Monday, 5 October 2020

বিচারহীনতা ও সামাজিক সংস্কৃতির মৌনতা : অব্যাহত নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন : রোকেয়া কবীর

ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানির খবরে প্রতিদিনকার পত্র-পত্রিকাই সয়লাব থাকে। এসব খবরের কিছু নমুনা, যেমন বৃদ্ধ কর্তৃক শিশু ধর্ষণ, প্রেমিক কর্তৃক ধর্ষণ, ডাক্তার কর্তৃক রোগী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, অফিসের বস কর্তৃক সহকর্মীকে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ, গাড়িচালক ও কন্ডাক্টর কর্তৃক নারী যাত্রী ধর্ষণ। আমরা উদ্বেগজনকভাবে দেখছি ছাত্রীর ধর্ষক হয়ে উঠছে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গীর্জার পাদরী। এমনকি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-পরিজন তথা দুলাভাই, বাবা, চাচা, মামা, শ্বশুর, দেবর, ভাসুরের লালসার হাত থেকেও নারী ও শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের কর্মী ও বিভিন্ন কিশোর গ্যাং, শ্রমিক সংগঠনের কর্মী— কে নয় এই ধর্ষণযজ্ঞে শরিক? এ যেন ঠগ বাছতে গা উজাড় হবার জোগাড়। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন এতিমখানা, মাদ্রাসা ও হোস্টেলে বাচ্চা ছেলেদের উপর বলাৎকার। তবে আজকের এই লেখা নারীর উপর ধর্ষণ ও হয়রানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। 

সবাই জানে, যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার সবটাই সংবাদ হয় না। অর্থাৎ পত্র-পত্রিকায় আমরা যেসব সংবাদ দেখি, তা সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার একটা অংশ মাত্র। সাধারণত মামলা হলেই ঘটনার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় আসে। অথবা পত্র-পত্রিকায় আসলে মামলা হয় এবং পুলিশ প্রশাসন একটু তৎপর হয়। কিন্তু সব ধর্ষণ ঘটনায় মামলা হয় না, কারণ মামলা করায় অনেক ঝামেলা। মামলা চলাকালীন ভিকটিম নারীকেই জেরার নামে যেভাবে হেনস্থা করা হয় তার জন্যও অনেকে মামলার ঝামেলায় যেতে চান না। তা ছাড়া মামলা করেও অনেক ভিকটিম বিচার পায় না ও বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করে। অনেক সময় প্রভাবশালীরা সালিশের নামে ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, ভিকটিমকে কলংকের ভয় দেখিয়ে সালিশের মাধ্যমে ঘটনার নিষ্পত্তি করে। ধর্ষকের বিচার না করে সালিশ-এর মাধ্যমে সমঝোতা বা ধর্ষক-এর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে, অনেক সময় এই অপমান সইতে না পেরে ভিকটিম আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

ধর্ষণ ঘটনায় প্রায়ই সবকিছু ছাপিয়ে ঘটা করে ভিকটিম নারী বা মেয়েটি কী ধরনের পোশাক পরেছিল, কীভাবে চলাফেরা করত, কোথায়-কোথায় যেত, তার ছেলেবন্ধু ছিল কি না, রাতে বাইরে বের হতো কি না, সিগারেট খেত কি না ইত্যাদি আলোচনা প্রাধান্য পায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ধর্ষণ ঘটনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা, যেন কেউ আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে, স্বাধীনভাবে  চলাফেরা করলে, ছেলেবন্ধু থাকলে বা রাতে বাইরে বেরোলে ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়। এমনকি আমরা দেখি, কোনো অপরাধ করে যদি কোনো নারী বিচারে সোপর্দ হয়, সেখানেও অপরাধ-এর চাইতে সবার কাছে অভিযুক্ত নারীর পরিধেয় ও জীবনাচরণই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও অনেক সময় এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং বিকৃত মানসিকতার এসব ব্যক্তিদের কৌতূহলের খোরাক জুগিয়ে চলে।    

এরকম বাস্তবতায় প্রায় সব মহলে আলোচনায় উঠে আসে যে ধর্ষকের কঠোর বিচার হয় না বলেই এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাহলে সৌদি আরবে কঠোর শাস্তি শিরচ্ছেদ-এর পরও আমাদের নারীকর্মীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে দেশে ফিরত না। একথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবিধানে দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এটা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির একটা বড় কারণ। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রশ্রয়, যখন যে ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নাম ব্যবহার বা তাদের আশ্রয় ও প্রশাসনের আশ্রয় বা নির্লিপ্ততা ইত্যাদিও আরেক বড় কারণ। তবে আমরা অনেকেই জানি, কেবল কঠোর বিচার দিয়েই ধর্ষণ থামানো যাবে না। কারণ ধর্ষণের অন্যতম মূল কারণ আমাদের সমাজ মানসিকতা। যে মানসিকতায় নারীকে মর্যাদাশীল মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না, ভোগের সামগ্রী হিসাবে দেখা হয়। এর মূলে রয়েছে পুরুষের সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ— পরিবার, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সব সংগঠন, ধর্মীয় সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ। এই আধিপত্যবাদ সমাজ, সংস্কৃতি ও মনোজগতে এমন ভাবনা সৃষ্টি করেছে যে পুরুষ যা চায় তা পাওয়ার অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। সেটা অধস্তন হিসেবে নারী জোগাতে বাধ্য। সেটা বিকৃত যৌনক্ষুধা বা অন্য যে কোনো সেবাই হোক না কেন। এর একটা উদাহরণ স্বৈরাচারী এরশাদ-এর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন নারীর সঙ্গে যে সম্পর্ক সে খবরে তখনকার গণমাধ্যম সয়লাব ছিল। ঐ সময়ে নির্বাচনে রংপুরে তার পক্ষের মিছিলের জোয়ারে একজন সাংবাদিক এক নারীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এরশাদের এই চরিত্রের কথা জেনেও আপনারা তাকে ভোট দেবেন? উত্তর ছিল— “এরশাদ আমাগো রংপুরের ছাওয়াল। ছাওয়াল গো এ রকমের অভ্যাস থাকেই, এটা দোষের কিছু নয়”। এবং এই মাসসিকতায়ই বাস বা টেম্পোর হেল্পার পর্যন্ত নারীদের গায়ে অবলীলায় হাত চালায় এবং অন্য যাত্রীরা তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে না, এটাকে গ্রহণও করে। তা না হলে সামান্য ঘটনায় তথাকথিত “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” লেগেছে এই অজুহাতে যেখানে হাজার হাজার লোক নিমেষেই রাস্তায় নেমে পড়তে পারে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করার জন্য, সেখানে সিলেট এমসি কলেজের ঘটনায় কেন মানুষ এগিয়ে এল না? এর প্রধান কারণ একটাই— নারীকে মানুষ না ভাবা, সমান নাগরিক হিসাবে তার সমমর্যাদা অস্বীকার করা থেকেই এই অবস্থার সৃষ্টি। 

সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানেও যে প্রবণতা কাজ করে তা হলো একজন নারী একজন পুরুষ একসাথে দেখলেই তাদের সম্পর্কের প্রতি অনাবশ্যক কৌতূহল। এবং তথাকথিত অনৈতিকতার এই  মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে, অনৈতিকতার অজুহাত দাঁড় করিয়ে ধর্ষণের তথাকথিত যৌক্তিকতা দাঁড় করানো। খবরে প্রকাশ, ঘটনার শিকার নারী তার স্বামীর সাথে নিজেদের গাড়িতে করে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সিলেটের টিলাগড়ে অবস্থিত এমসি কলেজে গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারা কিছু কেনার জন্য নেমেছিলেন। সেখানে এসে অভিযুক্ত ধর্ষকরা অনাবশ্যকভাবে তারা স্বামী-স্ত্রী কিনা এই  প্রশ্ন করে ও স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন মিলে ওই নারীকে জোর করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

প্রশ্ন হলো দুজন নারী-পুরুষ একত্র কোথাও বেড়াতে গেলে বা বাইরে বেরোলে তাকে কেউ এরকম জেরা করতে পারে কি না? সে অধিকার কারো নেই। দুজন নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা বা বন্ধু যাই হোক, তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা বা হয়রানি করার কোনো  অধিকার কারো নেই। এমন হয়রানি পুলিশরাও মাঝে মাঝে করে থাকে, দুজন ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলে এ ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করে এবং টাকা আদায় করে। এমনকি পুলিশ সদস্যদের এরকম অপতৎপরতা আমরা প্রায়ই দেখি পার্কে, নদী তীরে ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। আইনের লোক হয়ে পুলিশের এরকম বেআইনি তৎপরতা সাধারণ মানুষকেও এসবে উৎসাহিত করে। পুলিশ সদস্যদের তৎপর হওয়া আইনত যে সমস্ত ঘটনায় দরকার এরকম অজস্র ঘটনা সবসময় চারপাশে ঘটছে। কিন্তু সেসব ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। তাদের চোখের সামনে দিয়ে খুন, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা ও দুর্নীতির আসামি ঘুরে বেড়ায়। সব মানুষ তাদের দেখতে পায় কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। সাধারণ নাগরিকদেরও করবার মতো অনেক কাজ আছে, কিন্তু তারা সেসব করে না। যেমন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের পাশের আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দার বরাতে জানা যায়, রাতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু তারা সেখানে এগিয়ে আসেনি। আবাসিক এলাকার লোকজন দলবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে হয়ত ওই নারী ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেত। তাই পরিবার, সমাজ, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নারীকে সমান চোখে দেখতে পারার যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বা চিন্তাধারা তা ছড়িয়ে দিতে হবে। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। আর এখানে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারা যদি এই ধর্ষকদের তাদের নাম ভাঙাতে না দেয় এবং এই সমস্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে কাজ করেন, তখন সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তখন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং এ সমস্ত ঘটনা কমে আসবে। তাহলেই আমাদের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল হবে।

করোনার হাতি হয়ে ওঠার গল্প : রোকেয়া কবীর

করোনাভাইরাস-এর আবির্ভাব গত ডিসেম্বর থেকে চীনে শুরু হলেও সারা পৃথিবীতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় মূলত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে। বাংলাদেশে বলতে গেলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মিডিয়ায় এর ওপর রিপোর্টিং সবার চোখে পড়ার মতো করে আসতে থাকে। ভাইরাসটির আকার এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তা দেখতে অত্যন্ত শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। তা এ হেন অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নস্যি কণা— যা ধূলিকণারও অধম আকারের দিক থেকে, সে কীভাবে হাতি হয়!

জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, কোরিয়া, এমনকি কিউবা, ব্রাজিল, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাইরোলজিস্ট, ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানি থেকে শুরু করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) সবার থেকে এই ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায়, মানুষকে কীভাবে কাবু করে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে অনেক নির্দেশনা, অনেক গবেষণার ফলাফল আমরা এই যুগের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনই পাচ্ছি। এত ধরনের মতামত এসেছে যে প্রায় সময়ই দেখা যাচ্ছে একজনের মতের সঙ্গে অন্যের অভিমত মিলছে না। এমনকি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হু যে স্বাস্থ্য নির্দেশনা দিয়েছে, তা থেকে পরে প্রতিষ্ঠানটি সরে এসেছে। এটা শুধু হু না, ভাইরোলজিস্ট, বায়োলজিস্ট, ডাক্তার, মহামারি বিশেষজ্ঞ সবারই একই অবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথমে হু-এর কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে যে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিরাই মাস্ক পরবে। এখন সেটা উলটে গেছে। ঠিক তেমনি জাপান ও কোরিয়ায় প্রচলিত কিছু ওষুধ, অথবা ভারতের হোমিওপ্যাথিক অথবা ভেষজ কোনো ওষুধ কীভাবে কার্যকর বলে রায় দেওয়া হলো এবং পরবর্তী সময়ে তা নাকচ করা হলো, এগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি। টিকা আবিষ্কারের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী আমরা পাচ্ছি, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয় নি। কবে হবে তাও জানতে পারছি না। অনেকে আন্দাজের উপর নির্ভর করেই কথা বলছেন। এই অবস্থা দেখে আমরা অন্ধের হাতি দেখার গল্প মনে করতে পারি।

