মূল লক্ষণীয় বিষয় হলো এমডিজি মূলত দারিদ্র্য পুনরুৎপাদনকারী, পরিবেশ ধ্বংসকারী, দরিদ্র মানুষের প্রতি বৈরী এবং অন্যায্য নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে নীরব থাকলেও তা কিছু পরিমাণে হলেও দরিদ্রবান্ধব অবস্থান নেয়। উপরন্তু, বিশ্ব পর্যায়ে দারিদ্র্য এবং দারিদ্র্য থেকে সৃষ্ট সমস্যাগুলির প্রতি ব্যাপকভাবে নাগরিক ও জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টিতে লক্ষণীয় অবদান রাখে। যার ফলে নয়া উদারবাদ সৃষ্ট রক্তক্ষরণের কিছুমাত্রায় শুশ্রূষার সুযোগ তৈরি হয়।

কিন্তু, সীমাবদ্ধতাও আছে

বিশ্ব পর্যায়ে সহমতের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক (২০০৫ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বেই দিনে ৭০ টাকার চেয়ে কম উপর্জানকারী ১৪০ কোটি মানুষ) দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর করে স্বাস্থ্যসেবা, জীবনরক্ষা, শিক্ষার উন্নতিকল্পে কতগুলো সর্বজনস্বীকৃত সূচক ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য এমডিজি গৃহীত হয়েছিল। এই সদিচ্ছার মধ্যেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা যে রয়ে গেছে তা অনস্বীকার্য। দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পর, বা এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য যখন আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি আছে, কার্যকর সাফল্য অর্জনের জন্য সেসব সীমাদ্ধতার দিকে ফিরে তাকানো ও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করাই হবে কাঙ্ক্ষিত। এই চেষ্টা হওয়া উচিত দু’পর্যায়েই-- জাতীয় পর্যায়ে এবং ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বরের ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন পর্যালোচনা ২০১০’ শীর্ষ সম্মেলন পর্যায়ে। আরো দীর্ঘমেয়াদিভাবে, এমনকি ২০১৫ সালের পরেও এ নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।

নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ

আটটি এমডিজির মধ্যে মূলত দুটি (৩ ও ৫) লক্ষ্যে সুনির্দিষ্টভাবে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সবকটি লক্ষ্য কার্যকরভাবে অর্জনের জন্য প্রতিটি লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এমডিজির এই সীমাবদ্ধতার সমালোচনা বৈশ্বিক নারী আন্দোলন থেকেও উত্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার না-থাকা, ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারীর যৌন ও প্রজনন অধিকারের অস্বীকৃতি আমাদের নারীসমাজের অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা। এই প্রকাশনায় অন্তর্ভুক্ত গবেষক প্রতিমা পাল-মজুমদারের সমীক্ষায়ও সম্পত্তির ওপর বাংলাদেশের নারীর সমঅধিকার না-থাকা থেকে সৃষ্ট বাধাগুলো অপসারণের গুরুত্বের কথা উঠে এসেছে। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ ঘোষণাতে মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল চুক্তি ও ঘোষণার স্বীকৃতি থাকলেও এমডিজির কোনো সূচকে এগুলোর কোনো প্রতিফলন নেই। এমডিজির কোনো লক্ষ্যেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি লক্ষ্য ও সূচক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আটটি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (দারিদ্র্য দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, শিশুমৃত্যু হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্য, ম্যালেরিয়া বা এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, পরিবেশের স্থায়িত্ব, এবং উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন) ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্যও নারীর অধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা ছাড়া সফলকাম হওয়া সম্ভব নয়। সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করেই কেবল স্থায়িত্বশীল সামাজিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হতে পারে।