অন্ধের হাতি দেখার মতোই করোনা সম্পর্কে যে যতটা জেনেছে, সে ততটা বলছে। করোনার অবয়ব, গঠনপ্রণালি, কীভাবে এটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, মানুষের ভিতরের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কীভাবে বিকল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তার সার্বিক চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা এখনো কোনো সুস্পষ্ট চিত্র পাচ্ছি না। এখনো এটি অন্ধের হাতি দেখার মতো অবস্থাতেই রয়ে গেছে। 

আমরা ছোটবেলা থেকে ‘গরিবের দ্বারে হাতির পা পড়া’ প্রবাদটি জানি। এটি হয়ত এ কারণে এসেছে যে, আগের দিনে রাজা-জমিদাররা কোনো দরিদ্র প্রজার উপরে কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হলে প্রজার বাড়িতে এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্য হাতি পাঠিয়ে দিতেন। রাজা বা জমিদারের হাতির যত্ন-আত্তি সঠিকভাবে বা রাজা/জমিদারের মান অনুযায়ী করতেই হবে। গরিবের জন্য এটা যে কত বড়ো শাস্তি তা কে না বুঝতে পারে! রাজার হাতি প্রতিপালন করতে গিয়ে দরিদ্র প্রজার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত। একইভাবে করোনাভাইরাস মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র মানুষের দ্বারে পা রাখায় তার জীবন ও জীবিকা দুইই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। এই হাতি এমন হাতি, সে যে দিক দিয়েই যাচ্ছে, তা সে রাজার বাড়ি হোক বা প্রজার বাড়ি হোক, রাজার ফুলবাগান হোক বা প্রজার পর্ণকুটির হোক, তার পায়ের নিচে সকলই ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রও এই হাতির পায়ের নিচে পর্যুদস্ত। আর আমাদের মতো দেশের অবস্থা কী তা তো আমরা নিজেরাই দেখছি। এখন আর কোনো প্রেসিডেন্ট বা রাজা অথবা কোনো বড়োলোকই এই হাতিকে তাদের দরজায় রেখে গৌরব বা সম্মানিত বোধ করবেন না।

এই হাতি এমন হাতি যার কোনো মাহুত দরকার পড়ছে না, বল্লম দরকার পড়ছে না, যুদ্ধাস্ত্র দরকার পড়ছে না। এমনকি তার কারো প্রতি ‘খামোশ’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে হচ্ছে না। তারপরও সারা পৃথিবীই তার কাছে খামোশ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই কানোভাইরাসটিকে হাতির চেয়ে কম বলা যাচ্ছে কি?

এবার আসা যাক করোনাভাইরাস-এর মোকাবেলা প্রসঙ্গে। এই ভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য যেহেতু কোনো ধরনের অস্ত্র, অর্থাৎ কোনো টিকা এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় নি, কাজেই আমাদের নিজ বাড়ির দুর্গে অবস্থান করতে হচ্ছে এবং ঘরের বাইরে বের হলে প্রয়োজনীয় বর্ম, অর্থাৎ মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার ইত্যাদি পরিধান করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শারীরিক সক্ষমতা তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, মনোবল চাঙ্গা রাখতে, সবসময় হাত সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত রাখতে, মাস্ক পরতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে। জানানো হচ্ছে, যতক্ষণ করোনার প্রতিষেধক না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন এভাবেই জীবনযাপন করতে হবে; এবং এগুলোতেও যখন তেমন কাজ হচ্ছে না, তখন সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’-এ থাকতে হচ্ছে বা হবে।  

অনেকে ঠাট্টা করে বললেও বিষয়টি অতি সত্যি যে পুরুষতান্ত্রিক ভাইরাসের দাপটে নারীরা সারাজীবন বাড়ির ভিতরে লকডাউন অবস্থায় থাকে। এই লকডাউন অবস্থায় থাকা সত্তে¡ও পুরুষতন্ত্রের ভাইরাস দ্বারা ঘরের ভিতরে নারীদের জখম হতে হয়, প্রাণ দিতে হয়। আবার বাড়ির বাইরে বের হতে হলে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য হিজাব, স্কার্ফ, বোরকা ইত্যাদি পিপিই পরেও অনেক সময় তাদের শেষরক্ষা হয় না। তারা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার হন, এমনকি তাদের প্রাণও দিতে হয়। 

কার্যকর টিকা না আসায় করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় যেমন শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার কথা বলা হচ্ছে, তেমনি পুরুষতান্ত্রিকতার ছোবল থেকে নারীসমাজের রেহাই বা মুক্তির জন্যও তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, যার অপর নাম এমপাওয়ারমেন্ট, তার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে নির্মূল করার জন্য যে ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কার্যকর ওষুধ, সে সম্পর্কে সারা পৃথিবীর নীতিনির্ধারকরাই কোনো কথা বলছেন না। বরং নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর দক্ষতা বা স্কিল ইত্যাদি বাড়ানোর মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকছেন। 

কারোনাহাতির দাবড়ানি খেয়ে এ বিষয়ে আমাদের চোখের পর্দা যদি কিছুটা হলেও সরে এবং নারীর জীবন লকডাউন থেকে মুক্তি পায় সে কামনাই শুধু করতে পারছি।

করোনাকালের মিনিগল্প : রোকেয়া কবীর

গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম ভাগে আমরা যখন ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা লিখতে হতো। তার মধ্যে একটি ছিল ‘গ্রিক সভ্যতা ক্রীতদাসদের দান’, আরেকটি ছিল ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’ (গরুর রচনা লেখার পাশাপাশি)। শুধু গ্রিক সভ্যতা বা রোমের গড়ে ওঠা না, তাজমহল থেকে শুরু করে পিরামিডসহ পৃথিবীর যেসব বড় বড় স্থাপনা, বড় বড় স্কাল্পচার তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা ‘সভ্যতা’র নিদর্শন বলি, এর সবই ওই দাসদের দান। এমনকি আমরা যেটাকে সভ্যতার যুগ বলি, সেই যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সম্পদশালী হয়েছে এবং বর্তমানে দেশটিতে যতটুকুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানেও ক্রীতদাসদেরই অবদান। 

এই কথাটি মনে পড়ল সম্প্রতি ডেইলি স্টারে বিজিএমইএ’র সভাপ্রধান ড. রুবানা হকের একটি বিবৃতি দেখে। বিবৃতিটি উনি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিক শোষণ এবং করোনার সময়েও শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের অমানবিক আচরণের যে অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষ থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেই অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে। বিবৃতির শেষ দিকে উনি যা লিখেছেন তা বাংলায় সংক্ষেপে তর্জমা করলে দাঁড়ায়— ‘পোশাক শিল্পের মালিকরা বা বিজিএমইএ কখনো ‘নিও লিবারালিজম’ সাপোর্ট করে না, শ্রমিকদের শোষণ বা নির্যাতন করে না।’ আমরা জানি, রুবানা হক একজন সফল ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাই শুধু নন, তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী; অত্যন্ত ভদ্র এবং খুব মেপে কথা বলেন। ‘আকলমন্দ কে লিয়ে ইশরায় কাফি’, এই সূত্রে আমি আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত (মিনি) আকারেই বলছি : 

তিনি নিজেই জানেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রফিট, সারপ্লাস ভ্যালু বা উদ্বৃত্ত মূল্যের যে থিউরি, যা কার্ল মার্কস বলে গেছেন; সেটা প্রমাণ করার জন্য পদ্ধতি অর্থনীতিবিদ বা রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার দরকার নেই। মোটাদাগে বলা যায়, আমরা দেখেছি বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অতি অল্প সময়ে কীভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই ফুলেফেঁপে ওঠার জন্য অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে যে প্রফিট অ্যাকিউমুলেটেড বা পুঞ্জীভূত হয়েছে, তার পিছনে শ্রমিকদের শ্রম শোষণই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যেমন মোটাদাগে বলা যায়, এই শিল্পের যত মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল দরকার, তার নগণ্য অংশ বাদ দিয়ে প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তার জন্য যে মূল্য তা পাই পয়সা হিসেবে পরিশোধ করেই সেগুলো আমদানি করতে হয়। তাহলে তাদের প্রফিট বা লাভটা কোথা থেকে আসে? এটা সকলেই জানে যে, শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে যে মার্জিনটা থাকে সেখান থেকেই এই প্রফিটটা আসে। তারা যে দাবিটা করেন যে তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে, বিশেষ করে নারীদের চাকুরির সংস্থান করে দিয়েছেন, সেটা তাদের প্রতি দয়া বা নারী অধিকারের প্রতি সম্মানবোধ থেকে নয়, বরং কিছুটা কম ঝামেলায় তাদের কম বেতন দিয়েই পার পাওয়া যাবে এই বিবেচনাটাই এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। আর লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ না দিলে হাজার কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করা যাবে না। সেই কারণেই তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের লাভের অংকটা বাড়ানোর জন্য।

আর বাজারে যে মিথটা চালু করতে তারা সফল হয়েছেন যে, গার্মেন্টস মালিকরাই এই দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনীতিকে সচল রাখায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন এটা ঠিক নয়। এই বক্তব্য যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ আগেই বলেছি, মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল সব বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং সেটা বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করেই। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা যেটা দেশে আসে সেটা শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে তারা যে প্রফিটটা পান, যে সারপ্লাস ভ্যালুটা তৈরি হয় সেটা থেকেই অর্জিত হয়। সুতরাং এখানে শ্রমিকের অবদানই প্রধান। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রধান অবদান যে গার্মেন্টস মালিকদের নয়, এটা কেবল আমার বক্তব্য নয়; ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। পৃথিবীতে ধনী দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ধনীক সৃষ্টির যে দ্রুতগতি সেখানে বাংলাদেশের স্থান সামনের সারিতে, এটা কয়েক মাস আগে বৈশ্বিক জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।    

‘ও মা, রাজা ন্যাংটা’— এই গল্পটি আমরা অনেকেই জানি। নিউইয়র্কে করোনার করাল থাবা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ায় ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্কের গভর্নরের অতি সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য এই গল্পটিকে মনে করিয়ে দেয়। তার মন্তব্যটির সংক্ষিপ্ত তর্জমা হলো— ‘যুদ্ধের সময় যখন আমাদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা অর্থাৎ সৈনিকদের হাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও মারণাস্ত্রের কখনো কোনো অভাব হয় না (যেমন বন্দুক, কামান, ট্যাংক, ফাইটার প্লেন, পারমাণবিক বোমা ইত্যাদি), সেখানে বর্তমানে করোনার মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধের যারা সম্মুখ সারির সৈনিক অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই, করোনা সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কীটের প্রচণ্ড অভাব দেখতে পাই। কারণ তার জন্য অর্থের কোনো সংস্থান নেই।’ তার এই বক্তব্য বর্তমানে প্রচলিত অর্থনীতি এবং ‘গণতন্ত্র’-এর নামে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার (গভর্নমেন্ট বাই দা পিপল, ফর দা পিপল, অব দা পিপল) আসল চেহারা কিছুটা হলেও উন্মুক্ত করেছে এবং এই প্রপঞ্চের অসারতা প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রের কোথায় প্রায়োরিটি তাকে অত্যন্ত প্রকটভাবে উন্মোচন করেছে। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাকেই তুলে ধরে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এটা গোটা পৃথিবীরই চিত্র।

করোনাকালেই আমরা দেখছি, বাংলাদেশে বক্স খাটের নিচে ‘ভোজ্যতেলের খনি’। এই ঐতিহ্যের গল্প যদিও এদেশে নতুন না, তবু এই গল্প আমাদের ‘মানুষের উপরে কখনো বিশ্বাস হারাতে নেই’— এই বক্তব্যের ভিত্তিকে আবারো প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়।  

যা হোক, এই হতাশার মধ্যেও একটি ইতিবাচক সুর দিয়ে এই মিনিগল্পের ইতি টানি, সেটি হলো— বিশ্বে নারী নেত্বত্ব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন, যা আমরা বিশ্ব গণমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছি। 

করোনাকালের শিক্ষা : রোকেয়া কবীর

বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে যে অভ্যাস চালু করতে পারে নাই, করোনা তা পেরেছে। মানুষ এখন হাত ধোয়ার ব্যাপারে অনেক সচেতন হয়েছে। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ের যে হাইজিন, সামাজিক যে শিষ্টাচার (হাঁচি, কাশি, নাক ঝাড়া, থুথু ফেলা) মানুষ তা শিখছে; বাসার সুইচবোর্ড, দরজার হ্যান্ডেল পরিষ্কার করা শিখছে; সামাজিক ও ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখা যে দরকার সেটা শিখছে। বাংলাদেশে আমরা সাধারণত এরকমটা দেখি না। এখানে একজনের ঘাড়ের ওপরে অন্যজনের নিঃশ্বাস পড়ে। সভা-সমিতিতে বসার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম দূরত্বটা রক্ষা করতে হয় সে শিক্ষা আমাদের ছিল না প্রায়, যা আমরা এখন পাচ্ছি। এই শিক্ষাকে অভ্যাসে পরিণত করে যদি আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে।  

একটা বড়ো শিক্ষা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্য কোথাও দেখি না যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে নারীসমাজ, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে। এটাকেই আমরা নারীর জন্য উপযুক্ত স্থান ভাবি। এখন করোনা বিস্তার রোধ করার জন্য যখন পুরুষদেরও ঘরে থাকতে হচ্ছে, তখন এটাকে তাদের বন্দি জীবন হিসেবে ভাবা হচ্ছে। আমরা দেখছি তারা দুয়েকদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠছেন ও ভাবছেন এই অবস্থা আর কতদিন! ঘরে থাকতে হওয়ার এই অবস্থাটি কি তাদের এই উপলব্ধিটুকু দেবে যে নারীর চার দেয়ালে বন্দি জীবন কতটা দুর্বিষহ? নারীর এই বন্দি জীবন সম্পর্কে কি তারা এখন নতুন করে ভাবছেন বা ভাববেন? 

ঘরে আটকে থাকায় তাদের হাতে কোনো কাজ নেই বলে যখন তারা হাহুতাশ করছেন, তখন তারা কেন ঘরের কাজ, যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাপড় কাচা, ধোয়া-মোছা, রান্নাবান্নার কাজগুলো শিখছেন না ও করছেন না? এ সময়ে নারীর ঘরের কাজের চাপ সাধারণ সময়ের চাইতে আরো বেড়েছে। ঘরের কাজে সমানভাবে তারাও অংশ নিলে তিন দিক থেকে লাভবান হওয়া যেত ১. পুরুষদের ঘরে থাকার সময়ের সদ্ব্যবহার হতো, ২. তারা ঘরের কাজকে নিজেদের কাজ মনে করতে পারত এবং ৩. নারীদের কাজের ভার কিছুটা কমত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি আমরা যদি ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করে যেতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। 

মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যে খবর পাচ্ছি— সারা পৃথিবীতেই এ সময়ে নারীর ওপর কাজের চাপ বাড়ার পাশাপাশি নির্যাতনও বাড়ছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, পড়াশোনায় সহযোগিতা করার জন্য যে ব্যবস্থাপনা সেটা শুধু নারীদের ওপরে না চাপিয়ে এ দায়িত্বও পুরুষরা নিতে পারে। নির্যাতনের যে কথাগুলো মিডিয়ায় এসেছে ও আসছে সে ব্যাপারেও আমাদের পুরুষরা সচেতন হতে পারে। 

ঘরে হাঁপিয়ে ওঠার অজুহাতে অনেক সময় পুরুষরা ঘরে থাকার নিয়ম উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে সোশ্যালাইজেশনে যাচ্ছেন এবং ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ফিরে এসে ঘরের নারী ও শিশুদের সংক্রমিত করছেন।  যেহেতু এ সময়ে নারীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না, কাজেই এই সংক্রমণের জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়, অথচ তাদের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে।     

করোনাকালে আরো যে শিক্ষাগুলো আমাদের সামনে এসেছে তা হলো, এখন আমরা দেখছি সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কত কম! এটা উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত যে দেশের দিকেই তাকাই না কেন সর্বত্রই একই চিত্র। সবার চোখের সামনেই এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং একটা জোর তাগিদ এসেছে যে জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র এবং সমাজকে কোথায় কোথায় অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এই শিক্ষাটাকে দুর্যোগ উত্তরণের পরেও আমাদের ধরে রাখতে হবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে, সেটা আমূল পালটে শিক্ষার উন্নত মান নিশ্চিত করা এবং কোন কোন খাতে কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে সেটা এখন স্পষ্ট হয়ে এসেছে। সাধারণ স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান, বিশেষ করে জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান, যেগুলো জীবনযাপন এবং বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি করে, সে শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা দরকার। জনগণের সেবা দেবার জন্য স্বাস্থ্যখাতে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ সবার দক্ষতাবৃদ্ধিসহ সংখ্যাবৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তাও এখন সামনে এসেছে। তা ছাড়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনগণেরও সচেতনতা ও দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম থাকা দরকার। 

আরেকটি বিষয়েও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে যে সমস্যা এখন হচ্ছে তা সমাধান করার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের সহ সকল শ্রমিকের জন্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরাসরি তাদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। তাতে শুধু দুর্যোগের সময় না, স্বাভাবিক সময়েও বেতন-ভাতা নিয়ে যেসব অভিযোগ আসে, যেমন নিয়মিত বেতন না হওয়া এবং বেতন কাটা, এ বিষয়গুলো একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।  

যে কোনো সংকটজনক অবস্থা মানুষকে এমন কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দেয়, যা বিভিন্নভাবে মানুষের কাজে লাগে। আমাদের জীবনযাপনের মান উন্নত করে সকল মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলো নিয়মিতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়েও এই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আমাদের কাজে দেয়।  

আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং কর্মক্ষেত্রে নারী : রোকেয়া কবীর

আজ  ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বে প্রতি বছর বিশেষ গুরুত্বের সাথে এই দিবসটি উদযাপন হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দিবসটি উদযাপনের উদ্দেশ্যে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সর্বত্রই এর কার্যক্রম জুড়ে থাকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তাদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা এবং নারীর সমানাধিকারবিরোধী রীতি-প্রথা-সংস্কৃতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ। আর এসব কাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য অতি অবশ্যই নারীর বিরুদ্ধে বিদ্যমান সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা।    

নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সমঅধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম’। এই প্রতিপাদ্যে বর্তমান প্রজন্মকে নারীর সমান অধিকারের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গোতেরেস এবারের টঘঈঝড৬৪ বিষয়ক একটি প্রস্তুতিমূলক সভায় বলেছেন, বেশ কয়েক শতাব্দী আগে দাসপ্রথা যেমন মানব সভ্যতার ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে রেখেছে, বর্তমানেও সভ্যতার অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রভূত উন্নয়ন সত্তে¡ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নারীর প্রতি যে বৈষম্য বিদ্যমান তা একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে।  

সদ্য প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এর নারীর অবস্থা জরিপের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা পৃথিবীতে দক্ষিণ এশিয়া হলো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অসমতার প্রশ্নে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। যদিও নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সামনের সারিতে, তথাপি এখানে নারীর অগ্রগতি যে হারে হচ্ছে, তাতে বৈষম্যমুক্ত একটা অবস্থায় পৌঁছুতে আরো ৭১ বছর লাগবে।     

এটা সবারই জানা, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের সঙ্গে শ্রমিক নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসটি গভীরভাবে সম্পৃক্ত, যার সূচনা হয় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। সেবার মজুরিবৈষম্য লোপ, যৌক্তিক কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন কারখানার শ্রমিক নারীরা। সেই মিছিলে আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর নিপীড়ন নেমে এসেছিল। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে আগত নারী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। এর পরের বছর ৮ মার্চকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। সেই থেকে নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। 

শ্রমিক নারীদের আন্দোলনের ঘটনার সূত্রে আজকের আন্তর্জাতিক নারী দিবস; তার ১৬৩ বছর পরও কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি মজুরিবৈষম্য এখনো আছে। মজুরিবিহীন গার্হস্থ্য কাজ ও অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি অনেক আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রেও এখনো নারীদের ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম দিতে হয়। তদুপরি নারীর জন্য অনেক কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এখনো অনিরাপদ ও অমানবিক। কাজেই কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থা বিষয়ে আলোকপাত করা এখনো প্রাসঙ্গিক। এ লেখায় তা নিয়েই কিছু কথা বলবার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। 

১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘ নারী দিবস উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে আসছে। এ সময়ের মধ্যে একে একে যেসব প্রতিপাদ্য ঘোষিত হয়েছে তার মধ্যেও কয়েকটি সরাসরি নারীর উপার্জনমূলক কাজের পথ প্রশস্ত করার সাথে যুক্ত, যেমন ‘নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ’; ‘সমান অধিকার, সমান সুযোগ : সকলের অগ্রগতি’; ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ— মর্যাদাপূর্ণ কাজে নারীর অংশগ্রহণের মহাসড়ক’, ইত্যাদি। 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উপার্জনমূলক কাজের চাইতে মজুরিবিহীন পুনরুৎপাদনমূলক কাজেই মূলত নারীদের যুক্ততা। পুরুষের আধিপত্যবাদী সমাজ মানসিকতা নারীদের এই অবস্থায় দেখতেই অভ্যস্ত। সমাজ মানসিকতা এখনো এই অবস্থাটি টিকিয়ে রাখবার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। তবু আজকের দিনের নারী একান্ত বাধ্য না হলে রক্ষণশীল মানসিকতায় আবদ্ধ থাকতে আগ্রহী নয় বলে দিনে দিনে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৯-এর মে মাসে বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘স্ট্যাটেসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ-২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মোট ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৫ সরকারি চাকরিজীবীর মধ্যে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮৭ জন নারী, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১০ সালে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। সরকারি চাকরিতে নারীদের এই বৃদ্ধির চিত্র খুবই আশাব্যঞ্জক, যদিও শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির মোট চাকরিজীবী ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৫ জনের মধ্যে নারী মাত্র ৩১ হাজার ৪৩২ জন। এই চিত্র বদল হওয়া আবশ্যক।

বেসরকারি খাতের চাকরিতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্প খাত নারীর অংশগ্রহণের একটি বড়ো ক্ষেত্র। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, করপোরেট খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাত। এগুলোর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতেই নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষাবঞ্চিত ও স্বল্প শিক্ষিত নারীদের শ্রমের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১৮ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তৈরি পোশাকশিল্প খাতে নারী আছেন মাত্র ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, অথচ ২০১৩ সালে করা একই সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এই খাতে নারী অংশগ্রহণের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। 

এই অবস্থাটি তৈরি হওয়ার পেছনে একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় কাজ করছে। খাতটিতে অটোমেশন তথা প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ার সাথে সাথে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ কমছে। সুযোগের সমতার অভাবে দক্ষতা অর্জনে নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। শ্রমিক নারীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারখানার তরফেও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। অন্যদিকে যন্ত্রনির্ভরতার বাইরের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কাজে সাধারণত নারীদের যুক্তই করা হয় না মালিকদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। খাতটিতে এখন আগের তুলনায় বেতন বেড়েছে। তাতে এক সময় যেখানে পুরুষদের আগ্রহ কম ছিল, এখন এ কাজে তাদের আগ্রহও বেড়েছে। ফলে প্রতিযোগিতায় পুরুষরাই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার যেসব গ্রামাঞ্চল থেকে শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প শিক্ষিত মেয়েরা গার্মেন্টস-এ কাজ করতে আসত, সেসব জায়গার কোথাও কোথাও রক্ষণশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রচারণাও প্রভাব রাখছে। তদুপরি কারখানাগুলো এখনো যৌন হয়রানিমুক্ত নয়। শ্রমিক নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী টয়লেটের অনুপস্থিতিও রয়েছে অধিকাংশ কারখানায়। 