নারীর ওপর ধর্মীয় রক্ষণশীলতার আঘাতকে মোকাবিলা করতে হবে

নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত অধিকারসহ অনেক অধিকারের বিষয়ে এমডিজি যে কোনো নির্দেশনা দেয় না তা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। তা না-করার কারণ রয়েছে। নয়া উদারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রসারের যোগসূত্র রয়েছে। এই যোগসূত্রের বিষয়টি উন্নতবিশ্বের দেশগুলোতেও অত্যন্ত স্পষ্ট। সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই নারীর শরীরের ওপর বা তাদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে অধিকারহীনতার বিষয়টি একটি বাস্তব সমস্যা। এসব অনেক দেশেই আজও গর্ভপাত ঘটানোর পর্যাপ্ত সুযোগ ও অধিকার নেই। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় ফিরে আসলে আমরা দেখতে পাব যে, নারীর প্রতি ধর্মীয় রক্ষণশীলতা থেকে উদ্ভূত আঘাত, যেমন, ফতোয়াবাজি, দোররা মারা, সম্পত্তির ওপর সমঅধিকার স্বীকৃত না-হওয়া ইত্যাদি নারীর সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা থেকে আসা আঘাত প্রায়শই এমনকি নারীর প্রতি সহিংসতা ও শারীরিক হুমকি তৈরি করে থাকে। এসব অন্তরায় নিশ্চিতভাবে প্রতিহত করার জন্য এমডিজিতে কোনো লক্ষ্য বা সূচক দৃশ্যমান নয়। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণ রয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রায় দশকব্যাপী বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যখন এমডিজি গৃহীত হয়, তার মধ্যেই বহু দেশের অভ্যন্তরে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের তৎপরতা এবং এমনকি উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশের সরকারের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ডানপন্থী শক্তিগুলোর প্রভাব এবং নয়া উদারবাদী মতাদর্শ অনেক বিষয়ে জাতিসংঘকে পেছনে ঠেলে নিয়ে যায়। নারীর ওপর এসব পশ্চাৎপদ শক্তি বিভিন্ন সময়ে যেসব অপতৎপরতা পরিচালনা করে তা নারীর মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি তার সমতা অর্জন ও ক্ষমতায়নের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাই, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে নারীর মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা দরকার জরুরিভাবে।

নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক মডেলের অন্তর্ভুক্ত থাকা এবং তাকে বৈধতা দেয়া

এমডিজি যে দেশে বাস্তবায়িত হয়, সেখানকার বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার, অর্থাৎ নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার পটভূমিতেই তা রূপলাভ করে। তাই সংগত কারণেই নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির জনবিরোধী নীতির চাপ এর ওপর পড়ে অনিবার্যভাবে। কিন্তু সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক অর্থনৈতিক কাঠামো অপসারণের কথা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলা প্রয়োজন। তাহলেই কেবল সম্ভব হবে এমডিজির সার্থক বাস্তবায়ন। জাতিসংঘ এবং বাস্তবায়নকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে জোরালোভাবে তা না করার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে এটি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মতো নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধানতম প্রবক্তা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এবং তাদের চাপে ও ভাবাদর্শে প্রণীত জনবিরোধী উন্নয়ন নীতিমালাকে জাতিসংঘের মাধ্যমে কর্তৃত্ব ও বৈধতা দান করার সুযোগ পায়।

উত্তরণের জন্য দরকার

কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে টেকসই হতে হলে তাতে নারী ও মেয়েশিশুদের স্বার্থকে সর্বোবিধভাবে রক্ষা করার বিষয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমালার কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য। ‘সহস্রাব্দ ঘোষণা’ গৃহীত হবার সময় সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, কায়রো ও বেইজিং সম্মেলন, সিডও এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারসংক্রান্ত সনদ প্রভৃতির মতো পূর্ববর্তী নানা অভিজ্ঞতা ও আন্দোলনসমূহ থেকে অর্জিত চেতনা ও কর্মপন্থাকে যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’য় নারীর অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলি সেভাবে প্রতিফলিত নয়। দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী ফলাফল অর্জনের চেয়ে এখানে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণ গুরুত্ব পেয়েছে অনেক বেশি।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে, আমাদের সংবিধানে নারীর জন্য সমানাধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলনের বদলে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। উত্তরাধিকারসূত্রে পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার বা ক্ষেত্র বিশেষে অধিকার না-থাকা নারীর জন্য একটি বড়ো বাধা। এটি নারীকে এমনকি অনেক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুবিধা গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত করে এবং নারীর জন্য সামগ্রিকভাবে একটি অবহেলা ও বঞ্চনার আবহ তৈরি করে। এই ধরনের মৌলিক অধিকারগুলি নিশ্চিত না-করে স্বল্পস্থায়ী ইতিবাচক কিছু অর্জিত হতে পারে অবশ্যই। কিন্তু নারীর অবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের জন্য সকল ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে তার অধিকার নিশ্চিত করা একটি জরুরি বিষয়। নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে যা অর্জিত হবে তাই কেবল নারীর স্বাস্থ্যরক্ষা, প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক অধিকার ও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার ভিত রচনা, সহিংসতা দূর করা এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মতো মৌলিক পরিবর্তনগুলোকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে। সেটাই আমাদের কাম্য।