এই অবস্থায় বিকল্প হিসেবে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নারী বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ নারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত হয়েছেন। ২০০৪ সালের পর থেকে তা ক্রমেই বেড়েছে। অধিকাংশ শ্রমিক নারী যেসব দেশে কর্মরত আছেন তার মধ্যে সৌদি আরব শীর্ষস্থানে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের মধ্যে আছে কুয়েত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, মরিশাস, মালয়েশিয়া, প্রভৃতি। দেশে কৃষির পরিসর ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাওয়া, গার্মেন্টসে সুযোগ কমে যাওয়া এবং বিদেশে বেতন বেশি হওয়ার কারণে কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে বিদেশের কাজে আগ্রহও বাড়ছে। তবে সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ও লাশ হয়ে নারীদের ফিরে আসার ঘটনায় ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম হয়েছে। ফিরে আসাদের একাংশ নির্মম যৌন নির্যাতনের শিকার হবার অভিযোগ করেছেন। অনেকে স্থানীয় ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা না থাকা, নির্দিষ্ট কাজে পারদর্শিতা না থাকা, ওখানকার খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, প্রতিশ্রুত বেতন না পাওয়া ও বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হওয়ার কারণেও ফেরত এসেছেন। যদিও বিদেশে নিয়োজিত শ্রমিক নারীদের সংখ্যা এবং এ খাত থেকে তাদের মাধ্যমে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণের তুলনায় ফিরে আসা নারীদের হার কম, তবু এ ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ভালো একটা জীবনের আশায় কাজের জন্য বিদেশে গিয়ে একজন নারীর নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসাও প্রত্যাশিত নয়। শ্রমিক নারীদের গন্তব্য দেশে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে যারা নিয়োজিত আছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগও রয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাহার করে প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় যত্নবান হবেন এমন কর্মী নিয়োগ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া বৈধ উপায়ে ছাড়া প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে কেউ যাতে দালালদের মাধ্যমে অর্থ খরচ করে বিদেশে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। যেসব এলাকার নারীদের মধ্যে বিদেশে যাবার প্রবণতা বেশি সেখানে সচেতনতা কার্যক্রমও চালানো দরকার, যাতে তারা সবকিছু জেনেবুঝে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিদেশে যেতে পারেন। 

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)-এর শর্ত অনুযায়ী সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে যুগ যুগ ধরে নারী যে ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি ও সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে নারীর উপার্জনমূলক কর্মের স্বাধীনতাকে নিষ্কণ্টক করতে হবে। পাশাপাশি সব ধরনের কর্মক্ষেত্রকে নারীর জন্য নিরাপদ করে তুলতে হবে। সেজন্য নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন প্রভৃতি খাতেও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি। 

২০২০-এ বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার ২৫ বছর পূর্ণ হলো। এবারের নারী দিবস এই ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনাকে ঘিরে উদযাপিত হচ্ছে। এই কর্মপরিকল্পনায় যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে শ্রমিক নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্যুও রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে সেগুলো এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যুবসমাজকে চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হবার সুপরামর্শ দিয়েছেন। তবে নারীদের উদ্যোক্তা হতে হলে পায়ের নিচে মাটি থাকতে হয়। কৃষিকাজ করতে হলে যেমন এ সম্পর্কিত সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পেতে নিজের নামে জমি থাকতে হয়, তেমনি অন্যান্য শিল্প বা ব্যবসা গড়ে তুলতে হলে ব্যাংকঋণ পেতে হয়। আবার ব্যাংকঋণ পেতে হলে সম্পদের মালিকানা থাকতে হয়, সেটা উত্তরাধিকার থেকে আসে। সুতরাং নারীসমাজের বহুদিনের দাবি নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে পিতামাতার সম্পদে সকল সন্তানের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। 

নারীর সমঅধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম : রোকেয়া কবীর

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আই এম জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি : রিয়ালাইজিং ওমেন’স রাইটস’ বাক্যটিকে— বাংলায় আমরা বলছি ‘নারী অধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই প্রতিপাদ্য। কারণ ইউএন ওমেন-এর যে ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনের সাথে এই প্রতিপাদ্য সম্পর্কিত, তা এসেছে এমন কিছু উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে, বাংলাদেশও যার অন্যতম অংশীদার। ২০২০ সাল বেইজিং ডিক্লারেশন এবং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন, সংক্ষেপে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন-এর ২৫তম বার্ষিকী। ১৯৯৫-এ গৃহীত এই দলিলটি নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে অগ্রসরমান রোডম্যাপ হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত। এ ছাড়াও, এ বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ-এর নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা (ডব্লিউপিএস) বিষয়ক রেজুলেশন ১৩২৫-এর ২০ বছর, নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নিবেদিত জাতিসংঘ-এর বিশেষায়িত সংস্থা ইউএন ওমেন-এর ১০ বছর এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ৫ বছর পূর্তি।  

যে উদ্বেগজনক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ২০২০-এ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে এটা সর্বত্র উপলব্ধ হয়েছে যে, কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটছে বেদনাকরভাবে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই পরিপূর্ণভাবে লিঙ্গসমতা অর্জন করতে পারে নি। আইন, নীতি ও সংস্কৃতিতে থাকা নারী-পুরুষ সমতার বাধাগুলো কম-বেশি সকল দেশেই এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল বা পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ভীষণভাবে প্রকট। এখনো সর্বত্রই নারী ও কিশোরীরা অবমূল্যায়িত। বেশি কাজ করেও তাদের উপার্জন কম। এখনো তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কোনো মূল্য পায় না। বাড়িতে ও বাড়ির বাইরের জনপরিসর তাদের জন্য এখনো নিষ্কণ্টক ও নিরাপদ নয়। 

সার্বিক বিবেচনায় নারীর জীবনে অনেক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও তাদের এগিয়ে চলার পথ বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি প্রতিকূল। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে এখানে সতত জোরদার করে চলেছে ধর্মীয় আধিপত্য। এই দুয়ে মিলে এখানে এমন এক সংস্কৃতি ক্রমবিকাশমান, যেখানে নারী ও তার জীবনযাপনের বিরুদ্ধে যত্রতত্র হেইটস্পিচ বা ঘৃণ্য উক্তি করেও কাউকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় না। অথচ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সুরে সুর মিলিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান নারীর প্রতি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈষম্য না করবার অঙ্গীকার করেছে। তদুপরি, সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের আন্তর্জাতিক সনদ সিডও বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ।

চীনের বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে লিঙ্গসমতার পক্ষে সক্রিয় নারীদের এক বৃহৎ সম্মিলন ঘটেছিল। সেই সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কৌশলগত ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, সেগুলো হলো দারিদ্র্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, সহিংসতা, সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনীতি, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, গণমাধ্যম, পরিবেশ এবং মেয়েশিশু। বিগত ২৫ বছরে এই ১২টি ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী অর্জন একেবারে কম নয়, তবে সময়ের বিবেচনায় ২৫ বছরের অর্জন হিসেবে তা এখনো নগণ্য। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে এখনো এর প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়েই কথা বলতে হয়। এমন একটিও ক্ষেত্র নেই, যেখানে আরো শ্রম, শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ না করলেও চলে। 

তবে আশার কথা যে বর্তমানে সারা বিশে^ই বিভিন্ন বয়সী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েদের পক্ষে কথা বলছেন, যাদের একটা অংশ নতুন প্রজন্মের। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন একটা ছাঁচে গড়ে তুলবার জন্য কাজ করছেন, যা মানবাধিকার ও লিঙ্গসমতা অর্জনে সহায়ক হবে, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।  

ইউএন ওমেন তাদের ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনে লিঙ্গসমতার আন্দোলনে অগ্রবর্তী প্রবীণ সংগ্রামীদের সাথে পরবর্তী প্রজন্মকেও যুক্ত করেছে, যাতে সব বয়স ও লিঙ্গের মানুষ একত্রিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত অসমাপ্ত কাজগুলো করে ভবিষ্যতের জন্য নারী ও মেয়েদের অধিকারগুলো আদায় করে নিতে পারে। সেজন্য জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি ক্যাম্পেইন জোর দিয়েছে সমান কাজে সমান বেতন, মজুরিবিহীন সেবামূলক ও গার্হস্থ্য কাজ ভাগাভাগি করে করা, যৌন হয়রানি এবং নারী ও মেয়েদের প্রতি হওয়া সকল প্রকার সহিংসতার অবসান, নারী ও মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব ও তাদের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের ওপর। 

আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকালেও বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষদের একটা অংশকে নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলনে সক্রিয় ও নিষ্ঠাবান দেখতে পাই। তবে উদ্বেগজনকভাবে ব্যাপার হলো পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর কণ্ঠ কখনো কখনো এই অংশের চাইতে বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে, যারা নারীদের এখনো কেবল পুরুষদের সেবাদাসী হিসেবেই দেখতে চায়। এই গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নারীর উচ্চ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ এবং উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হবার অধিকারের বিপক্ষে বিষোদগার করে চলেছে এবং নির্যাতকদের পক্ষে গেয়ে চলেছে নানারকম সাফাই। এতদিন কেবল বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও অডিও ক্যাসেট তাদের কথা বলার ক্ষেত্র হলেও এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ফ্রি ইউটিউবের কল্যাণে তারা ভিডিও হয়ে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অংশের অপপ্রচার থামানো না গেলে এদেশে নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত তো হবেই না, বরং আরো ধীরগতির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে রাষ্ট্র ও সরকারের জোরালো ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল শর্ত দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য তা দূর করা। পাশাপাশি এদের কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে নারী সহায়ক অংশের কণ্ঠস্বর আরো উচ্চকিত হওয়া দরকার, যাতে আরো অনেক মানুষের কাছে নারীর সমঅধিকারের বার্তাটি পৌঁছে এবং আরো অনেক মানুষ দায়িত্ব বোধ করেন নারীর সমান অধিকারবিরোধী অংশের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে। সেজন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতে পারে এবারের নারী দিবসে আমাদের প্রধান অঙ্গীকার। 

পাশাপাশি আইনিভাবেও এই অংশের মোকাবেলা করবার প্রয়োজন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যুক্ত সরকারের একটা বিভাগ অনলাইন কার্যক্রম মনিটর করবার কাজে রত আছে। অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে নারীবিরোধী এ জাতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এই বিভাগের সক্রিয় তৎপরতা দেখা যায় না, যা এক ধরনের প্রশ্রয়ের নামান্তর। অন্তত দৃষ্টান্তমূলকভাবেও যদি দুয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যেত, তাহলে এ ধরনের অপতৎপরতার রাশ টেনে ধরা সহজ হতো। আশা করি এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যত্নবান হবে, কারণ বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯-এ নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক অ্যাকশন প্ল্যানও গ্রহণ করেছে, যা তাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। তা ছাড়া, সিডও সনদ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার অধীন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নারীবিরোধী অংশের ক্রমশ বিকশিত হবার সুযোগ উন্মুক্ত রেখে এসব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অর্জন কিছুতেই সম্ভব নয়।           

রাজাকারের তালিকা তৈরির আগে রাজাকারি মন চিহ্নিত হওয়া দরকার : রোকেয়া কবীর

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভুলে ভরা কথিত রাজাকারের তালিকাটি ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ১০ হাজার ৭৮৯টি নামসম্বলিত ওই তালিকায় অনেক রাজাকারের নামের অনুপস্থিতি থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভাতাপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর নামও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ভীষণ অগোছালো ও ভুলে ভরা এই তালিকাটি নিয়ে দেশব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় ও সর্বস্তরে সমালোচনার ঝড় ওঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তালিকাটি প্রত্যাহৃত হয়। এই তালিকা অনলাইনে প্রকাশের ফলে যেসব শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আহত হয়েছেন তাঁদের প্রতি সমবেদনাও প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরে জানিয়েছে তারা যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সংশোধিত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের একটি তালিকা তারা যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করল কোন আক্কেলে? যাদের প্রাথমিক পর্যায়ের এটুকু কাণ্ডজ্ঞানই নেই, তাদের করা পরবর্তী তালিকাও যে নির্ভুল হবে জাতিকে সেই গ্যারান্টি কে দেবে, যেখানে এই মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরিতেও ব্যর্থ হয়েছে? ইতোমধ্যেই এই মন্ত্রণালয় দুর্নীতি, অসততা ও অদক্ষতার বিস্তর পরিচয় দিয়েছে, যার অজস্র প্রমাণ প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে। 

আমরা মনে করি একাত্তরের রাজাকারদের নির্ভুল একটি তালিকা অবশ্যই তৈরি হওয়া দরকার। কিন্তু তারও আগে দরকার রাজাকারি মন চিহ্নিত হওয়া। রাজাকারের তালিকা তৈরি করবার আগে সরকারে ও প্রশাসনে থাকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারি মনওয়ালা নব্য রাজাকারগুলো চিহ্নিত করে অপসারণের উদ্যোগ না নিলে নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা এই প্রশাসনের পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এমনকি সম্ভব হবে না একটি গ্রহণযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি করাও। প্রকাশিত ও ইতোমধ্যে প্রত্যাহৃত ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকায় ওই রাজাকারি মনেরই প্রতিফলন ঘটেছে। 

এটা খুবই পরিষ্কার যে, রাজাকারি মন-মানসিকতাধারী মানুষ ও চিন্তাচেতনা দিয়ে ভরা প্রশাসনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, কেবল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়েই এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে বৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠনের পথে এরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। চাকুরির শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব ধরনের সেবা দেবার জন্য এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও এরা নাগরিকদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। যারাই তাদের কাছে কোনো না কোনো সেবার জন্য গিয়েছেন তাদের সিংহভাগকেই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এমনকি জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করে যারা তাদের বড় কর্মকর্তা হবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, বিদ্যমান প্রশাসনের কাছ থেকে হয়রানিমুক্তভাবে কোনো সেবা পাওয়ার ঘটনা তাদের ক্ষেত্রেও বিরল। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের আখের গোছানোর ধান্ধায় থাকা সরকারের একাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী নাগরিকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধানে কোনোরূপ দায়িত্বই অনুভব করেন না, যদিও তারা নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায়ই বেতন পান। তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহুল পরিচিত একটা উক্তি মনে করিয়ে দিতে চাই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন।’ বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মান্য করে চললে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবার মান বাড়ত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয় নি। 

কখনো কখনো মনে হয় নাগরিকদের ইহজাগতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব পালনের চাইতে তাদের বেশি মনোযোগ থাকে ধর্মরক্ষায় এবং সেটা কেবল নিজেদের নয় বরং নাগরিকদেরও। তারা হয়ত জানেন না যে নাগরিকদের পরকালের মঙ্গল-অমঙ্গলের ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়। সুতরাং রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে তাদেরও নয়। এই অংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণে আমন্ত্রিত হয়ে যা বলেন তা থেকেও তাদের মানসিক গড়ন আন্দাজ করা যায়। পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন একটি ধর্মান্ধ মানসিকতার বীজ বিস্তার করে এরা কার্যত দেশকে ৭৫-এর ধারায় ফিরিয়ে নেবার জন্য কাজ করে চলেছে। এদের এই গতি রোধ করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ এসডিজির কোনো লক্ষ্যই সাফল্যের সাথে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা পরিচালিত হবে সংবিধান অনুযায়ী, শরিয়া আইন অনুযায়ী না। 

সার্বিক এই বাস্তবতায় রাজাকারের তালিকা তৈরি করবার আগে প্রশাসনের ভেতরে একটি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে যেরকম দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলমান আছে, একইভাবে প্রশাসনের ভেতরে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে পদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি অমনোযোগী, দুর্নীতিবাজ ও রাজাকারি মানসিকতার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে অপসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেও বিদ্যমান প্রশাসন দিয়ে যেমন কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সরকার পরিচালনার কাজটিও বারবার বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে।  

ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে সরকারের একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয় যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করল, তা সম্ভব হয়েছে রাজাকারি মানসিকতাসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে রয়েছে বলেই। এই শুদ্ধি অভিযানটি শুরু হতে পারে এই তালিকাসংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার মাধ্যমে। একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে এই ঘটনার তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাগরিকদের অনাস্থা তৈরি হবে। সরকার একটা ভাবমূর্তির সংকটে পড়বে। কাজেই এর একটা গ্রহণযোগ্য সুরাহা না করে বিদ্যমান প্রশাসনের মাধ্যমে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের তালিকা তৈরির উদ্যোগ না নেওয়াই উত্তম বলে মনে করি।

সর্ষের ভেতরে যে ভূত, সে ভূত তাড়াবে কে? : রোকেয়া কবীর

২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যেই গত ৩০ নভেম্বর শনিবার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ওএসডি) ড. জাকির হোসেন যৌতুকের দাবিতে তার চিকিৎসক স্ত্রীকে এমন নির্যাতন করেন যে তিনি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। অভিযোগ আছে, ওই অতিরিক্ত সচিব যৌতুকের দাবিতে তার স্ত্রীকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন, যেজন্য তার শরীরে এর আগেই ৯টি সেলাই লেগেছে। শনিবার রাতে নির্যাতনের সময় ভিকটিম ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলে হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হলে অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মামলার বাদী নির্যাতনের শিকার স্ত্রী পরে আদালতে মুচলেকা দিয়ে স্বামীর জামিন নেন।   

বিচার বিভাগ থেকে এই নির্যাতক অতিরিক্ত সচিব হয়ত মুক্তি পেয়ে যাবেন, বাদী স্ত্রী নিজেই যেহেতু স্বামীকে ‘একটি সুযোগ’ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ঘটনাটা তাতেই শেষ হয়ে যায় না। প্রশ্ন থেকে যায় যে, প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কমিউমেন্টসমূহ বাস্তবায়ন করা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগসমূহকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বোঝাই যায় জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার কতটুকুই বা বাস্তবায়ন হয় বা হবে। 

এই ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যখন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটি পদ অধিকার করে থাকেন, তখন এই আশঙ্কা খুব সংগতভাবেই করা যায় যে, নির্যাতনের শিকার স্ত্রী ক্ষমা করে দিলেও জনগণ তাকে ক্ষমা করতে পারবে কি না। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার মাত্রা যদি এই পরিমাণ হয়, তবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে সরকার নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীর সমান অধিকার বাস্তবায়নের জন্য যে সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, সেখানে কোনোভাবে অবদান রাখা এই ধরনের কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব কি না।  

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ১৩২৫-এর আওতায় নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা (ডব্লিউপিএস) অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিকল্পনার উদ্বোধন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে আমি ধর্ম কীভাবে নারীর সমানাধিকার বাস্তবায়ন ও অগ্রযাত্রায়, বিশেষ করে নারীর চলাফেরা ও কাজে বাধা সৃষ্টি করে সে প্রসঙ্গ টানি। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, অনুষ্ঠানে প্রিভেনশন অব ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজিম নিয়ে কথা হচ্ছিল। অনুষ্ঠান শেষে চা-পর্ব চলাকালে সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাকে বিরক্তির সুরে বলেন, আপনারা এ সমস্ত অনুষ্ঠানে ধর্মের প্রসঙ্গ না তুললেই পারেন। তার গলার স্বরে আমার প্রতি এক ধরনের উষ্মাই প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, তারা এটা ভুলে গেছেন যে নারী আন্দোলনের ফসল হিসেবেই এ ধরনের পদে তাদের জায়গা হয়েছে। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে সচিব হিসেবে তিনি কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আরেক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, যে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিচ্ছেন, সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করে বেতন নিলে তা কি হালাল হয়? এ ব্যাপারে ধর্মই বা কী বলে? ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু ঘুষ খাওয়াই দুর্নীতি না, নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করাও দুর্নীতি।

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, যিনি জেম (জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি মেইনস্ট্রিমিং) কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত, সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, শাশুড়িকে দেখে বউ-মার হাত থেকে কাঁপতে কাঁপতে পানির গ্লাস পড়ে যাবে, এটাই আমাদের সংস্কৃতি, এটাই বাংলাদেশের বিউটি। প্রশ্ন হলো, এহেন চিন্তাভাবনার অধিকারী একজন কর্মকর্তা কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন? কী করেই বা তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখা সম্ভব? 

উল্লেখ্য, নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতায়ই এ ধরনের অজস্র ঘটনার উদাহরণ আছে। বাংলার লোকজ্ঞান বলে যে, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জপে সর্ষে ছিটিয়ে কোনো লাভ হয় না, তখন সর্ষেই তাড়াতে হয়। কাজেই সরকারকে ভাবতে হবে এই সর্ষে তারা কীভাবে তাড়াবেন।

আমরা নানা সময়ে রাজনৈতিক শক্তির ভালো-মন্দ নিয়ে সমালোচনা করি, কিন্তু প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা তাদের জন্য নির্ধারিত দায়িত্বের সঙ্গে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলেন ও আচরণ করেন, তারা প্রায়ই প্রশ্নহীন থেকে যান। অথচ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে তারা নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠ থেকে প্রকৃতই জনগণের স্বার্থে কাজ করছেন কি না, ব্যক্তিগতভাবে সে কাজ করবার মতো মনমানসিকতা ধারণ করেন কি না এই প্রশ্ন জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের রাখতেই হবে। 

তাই নারীসমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি করে আসছে যে, প্রজাতন্ত্রের সেবক/কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু জেন্ডার প্রশিক্ষণ দিলেই ‘যথেষ্ট করা হয়েছে’ মনোভাব ত্যাগ করে প্রশিক্ষণের বিষয় ঠিকমতো কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ না করলে, দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে তার বাৎসরিক আমলনামায় এই বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে তার বেতনবৃদ্ধি, প্রমোশন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের ‘শাসক’ বনে যাওয়া এই বাহিনীকে জনগণের সেবক করে তুলতে না পারলে গণতন্ত্রের চর্চা বা গণতান্ত্রিক সমাজ আমরা কখনোই পাব না। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র না। গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে শুধু নির্বাচন করেই গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র এবং সমাজ গড়ে তোলা যাবে না।   

ফিরে দেখা ঊনসত্তর এবং মুক্তিযুদ্ধের আলোয় পথ চলা : রোকেয়া কবীর

আমি যখন বকশীবাজারস্থ ঢাকা গভর্নমেন্ট গার্লস ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেছা গার্লস কলেজ)-এ পড়ি, ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে তখন থেকেই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হতো। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তো বটেই, এরও আগে যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছে, যেমন আওয়ামী লীগের ৬ দফা বা ছাত্রদের ১১ দফা— সবগুলোতেই আমি অংশগ্রহণ করেছি মিছিলের অগ্রভাগে স্লোগানে-স্লোগানে মিছিল জমিয়ে তোলার কাজে। কাজেই ১৯৬৯-এ যখন আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বিশ^বিদ্যালয়ের আনাচকানাচ, মধুর ক্যান্টিন, ছাত্রীদের কমনরুম, বটতলা, রোকেয়া হল আমার কাছে আর নতুন ছিল না, বরং ছিল অতি চেনা ও পুরাতন।

১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও উত্তাল মার্চে আমাদের রাতের থাকার জায়গা রোকেয়া হল হলেও সারাদিনই পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পুরান ঢাকার আনাচকানাচ, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বায়তুল মোকাররমসহ সব জায়গা আমরা চষে বেড়াতাম। স্ট্রিট কর্নার মিটিং, ছোট ছোট মিছিল থেকে বড় মিছিল কোনোটিই বাদ যায় নি। তখন আমাকে সবাই স্লোগান মাস্টার বলত। ’৭১-এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমাদের বিশ^বিদ্যালয় হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা শহরের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের কেন্দ্র। তখন শহরের সর্বত্রই যেন খোলা হয়ে যায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষার অফিস। 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হলো তখন আমাদের স্লোগান হলো ‘এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম’। ১৯৭২ সালে মে মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদের নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে আমি যখন রোকেয়া হল সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হই, তখন আমি মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমার ভোটারদের সিংহভাগই ছিল আমার সিনিয়ার। কারণ তখন শামছুন নাহার হল চালু হয়ে যাওয়ায় প্রথম বর্ষের সব ছাত্রীই শামছুন নাহার হলের অ্যাটাচড অথবা রেসিডেন্ট হিসেবে ভর্তি হতো।

মনে পড়ে, তখন যারা ঢাকার বাইরে থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে আসত, আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহযোগিতা করতাম, হলে ওদের সঙ্গে ডাবলিং-টিপলিং করে থাকতাম। আমরা এটাকে বলতাম ‘মুরগি ধরা’! এদের অনেকের সঙ্গে পরে সম্পর্ক তৈরি হতো। প্রথম কিছুদিন মিটিংয়ে যেত, যদিও পরে অনেকই ঝরে পড়ত। তবে ২০/২৫ জনের মধ্যে মোটামুটি স্থায়ীভাবে টিকে যেত ৪/৫ জন, যারা সংগঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সক্রিয় হতো, মিটিং-মিছিলে অংশ নিত। যারা সংগঠনে সক্রিয় হতো না তারা অন্তত ভোটার হিসেবে থেকে যেত, মাসে মাসে চাঁদা দিত। এক-দুই টাকা থেকে চার আনা, আট আনা। অর্থাৎ, মুরগি ধরার ব্যাপারটা লাভজনকই ছিল। 

রাজনীতিতে সক্রিয় ও হল সংসদে নির্বাচিত হওয়ায় আমার নিয়মিত ক্লাস করা হতো না। একবার টিউটোরিয়াল টিচারের কাছে উপস্থিতির সনদ নিতে গেলে স্যার বললেন, তোমাকে সব সময় মিছিল-মিটিংয়ে দেখি, কিন্তু তুমি যে আমার ছাত্রী তা তো জানতাম না! যাই হোক, তবু আমাদের কখনো নকল করতে হয় নি, পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলনও করতে হয় নি। আমরা ক্লাস না করার ক্ষতিটা অন্যভাবে পুষিয়ে নিতাম। পরীক্ষার আগের একমাস আমরা রাজনীতি না করা বন্ধুদের সাথে একত্রে গ্রুপে পড়তাম। এখানে দিলরুবা, জোছনা, পারভীন ওদের কথা বলা যায়। ওদের দায়িত্ব ছিল টিচাররা কী পড়াতেন তার খোঁজখবর রাখা ও মূল বই জোগাড় করা। মূল বই পড়তাম বলে আমার পরীক্ষায় কখনোই খারাপ করতে হয় নি, বরং সন্তোষজনক নম্বরই পেতাম। 

সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। আমাদের সঙ্গে বিরোধ বলতে ছিল মূলত রাজনৈতিক। আমরা সমাজতন্ত্রের এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলতাম। সেই জন্য পাকিস্তানি ২২ পরিবারের পরিবর্তে যাতে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী পরিবার গড়ে না ওঠে, সে সম্পর্কে বলতাম। তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা খুব বেশি ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের কথাই বেশি বলত এবং আমাদেরকে মস্কোর এজেন্ট আখ্যা দিত। মস্কোয় বৃষ্টি হলে আমরা ঢাকায় ছাতা ধরি, এ বক্তব্যও তাদের ছিল। অন্যদিকে আমরা ওদের বলতাম, ওয়াশিংটনে বৃষ্টি হলে তোমরা ঢাকায় ছাতা ধরো। রাজনৈতিক স্লোগানের পাশাপাশি নানারকম মজার মজার স্লোগানও আসত তখন। আবদুল কুদ্দুস মাখন যেবার ভিপি প্রার্থী হলেন, তখন ছাত্রলীগের একটা স্লোগান ছিল এরকম যে, ‘রুটি যদি খেতে চাও, মাখনকে ভোট দাও’। 

তখনকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল অন্যরকম। বিভিন্ন স্লোগান, মিছিল-মিটিং নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমাদের মধ্যে নানারকম তর্কবিতর্ক হতো, ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলিও হতো। কিন্তু এসব নিয়ে এখনকার মতো বড়ো ধরনের কোনো সংঘাত তৈরি হয় নি। আমরা অনেক সময় একসাথে বসে আড্ডা দিতাম, চা-সিঙ্গারা খেতাম, আবার মিটিং কিংবা পোস্টারের জায়গা দখল নিয়ে বিতর্কেও জড়িয়ে যেতাম। কিন্তু এজন্য আমাদের স্বাভাবিক সৌহার্দ্যে কখনো ঘাটতি পড়ে নি, কিংবা কখনৈা রক্তারক্তি বা মারামারিও করতে হয় নি।  

২.

আমার কর্মজীবনে বিশ^বিদ্যালয়ের আমার সমসাময়িক পরিচিতজন বা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা বা মহকুমা শহরের পরিচিতদের অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমি রাজনীতিতে জয়েন করি নি। এর উত্তরে আমি মজা করে বলি যে, রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের জিএস-ভিপি হওয়ার সময় থেকেই আমার ঢের আক্কেল সেলামী দেওয়া হয়ে গেছে। সঙ্গে তখনকার একটি ঘটনারও উল্লেখ করি। তখন আমি সাধারণত সকাল সাতটায় রুম থেকে বের হয়ে হলের বিভিন্ন কাজ, যেমন হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্য সমাধান শেষে ইউনিভার্সিটিতে যেতাম। সেখান থেকে ডাকসু অফিস, বিকেলে পুরানা পল্টনে পার্টি অফিস হয়ে সন্ধ্যায় হলে ফিরে ডাইনিং হল, ছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা ইত্যাদি শেষ করে রুমে ফিরতে ফিরতে বেজে যেত রাত ১২টা। এর পরে রুম, বাথরুম পরিষ্কার করে গোসল ইত্যাদি সেরে ১টার আগে প্রায় কখনোই আমার ঘুমানো হতো না। একটু যখন ঘুম লেগে আসত, হয়তবা রাত তখন ৩টা, হঠাৎ আমাদের দরজায় ধাক্কা পড়ত। দরজা খুলে ‘কী ব্যাপার!’ জিজ্ঞেস করতেই কোনো ছাত্রী, বিশেষ করে ক্লাসমেইড বা সিনিয়ার কেউ জানাত, ‘আমার বাথরুমে বদনা নাই’! ছাত্রীনেত্রী হয়েও তখন আমাকে এরকম র‌্যাগিংয়ের শিকার হতে হতো। 

বর্তমানে প্রায়ই আমি একটি সমালোচনার সম্মুখীন হই। সেটা হলো, আমি বামপন্থী রাজনীতি করতাম, এখন করি না; বরং এনজিও করি। অর্থাৎ আমি আদর্শচ্যুত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে আমি এরকম উত্তর দিই : মার্কসিজম যদি আমি বুঝে থাকি তাহলে তার মূল মেসেজ হলো সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করা। নারীসমাজ জনসংখ্যার অর্ধেক এবং আমি এই নারীসমাজের বিরুদ্ধে যে বৈষম্য আছে তা দূর করার কাজ করছি। সুতরাং আমি আরো বড় সাম্যবাদী। 

এখন আমি যখন তৃণমূলে কাজ করতে যাই বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, ধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম, হিজাব ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি, তখনো কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হই; যেমন, এদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম তো ইসলাম হতেই পারে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। এটাতে অসুবিধা কী? এ প্রশ্নে আমার জবাব হয় অনেকটা এরূপ : একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এই মৌলিক অধিকারকে ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান বা লিঙ্গপরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজনের সুযোগ নেই। কিংবা কারো সুযোগ নেই ১ শতাংশ নাগরিককেও এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার? সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্যবাদ তা ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ যে রূপেই হাজির হোক না কেন তা গণতন্ত্র পরিপন্থী। সুতরাং ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্য ধর্মের অনুসারীদের সমান মর্যাদায় ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তাই তাদের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষসহ সকল প্রাণী একই পদ্ধতিতে এই পৃথিবীতে জন্মেছেন, যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। এমনকি যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেন না তারাও একই পদ্ধতিতে পৃথিবীতে এসেছেন। সুতরাং সকল ধর্মের সৃষ্টিকর্তাই যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের ধর্মাবলম্বীদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন, তবে মানুষ কেন নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করবে?

আবার হিজাবের প্রশ্নে আমি বলি কে কী পোশাক পরবে এটা তার তার নিজস্ব চয়েজের বিষয়। কেউ যদি হিজাব নিজের পছন্দে পরে তবে সে বিষয়ে আমার বলার কিছুই নেই। কিন্তু হিজাব পরার কারণ বা যুক্তি হিসেবে যা বলা হয় সে ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। আল্লামা শফী যেমন নারীকে ছিলাকলা বা তেঁতুল হিসেবে দেখেন, যাকে খোলা রাখলে মানুষ খেতে চাইবে; এই দৃষ্টিভঙ্গির মর্মার্থ হলো ‘নারীরা ভোগের বস্তু’। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি। নারীকে যারা মানুষ হিসেবে সমানভাবে দেখে না, সমমর্যাদা দেয় না, তাদের এই মানসিকতা অগ্রহণযোগ্য। এক কথায় এই মানসিকতা রাজাকারের মাানসিকতা, যে মানসিকতা পাকিস্তানি ভূতবাহিত হয়ে এসেছে। এই মানসিকতা আধিপত্যবাদী। আধিপত্যবাদের মানসিকতা অগণতান্ত্রিক, তা সে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদই হোক বা প্রধানমন্ত্রী মোদির হিন্দু ধর্মীয় আধিপত্যবাদই হোক। কিংবা হোক মুসলিম আধিপত্যবাদ বা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার আধিপত্যবাদ। এর কোনোটিই গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। 

আধিপত্যবাদী মানসিকতা বাংলাদেশের সংবিধান, সর্বজনীন মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এই আধিপত্যবাদী চিন্তাই জঙ্গিবাদের উৎস। এই হেন পাকিস্তানি ভূত যেন বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে না বসতে পারে, সেজন্য এ ধরনের চিন্তাভাবনাকে সমূলে উৎপাটন ও পরিবর্তনের কাজ করাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কাজ। 

ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষার দায় কি কেবল নারীর? : রোকেয়া কবীর

নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে এখন প্রায় প্রতিদিনই আমরা যে অভিযোগে অভিযুক্ত হই তা হলো, আমরা আমাদের কাজ ঠিকমতো করছি না। যত পরিমাণে করা দরকার তত পরিমাণে করছি না। তাই ধর্ষণ, নির্যাতন এবং এই সমস্ত অপরাধের বীভৎসতার নতুন নতুন মাত্রা এত পরিমাণে বাড়ছে, যা পত্রিকার পাতায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও, সরকার তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না, বিচারের ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এগুলো বাড়ছে বলেও প্রায় সকলের অভিমত আমরা দেখছি। আর একটা যুক্তিও আমরা শুনি, মেয়েরা তাদের উগ্র পশ্চিমা পোশাক, চালচলন ইত্যাদির কারণে ‘ছিলা কলা’ বা ‘তেঁতুল’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার কারণেই তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সুতরাং দোষ মেয়েদেরই। ছোটবেলায় তর্কবিদ্যায় লজিক এবং ফ্যালাসির সংজ্ঞা নিয়ে আমরা খুব মজা পেতাম। বর্তমানে এইসব কথাবার্তা বা যুক্তি শুনলে ভাবতে হয়, এসব কথা যুক্তি না ফ্যালাসি!

বর্তমানে মাদ্রাসায় হিজাব ও বোরকা পরা মেয়েরা যে তাদের প্রিন্সিপাল বা শিক্ষক বা ইমাম দ্বারা যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে, তা নারীর বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগ যে কত অসার তা প্রমাণ করে দেয়। তাদের এই যুক্তি যে অত্যন্ত খোঁড়া তা বলাই বাহুল্য। কার্যত, এই সমস্ত যুক্তি দ্বারা তারা অপরাধীর পক্ষেই দাঁড়ান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যে হাজারো মানুষ হাসপাতাল সয়লাব করে দিচ্ছে, মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, তখন কিন্তু কেউ বলছে না যে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই দায়ী। কিংবা তারা এও বলছে না যে আক্রান্তরা সারা শরীরে মশার ওষুধ মেখে মশারির ভেতরে কেন বসে থাকেন না। তাহলে ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার নারীকেই কেন খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে? 

ডেঙ্গু প্রশ্নে সবাই সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে অবহেলার কথাই বলছেন। পাশাপাশি জনগণের দায়িত্বে নিজ নিজ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশার উৎপাদন ধ্বংস করার কথাও বলছেন। অর্থাৎ ডেঙ্গুর বীজ বহনকারী মশাকে মারা, তার লার্ভা ধ্বংস করাকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার উপায় বলে সকলেই মনে করছেন। এজন্য আমাদের সকলের দায়িত্ব পালনে অবহেলার যে কালচার বা অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন থাকার যে কালচার, সেই কালচারকেই বদলাতে হবে। এটাই যুক্তির কথা। 

সুতরাং নারীর পোশাক বা চালচলনই ধর্ষণের জন্য দায়ী এ ধরনের কুযুক্তি যারা দিতে চান, তাদের আরো মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান এই কথা যখন আমরা বলি এবং যখন গর্ব করি এ দেশের মানুষ খুবই ধর্মপ্রাণ এবং শান্তিপ্রিয় বলে, তখন কেন এই দেশে ৫ বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়? পিতা দ্বারা কন্যা কেন ধর্ষণের শিকার হয়? কেন দুর্গাপূজাসহ অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় উৎসব পালনে পুলিশ প্রহরার দরকার হয়? যুক্তিতে কি এই সমস্ত আপ্তবাক্য ধোপে টেকে? 