কাজেই, সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত অবশিষ্ট সময়ে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হবে জাতীয়ভাবে নারীর জন্য নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য সকল ধরনের অধিকার আদায়ের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসা। এই কাজটি আন্তর্জাতিক পরিসরেও করা প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একইভাবে সিডও সনদের যে দুটি ধারার ওপর এখনো আমাদের সরকার সংরক্ষণ বজায় রেখেছে, তা তুলে নিয়ে সিডও সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সত্যিকার অর্থেই নারীর সমতা অর্জন ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিকে স্থায়ীভাবে ইতিবাচক রূপ দিতে পারে।

স্থায়িত্বশীল সামাজিক উন্নয়ন, নারীর জন্য সমতাসম্পন্ন পরিবেশ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবান্ধব আর্থ-সামাজিক আবহ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহমর্মী মতাদর্শ ও ভূমিকা সবচেয়ে বড়ো অবদান রাখে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, নয়া উদারবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে নির্মিত রাষ্ট্রীয় ও উন্নয়ন নীতিমালা রাষ্ট্রকে সেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন থেকে সরিয়ে ক্রমশ তাকে জনবিরোধী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন উদ্যোগের সেবকে পরিণত করে। এর ফলে সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের উদ্যোগগুলোর জন্য একটি বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়। অর্জিত উন্নয়ন সাফল্যগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে।

তাই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সাফল্যগুলোকে ধরে রাখতে হলে নয়া উদারবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সকল নীতি ও কার্যক্রমকে প্রত্যাখান করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। নারীর সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরেও আমাদেরকে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নেবার জন্য সোচ্চার হতে হবে।

নোট

১. এসব শিল্পকারখানার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নিবন্ধকারে কাছে কোনো তথ্য নেই।

২. জেনারেল মোটর্স, ফোর্ড ও ক্রাইসলার কোম্পানির তিন নির্বাহী প্রধানই ডেট্রয়েট থেকে ৫২৬ মাইল দূরত্বে অবস্থিত ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের কোম্পানি তিনটির জন্য উদ্ধার-প্যাকেজ সংক্রান্ত মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে বিলাসবহুল পৃথক জেট প্লেনে করে হাজির হয়ে সারা দুনিয়ায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠেন। জিএম এর নির্বাহীর বিলাসবহুল উড়োজাহাজটির মূল্য ছিল ৩৬ মিলিয়ন ডলার। গাড়িতে এই দূরত্ব যাবার জন্য খরচ হয় ৮০ ডলারের পেট্রোল।

৩. সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যকে সঠিক প্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে হলে মনে রাখতে হবে যে, এই উদ্যোগটি দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর কাছ থেকে আসেনি। উদ্যোগটি মূলত সামনে ঠেলে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপান এবং সাথে ছিল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়নবিষয়ক সংগঠন (ওইসিডি)। এই সংশ্লিষ্টতা থেকে প্রশ্ন ওঠে যে উদ্যোগটি কী মূলত নয়া-উদারবাদী আদর্শিক বিষয়কে ঢাকার উদ্যোগ কিনা। এই নিবন্ধে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে, অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে বা প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে; যা নিবন্ধটি ও লেখকের সীমাবদ্ধতা। বাস্তবসম্মত পর্যালোচনার জন্য সামির আমিন লিখিত The Millennium Development Goals: A Critique from the South (মান্থলি রিভিউ। মার্চ ২০০৬) শীর্ষক নিবন্ধটি দেখা যেতে পারে।

সহায়ক সূত্র

  1. Bangladesh Experience with Structural Adjustment by Dr. Debapriya Bahttacharya and Rashed Al Tituumir. SAPRI, Bangladesh.
  2. Structural Adjustment: The SAPRI Report. Zed Books, London
  3. ÔDbœqb `k©b I eiv‡Ïi duvwKÕ| Avby gynv¤§`| cÖ_g Av‡jv, 22 Ryb 2010
  4. http://www.radiofeminista.net/julio05/notas/mdg-ing.htm
  5. http://www.awid.org/eng/Issues-and-Analysis/Library/MDG-Goals-Panned-for-Isolating-Women-s-Rights
  6. Millennium Development Goals: At a Glance. UN Department of Public Information. Updated April 2010.
  7. Factsheet: Where are the Gaps. www.un.org/esa/policy/mdggap

ওমর তারেক চৌধুরীর পাতা

    Monday, 2 May 2011

    জাতীয় নারী উনয়ন নীতি ও ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা : রোকেয়া কবীর