আমরা সকলেই জানি, কোনো দ্ব›দ্ব বা সংঘাত বা কথা কাটাকাটিতে হরহামেশাই প্রতিপক্ষের মা বা বোনকে রেপ করার কথা বলা হয়, গালি দেয়া হয়, হুমকি দেয়া হয় এবং আমাদের সমাজ এটাকে সহ্যও করে। বড়জোর ‘ছোটলোক’, ‘অশিক্ষিত’ ইত্যাদি কিছু কথা দিয়ে এটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আমাদের সমাজ এমনিতেই যুগ যুগ ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীকে অধস্তন করে রেখেছে, তার ওপর তাকে অধস্তন, খাওয়ার বা ভোগের সামগ্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, কারো মা-বোনকে রেপ করার হুমকির মাধ্যমে ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো হয়। এভাবেই এটা সমাজের সাবকালচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। 

৮০-র দশক থেকে শুরু করে আমরা দেখেছি বাসে, ট্রেনে, বিভিন্ন চায়ের স্টলে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্যাসেটে মেয়েদের ‘ছিলা কলা’ বা ‘তেঁতুল’ আখ্যা দেয়া ওয়াজের দৌরাত্ম্য। হেফাজতপন্থী আলেম ও চরমোনাইর পীরদের ওয়াজের বয়ানও তাই। তদুপরি, সারাদেশে বিভিন্ন মসজিদে, এলাকায় এলাকায় যে ওয়াজ হয় সেখানেও মূলত নারীদের অধস্তন ও ভোগের সামগ্রী হিসেবেই তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এ আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢেলে যাচ্ছে। এতে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনোজগতে নারী অধস্তন ও ভোগ্যপণ্য— এই মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতাও গেঁড়ে যাচ্ছে গভীরভাবে, ব্যাপকভাবে।

আর একটা বিষয়ও এর সাথে পাশাপাশি এখন চলছে, এমনকি আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও। যার মোদ্দাকথা হলো, নারী যদি ঘরের বাইরে কাজ করে, তাহলে তার ‘মূল’ দায়িত্ব পালন করবে কে? অর্থাৎ, তার রিপ্রোডাক্টিভ রোল ঠিকমতো পালন করতে পারবে কি? কারণটা অবশ্যই সহজজবোধ্য। কারণ সব পুরুষই তাদের ব্যক্তিগত সেবা বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন তাদের পরিবারের নারীদের কাছ থেকে। তাই এই ‘বিশেষ সুবিধা’র সুবিধাভোগীরা কেন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইবেন?

উপরের এই চিন্তাগুলো যখন মাথার বিভিন্ন সারিতে বসে ছিল, তখনই প্রথম আলোতে দেখলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি লেখা। লেখাটা পড়ে প্রচণ্ড হোঁচট খেলাম। প্রথমত তিনি এদেশে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন পুরোধ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তা/হাত/কলম থেকে এই ধরনের লেখা বেরিয়েছে! লেখাটি সম্পর্কে আমার অতি সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া নিম্নরূপ :

স্টিফেন হকিং-এর একটি উদ্ধৃতি এখানে ব্যবহার করছি : “দ্য ইনিমি অব নলেজ ইজ নট ইগনোরেন্স বাট দ্য ইলিউশন অব নলেজ”। মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি যুগের পর যুগের পথ পরিক্রমায় এসে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। যার ওপর ভৌগোলিক অবস্থানভেদে আবহাওয়া, কৃষি উপকরণ, টেকনোলোজি থেকে জীবনযাপন পদ্ধতি অনেক কিছু জড়িত। এ ছাড়াও, অর্থনৈতিক অবস্থান, শহর, গ্রাম, পেশা ইত্যাদিও পোশাকের ধরন নির্ধারণ ও এর পরির্তন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক সায়ীদ তাঁর লেখায় যা বলেছেন, সংক্ষিপ্তভাবে তা হলো নারী শরীর-সর্বস্ব। শাড়ি এবং জাপানের নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনোর মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে আফ্রিকার নারীদের সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছেন, তাতে তাঁকে বর্ণবাদী হিসেবে কেউ আখ্যায়িত করলে অবাক হব না। এ ছাড়াও, তিনি টাইট জিনস, মিনিস্কার্ট যারা পরে তাদেরকে পোশাক না থাকারই শামিল অথবা ‘প্রায় বিবসনা করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদ্যাপন করে’— বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিজনক। তিনি শাড়ি এবং কিমোনোর গুণগান গাইতে গিয়ে যে কথা বলেছেন, তার মাধ্যমে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে যারা নারীকে কেবল ‘শরীর’ হিসেবে দেখে তাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৯৫ সালে আমি জাপানের ওসাকা শহরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তার অভিজ্ঞতার ওপর একটি পেপার প্রেজেন্ট করেছিলাম। সেখানে একটি কেসসটাডি ছিল এরকম : 

স›দ্বীপে আমাদের এক কর্মী জলোচ্ছ¡াসে প্রায় ভেসে যাচ্ছিল। পরনের শাড়ি নিয়ে সে সাঁতার কাটতে পারছিল না। তখন সে শাড়ি খুলে ফেলে শুধু পেটিকোট-ব্লাউজ গায়ে রেখে সাঁতরে এক বাড়ির টিনের চালার ওপর আশ্রয় নিতে পেরেছিল। সেখান থেকে পরে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে ছেলেদের একটি শার্ট গায়ে পেটিকোট পরনে সেই কর্মী সেখানে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। সেই সেন্টারে আশ্রয় গ্রহণকারী নারী বা পুরুষ কেউই কিন্তু তার পোশাক নিয়ে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। 

এই অভিজ্ঞতা শুনে অধিবেশন শেষ হবার পর জাপানের বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারী এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আমাকে বললেন যে, তাহলে তো তোমাদের এখন শাড়ির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে! কারণ হিসেবে তাঁরা বললেন, গত শতকের ৩০-এর দশকের মাঝামাঝি জাপানে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় এবং অনেক নারী মারা যায়। কিমোনো পরে থাকার কারণে তারা দৌড়াতে পারে নি, লাফ দিতে পারে নি এবং সেজন্য তারা নিজেদের বাঁচাতে পারে নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাপানে কিমোনোবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে নারীরা।

যারা শাড়ি আমাদের সংস্কৃতির অংশ, শাড়ি পরলে নারীকে কত আবেদনময়ী লাগে বলেন অথবা ধর্মের নামে যারা হিজাব হাত-মোজা, পা-মোজা পরার জন্য ওকালতি করেন, তাদের জন্য বলতে চাই, যে মেয়েরা কৃষিকাজে রত, ধান-চাল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছ, ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যস্ত, যাদের ক্ষেত্রে অধ্যাপক সায়ীদ বর্ণিত উপায়ে শাড়ি পরার বিলাসিতা বা হিজাব, হাত-মোজা, পা-মোজা পরার বিলাসিতাও চলে না, তারা কি বাঙালি নয়? হলেও সমান বাঙালি বা মুসলিম নারী নয়! ‘কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা’ কি কেবল নারীর বেলায়ই? পুরুষের জন্য তাহলে তাঁর প্রেসক্রিপশনটা কী? ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষার ঠিকাদারিত্ব কি কেবল নারীকেই গ্রহণ করতে হবে? 

রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে তাঁর শেষের কবিতার অমিতের একটা বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি এখানে শেষ করতে চাই : “কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার”।     

নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ : রোকেয়া কবীর

ক্ষমতায়ন হচ্ছে মানুষের বস্তুগত, দৈহিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ওপর স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, যার সঙ্গে দক্ষতার প্রশ্নটি জড়িত। কাজেই নারীর ক্ষমতায়ন বলতে এমন এক ধরনের অবস্থাকে বোঝায়, যে অবস্থায় নারী তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীন ও মর্যাদাকর অবস্থায় উন্নীত হতে পারে। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার মানে হলো একদিনে হঠাৎ করে কারো ক্ষমতায়িত হয়ে ওঠবার সুযোগ নেই। এজন্য দীর্ঘ ও অব্যাহত উদ্যোগ দরকার হয়। নারীর ক্ষমতায়নের আওতাকে প্রধানত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই তিন ভাগে দেখানো হয়। আজকাল অবশ্য আইনগত, তথ্যগতসহ আরো কয়েক ধরনের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ উঠে এলেও মোটাদাগে উল্লিখিত তিন ধরনের ক্ষমতায়নের আওতায়ই সব চলে আসে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অর্জনের মান নিয়ে নিকট অতীতেও কিছু প্রশ্ন ছিল, সম্প্রতি প্রশ্নটি আরো জোরালো হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নটি অবশ্য গুরুত্বের দিক থেকে মানের প্রশ্নের চেয়েও এগিয়ে। সেটি হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখবার অবস্থা দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে কি না। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রবেশাধিকার কেবল তারই থাকবে, যার পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ আছে। বাণিজ্যিকীকৃত সেবাখাতের সামনে অধিকারের প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর হয়ে পড়ে। সেটা বোঝা যায় এই তথ্যেও যে, চিকিৎসাখাতে ব্যয়ের ৬০ শতাংশই নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়।  

এই সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সকল খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাকশিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীদের। সফল ক্ষুদ্রউদ্যোক্তাদের বড়ো অংশই নারী। পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি ও আধাসরকারি অফিস-আদালত, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং বড়ো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো আনুষ্ঠানিক কর্মস্থলেও। সরকার পরিচালনায়, রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, আইনশৃঙ্খলা বিভাগেও নারীদের অবস্থান ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে পথেঘাটেও। কারণ চার দেয়ালের বাইরে নারীদের চলাফেরা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। 

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্প সংখ্যক নারীর মধ্যেই। আমাদের সিংহভাগ নারীই এখনো এসব লক্ষণের বাইরে অবস্থান করেন, যাদের তথ্য ও শিক্ষায় অভিগম্যতা নেই, যাদের ‘পরবাসী’ হয়ে জীবনযাপন করতে হয়, যারা নিজের সিদ্ধান্তে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না এবং নিজের বস্তুগত ক্ষমতার পরিসর স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে বাধাগ্রস্ত হন। আগের বাক্যে ‘পরবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সচেতনভাবে। কারণ মেয়েরা জন্মগ্রহণ করবার পর থেকেই জানে সেটা তাদের বাপের বাড়ি, বিয়ের পর যায় শ্বশুরবাড়ি। এ সমাজে তারা এখনো নির্বিঘেœ রাস্তাঘাটে একা চলতে পারে না, রাতে হোটেলে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। এই অবস্থাটি স্বদেশে পরবাসী হওয়া নয় তো কী? এটা বোঝায় যে, এতসব উজ্জ্বলতা সত্তে¡ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে আমাদের এখনো অনেক হতাশার জায়গা রয়েছে, যেগুলো কাটিয়ে ওঠা না গেলে সময়ে অগ্রগতি ও অধোগতির নানা পরিসংখ্যান হাজির করা সম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তি সম্ভব নয়।  

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সর্বাপেক্ষা বড়ো প্রতিবন্ধকতাটি এখনো নারীবিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত¡। আমাদের সমাজে এখনো এই ন্যারেটিভ জনপ্রিয় যে, নারীর প্রাথমিক কাজ ঘর-সংসার দেখে রাখা, স্বামী-শ্বশুরের খেদমত করা। যদিও এই দেখে রাখা ও খেদমত করার নামে নারীর কাঁধে বিপুল পরিমাণ মজুরিবিহীন কাজের ভার চেপে বসে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গÐি পেরোবার আগে-পরে শিক্ষায় ইতি টানতে হয় এবং বয়স হবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। সম্প্রতি বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নানা কারসাজি করে এখনো যে বাল্যবিয়ে হচ্ছে, তা ওই নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী সমাজ মনস্তত্তে¡র কারণেই। ইউএনএফপি-র এপ্রিল ২০১৯-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। 

দুঃখজনকভাবে আমরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই এখনো নির্যাতনমুক্ত করতে পারি নি, যা অনেক সময়ই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই মেয়েদের শিক্ষাসমাপ্তির একটা অজুহাত হয়ে ওঠে। যতক্ষণ আমরা এ নিশ্চয়তা দিতে না পারব যে মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হবে না, ততক্ষণ এই বাধা ডিঙোনো মুশকিল হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের যত সংবাদ আমরা গণমাধ্যমে দেখি, বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রকৃত ঘটনা তার চাইতেও বেশি। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। সব ঘটনার ন্যায্য প্রতিবিধানও হয় না। গত এপ্রিলে সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় পরীক্ষা চলা অবস্থায়ই অভিযোগকারী শিক্ষার্থী নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে কোরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশব্যাপী যে আলোড়ন ওঠে তাতে বিচারের উদ্যোগ আশানুরূপ গতি পায়। আমরা লক্ষ করি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তখন নড়েচড়ে বসে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের একটি করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, ২০০৯-এ দেওয়া হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা সত্তে¡ও এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে শিক্ষা প্রশাসনের ১০ বছর লাগল কেন? বিষয়টি অতিশয় লজ্জাজনক শুধু নয়, অপরাধমূলকও। সরকারি প্রশাসনের নিজেরই যদি হাইকোর্টকে হাইকোর্ট দেখানোর অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়, তাহলে অন্যেরা উপেক্ষা করলে দোষ দেওয়া যায় না। 

শিক্ষা থেকে মাঝপথে কিশোরীদের ঝরে পড়ার আরেক কারণ স্কুল-মাদ্রাসায় মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধা না থাকা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন জরিপ অনুযায়ী, স্কুলগুলোতে প্রতি ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য আছে মাত্র ১টি টয়লেট। অথচ সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি টয়লেট থাকবার কথা। জরিপ অনুসারে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ৪৩ শতাংশ স্কুলে উন্নত ও কার্যকর টয়লেট রয়েছে, শহর এলাকায় যা ৬৩ শতাংশ। এই অব্যবস্থাপনার কারণে ৪০ শতাংশ মেয়েশিক্ষার্থী তাদের মাসিককালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এতে তারা একদিকে যেমন ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে, অন্যদিকে পরীক্ষায় ফলও খারাপ করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া। এ ছাড়াও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে কিশোরীরা প্রজননতন্ত্রের নানা সংক্রমণেও ভোগে, যা তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ এবং ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

গোটা বিশ্বেই অন্য মাধ্যমের পাশাপাশি তথ্যের জন্য আজকাল নারী-পুরুষ উভয়েরই অনলাইন মাধ্যমের ওপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষার অনলাইন কনটেন্ট বাংলাদেশের সমাজের মতোই নারীবিদ্বেষী ও নারীবিরোধী। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। উন্মুক্ত মাধ্যম বলে যে কেউ যখন তখন স্বনামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা বড়ো অংশ ব্যবহারকারীই নারীর প্রতি অবমাননাকর তথ্য, শব্দ, ছবি, প্রতীক, ইত্যাদি পোস্ট করে থাকে। যখন নারী ব্যবহারকারীরা কোনো কিছু পোস্ট করে, তখন সেখানে অধিকাংশ সময় যেসব মন্তব্য করা হয়, তার সিংহভাগ হয় আক্রমণাত্মক, অশ্লীল গালিপূর্ণ এবং অসংবেদনশীল, যা এখানে উল্লেখ করার মতো না। নারী-পুরুষ যারাই এসবের প্রতিবাদ করেন, তারা আরো কঠিন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হন। ফেসবুকের ইনবক্সগুলো প্রায়ই নারী ব্যবহারকারীদের জন্য একটা আতঙ্কের নাম। প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আবদার তো আছেই, এমনকি হামেশা তারা নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ছবি, পর্নক্লিপ, ইত্যাদিও পাঠিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে সেখানে সেক্সিস্ট বা নিপীড়নমূলক যৌনতাভিত্তিক একটা সমাজের প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে ওঠে। 

সাধারণ ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনাকারী ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা নারীদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই। তবে আশার কথা এই যে, বিরূপতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে দিনে দিনে নারীরা অনলাইনেও নিজেদের একটা পরিসর তৈরি করে নিতে পেরেছেন। তারা সমানাধিকার ও সমমর্যাদার পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, নানা মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা ও অধিকারসচেতন নারীরা নিজেরা এবং নারী সহায়ক কিছু পুরুষই মাত্র সার্বিক অবদান রেখে চলেছেন, যেখানে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা আদৌ আছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।   

বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কম নয়, তবে এই অংশগ্রহণের বেশিরভাগটাই কর্মী-সমর্থক পর্যায়ে। দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত করবার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে শর্ত অন্তর্ভুক্ত হবার পর ৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও তেমন কোনো সুফল আসে নি। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী প্রার্থীদের উপেক্ষা করা হয় নির্বাচিত হতে পারবেন না এই অজুহাতে, যদিও গত নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যার তুলনায় বিজয়ী নারীর শতকরা হার বিজয়ী পুরুষের চাইতে বেশি। ভবিষ্যতে আরো বেশি নারীকে যাতে মনোনয়ন দেওয়া যায়, সেজন্য সমাজের পাওয়ার করিডোরে নারীদের অভিগম্যতা বাড়াতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে অনুকূলতা তৈরি করতে হবে।   

আর্থিক উপার্জনমূলক খাতে নারীদের পদচারণা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দুই ধরনের কর্মক্ষেত্রেই বাড়লেও বেশি বেড়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ খুব বেশি দিনের কথা নয়। যেহেতু বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষায় ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসার ইতিহাসটিই মাত্র কয়েক দশকের, তার আগে পর্যন্ত এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যারা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন, তাদের একটা অংশ কোনো না কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। এদের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। 

এক গবেষণায় জানা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা মোট কর্মীর প্রায় ৬০ ভাগ, অর্থাৎ পুরুষের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। যেহেতু অধিকাংশ নারীই এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করবার সুযোগ পান না এবং দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন, কাজেই তাদের উপার্জনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হতে হয়। এই খাতে সাধারণত পড়াশোনা জানা থাকা বাধ্যতামূলক নয়। যেখানে দরকার হয়, সেখানেও কম থাকলেই চলে। ফলে এ খাতে কর্মরতদের মজুরিও খুব কম এবং অনিয়মিত। কৃষিসহ অধিকাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরিবৈষম্যও চালু আছে। প্রায়ই এখানে কোনো নিয়োগপত্র থাকে না, থাকে না নিয়মিত কাজ করবার নিশ্চয়তাও। কাজ করতে হয় আট ঘণ্টার চেয়েও বেশি। এ খাতের কাজ চাকুরি হিসেবে মর্যাদা পায় না, ফলে মজুরি ছাড়া শ্রমআইনের অন্য কোনো শর্ত, যেমন ছুটি, শ্রমঘণ্টা, উৎসবভাতা, চিকিৎসাভাতা, অবসরভাতা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইত্যাদির এখানে কোনো বালাই নেই। অনেক কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে রয়েছে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অপর্যাপ্ততা, যা তাদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। এদিকে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নির্বিশেষে উভয় ধরনের কর্মক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনের আশঙ্কা এখনো একটি সমস্যা হিসেবে টিকে আছে। এই বাস্তবতা নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করতে আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অতি সম্প্রতি বিশেষ করে কলকারখানাভিত্তিক কাজে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। যা নারীকর্মীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। এটি অদক্ষ শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের আশঙ্কার সামনে ফেলছে। তা ছাড়া, দক্ষতার অভাবে নবাগতরাও এসব কাজে যুক্ত হতে পারছেন না। 

পেশাজীবী নারীদের সিংহভাগকেই বাসস্থান ও কর্মস্থলের মধ্যে যাতায়াত করতে হয় গণপরিবহণে, যেখানে নিয়মিতভাবে তাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব অপরাধে যুক্ত থাকে একইসঙ্গে পুরুষ যাত্রী এবং পরিবহণ শ্রমিকরা। নারীরা যাতে নির্বিঘেœ বাসে চলাচল করতে পারে, সেজন্য বিধি মোতাবেক কিছু আসন সংরক্ষণ করা হলেও প্রায়ই ওসব আসন দখল করে রাখে পুরুষ যাত্রীরা। তা ছাড়া, অধিকাংশ যাত্রী ও হেলপারের ধারণা, কেবল সংরক্ষিত আসনগুলোই নারী যাত্রীদের, এর বাইরে নারীরা বসতে পারবেন না। ফলে অনেক সময়ই নারী যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে হয়। তাতে তাদের হয়রানিমূলক মন্তব্য তো শুনতে হয়ই, এমনকি শরীরে হাত দেওয়া, গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো, ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া, চিমটি কাটা, কাঁধে হাত রাখার মতো ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়। হেলপাররাও প্রায়ই নারী যাত্রীদের বাসে ওঠানো-নামানোর সময় সাহায্য করার ছলে সুকৌশলে শরীরে হাত দেয়, বিশেষ করে চলন্ত অবস্থায় যখন যাত্রী ওঠানো হয়। স¤প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক-এর দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন, যেখানে সিংহভাগ পারপেট্রেটরই গণপরিবহণের চালক ও হেলপাররা। সম্প্রতি চালক ও হেলপারের দ্বারা বাসে দলগতভাবে ধর্ষণ ও হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আজো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।  

আমাদের দেশে নারীদের উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা হলো গৃহকর্মের দায়িত্বের ন্যায্য বণ্টন না হওয়া। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন, সেখানেও বাড়িতে ফিরে নারীকেই সমস্ত দায়িত্ব সামলাতে হয়, যেটি অনেক সময় অমানবিক পর্যায়ে চলে যায়। এতে তারা প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও বিনোদনের সুযোগ পান না। নিজেকে আরো যোগ্য করে তুলতে পড়াশোনা কিংবা সুকুমারবৃত্তির চর্চা করতে পারেন না। 

দেশে কাজের স্বল্পতা ও স্বল্প পারিশ্রমিকের কারণে তরুণ বয়সী অনেক নারী অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের আশায় কাজের সন্ধানে প্রতিবছরই দেশের বাইরে যান। এরা যান প্রধানত গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। ২০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সংবাদসূত্রে জানা যায়, রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৮-র জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন মোট ২ হাজার ২২২ জন নারী গৃহকর্মী। চিঠিতে জানানো হয়, আরো অনেকেই দেশে ফেরার জন্য সেফহোমে অবস্থান করছেন এবং নতুন করে অনেকেই সেফহোমে আসছেন। ফেরত আসাদের প্রায় প্রত্যেকেই ধর্ষণসহ নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার, যাদের অনেকে ফিরেছেন অন্তঃসত্ত¡া অবস্থায়। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ২০১৫ থেকে এ পর্যন্ত গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়া মোট ২,০৩,০০০ জন নারী শ্রমিক কী অমানবিক পরিস্থিতিতে ওখানে ছিলেন ও আছেন। 

২৪ জুলাই ২০১৮ তারিখে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ জানিয়েছেন, ‘সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশিরভাগই নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী থাকেন না। ফলে সৌদি সরকার কিংবা সে দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু করার থাকে না।’ এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভিনদেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটবার পর আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে অনিরাপদ অবস্থায় বিচারের আশায় কেউই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে রাজি হবেন না। কিন্তু এখনো যারা রয়ে গেছেন, তারা যাতে নির্যাতিত না হন সে ব্যাপারে তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না রাষ্ট্রদূত তা নিয়ে কিছুই বলেন নি। তাঁর এই দায়সারা মন্তব্যে এতগুলো নারীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কারণ থাকে। যতদূর জানি, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা বিপর্যস্ত নারীদের কোনোই খোঁজ নেয় নি, যেটা খুবই আপত্তিকর।

আমরা মনে করি, নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাবার আগে তাদের যৌন ও শারীরিক নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সে ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর কৌশল প্রণীত হওয়া দরকার। তা ছাড়া, যে দেশে পাঠানো হবে সে দেশের ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কাজ বিষয়ে মৌলিক শিক্ষা, স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান এবং কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে কোথায় কীভাবে সাহায্য চাইতে হবে সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। আমরা যদি নারীকর্মীদের মাধ্যমে রেমিটেন্স আশা করি, তাহলে তাদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে।

বাংলাদেশে এখনো নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন, আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা বিদ্যমান রয়ে গেছে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে বাংলাদেশ এখনো সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে নি, যে কারণে অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো এখনো বৈষম্যমূলক ধর্মভিত্তিক আইন দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৈষম্যমূলক এসব আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন। এখনো পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন দিয়েই নির্ধারিত হচ্ছে অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক এবং উত্তরাধিকারসহ বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ের মধ্যে কে বেশি অগ্রাধিকার পাবে, তা নির্ধারণ করে এসব আইন, যা স্পষ্টতই সংবিধান ও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