    বাংলাদেশের বয়স ৪০ বৎসর পূর্ণ হলো। বহুবিধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চড়াই-উৎরাই অতিক্রমের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে আসা এই দেশে দীর্ঘ নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭-এ সর্বপ্রথম এ দেশের নারীসমাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একটি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০৪-এ তদানীন্তন সরকার ঘোষিত এই নীতির হাত-পা ভেঙ্গে খোঁড়া করে ফেলে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের বিষয়ে যেসব অঙ্গীকার ব্যক্ত রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৯৭-এ নারীনীতি ঘোষিত হয়েছিল। সেই সমঅধিকারের বিষয়গুলো ঘোষিত নীতি থেকে ছেঁটে ফেলা হয় গত জোট সরকারের আমলে।

     
    ১৯৯৭-এর নারীনীতি পুনর্বহালের দাবিতে নারীসমাজ পুনরায় সংগ্রামে নামে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার আশ্বাস দিলেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকির মুখে এটাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা না করে হিমঘরে তুলে রাখে। বর্তমান সরকার বিপুল ভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এলে নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে নারীসমাজের পক্ষ থেকে একই দাবি তোলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ৮ মার্চ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা করেন। ঘোষিত এই নীতিতে সরকার ‘অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’র কথা বলেছেন। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি ‘উত্তরাধিকারে সমঅধিকার’ থেকে সরকার যদিও সরে দাঁড়িয়েছে, তবু কিছু কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এই নারীনীতিকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।

    নারী আন্দোলনের অনেকেই উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার ব্যপারটায় সন্তুষ্ট হন নি; এই জন্য যে, সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার ও সমানাধিকারের যে বিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ২০১১-এর নারীনীতি তার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশেষ করে উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার প্রসঙ্গটা। এর ফলে যে শুধু নারী-পুরুষ ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য হবে তা নয়, বরং বিভিন্ন ধর্মের নারীদের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। কারণ বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইনে নারীর অংশে বিভিন্নতা রয়েছে। তার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের উত্তরাধিকারে কোনো অংশই নেই। এর পরও নারী আন্দোলন মনে করে, ঘোষিত ২০১১-এর নারীনীতিতে উত্তরাধিকারে নারীকে সমঅধিকার না দিলেও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য যেটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পদক্ষেপ, নতুন আইন বিশেষ করে বিভিন্ন সূত্রে অর্জিত সম্পদ ও সম্পত্তিতে অধিকার ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরিভাবে প্রয়োজন। এই নীতি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা এখন অন্যতম প্রধান কাজ।

    সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি, যারা এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোরহস্তে গ্রহণ করতে হবে। ধর্মের/ইসলামের অজুহাতে যে গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করছে তাদের পরিচয় নূতন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের পরিচয় জাতির কাছে স্পষ্ট। যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন যে,
    • মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গোষ্ঠীই লাখ লাখ নারী ধর্ষণ, ত্রিশ লাখ মানুষ নিধন এবং বাংলাদেশের তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটিকেই ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছিল।
    • এই গোষ্ঠী কখনোই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এ দেশীয় রাজাকারদের এহেন মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধকে ইসলামবিরোধী বলেছেন বলে কেউ শোনে নি।
    • ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনের পর অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু এ ধরনের জঘন্য অপরাধ যে ইসলামবিরোধী এই কথা কখনো তাদের কেউ উচ্চারণও করেন নি।
    • এখনো অনেক নারী ধর্ষিত হচ্ছেন, বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এগুলো যে ইসলামবিরোধী কাজ সে সম্পর্কে কখনো তারা কোনো উচ্চবাচ্য করছেন না।
    • তারা পাহাড়সমান দুর্নীতি আর মুনাফা লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন না, বলছেন না যে এগুলো ইসলামবিরোধী। এর বিরুদ্ধে তারা মাঠেও নামছেন না।
    • ছোটবেলায় ফতোয়া শুনেছি, ছবি তোলা, মাইকে আজান দেয়া ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কাজ, এখন তারা ওই কাজগুলো হরহামেশাই করছেন দেখতে পাই।
    • কয়েকদিন আগেই পত্রিকায় দেখা গেল, সৌদি সরকার ঘোষণা দিয়েছে বিক্ষোভ ও সরকারবিরোধী আন্দোলন ইসলামবিরোধী। তারা এ সম্পর্কেও কিছু বলছেন না।
     সুতরাং কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, তারা হরহামেশা ইসলামকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটারই চেষ্টা করে চলেছেন এবং এরাই এবার ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’কে কেন্দ্র করে মাঠ গরম করতে চাইছেন। 
    নারীনীতি বাস্তবায়নের  দাবিতে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি আয়োজিত গণজমায়েতে অংশগ্রহণকারী বিএনপিএস দলসদস্যদের একাংশ
    জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর যে অংশটি নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন (নারীনীতির অনুচ্ছেদ ২৫ এর ২৫.২ উপ-অনুচ্ছেদের হুবহু ভাষ্য : ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’)। এখানে উত্তরাধিকারে সমানাধিকারের কথা কোথাও বলা হয় নি; বলা হয়েছে, উল্লিখিত বিভিন্ন সূত্রে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার’ প্রদানের কথা। অথচ অনর্থকই তারা ‘কোরানবিরোধী আইন করা হচ্ছে’ গুজবে বিশ্বাস করে নানারকম হুমকি-ধামকি দিয়ে চলেছেন। কানে হাত না দিয়ে কান নিয়েছে অজুহাতে চিলের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া একে আর কী বলা যায়!

    দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার দলীয় অনেককেও (পুরুষ) বলতে শোনা যায়, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরুর প্রাক্কালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ঘোষণা দিয়ে উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তারা ‘ভোট’-এর রাজনীতির কথা চিন্তা করে হয়তো কথাটি বলছেন। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভোটারদের অর্ধেক নারী। বর্তমানে নারী নির্যাতনের যেসব নৃশংস পন্থা প্রয়োগের খবর পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, তার মৌলিক প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা; যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীর অধস্তন অবস্থা তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করে এবং নারীকে পরিবারের (বাবা বা স্বামীর) বোঝা হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই মানসিকতাই নারীকে অক্ষম ও দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবার, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে নির্যাতন বা আক্রমণের সহজ টার্গেটে পরিণত করে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে কেবল নির্যাতনবিরোধী আইন তৈরি ও তার প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, বরং এর উৎসভূমিতে আমাদের হাত দিতে হবে; অর্থাৎ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

    নারী নির্যাতন ছাড়াও নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার রয়েছে আর্থ-সামাজিক আরো নানা কুফল। যেমন যারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য বা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন তাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, উত্তরাধিকার ও সম্পদে মেয়েসন্তানের সমঅধিকার এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকায় পরিবারপ্রতি ‘দুই সন্তান’ নীতিটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। দুই সন্তান মেয়ে হলে কেবল পুত্রের আশায় পরিবারপ্রতি সন্তানের সংখ্যা কখনো কখনো সাত-আটজনকেও ছাড়িয়ে যায়! শুধু তাই নয়, কেন পুত্রসন্তান জন্ম দিতে পারে না সে কারণে পরিবারে স্ত্রীর ওপর নানামাত্রার নির্যাতনের খড়্গও নেমে আসে, যদিও শিশু মেয়ে কী ছেলে হবে তা নির্ধারণের দায়দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। এ ছাড়াও এর ফলে আরেকটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়-- কন্যাসন্তান যখন হয় কোনো পিতামাতার একমাত্র সন্তান, তখন ওই পরিবারের সম্পদের ওপর আত্মীয়স্বজন উত্তরাধিকার দাবি করে থাকে, যা প্রায়শই পারিবারিক-সামাজিক কলহ, হত্যা, মামলা পর্যন্ত গড়ায়। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখি এবং আইনজীবীদের কাছ থেকেও এই অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য মেলে।

    সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যদি আমরা গণতন্ত্র দেখতে চাই, তা হলে পরিবারে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ মানুষের আচার-আচরণ বিষয়ক শিক্ষাটা পরিবার থেকেই শুরু হয়। এই অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী আচার-আচরণ ওসব পরিবারের সদস্যরা সর্বত্রই প্রয়োগ করেন, তা তিনি রাজনৈতিক দল বা আমলাতন্ত্র বা যেকোনো পেশায়ই যান না কেন। পরিবারে গণতন্ত্র তখনি সম্ভব যখন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে, নারীও পরিবারের সম্পদের সমান ভাগিদার হবে ও সেই সম্পদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।

    আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধানে প্রদত্ত সকল নাগরিকের সমানাধিকারের প্রসঙ্গ এ আলোচনায় মুখ্যই থেকে যায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নের মূল ফলশ্রুতি একই-- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন।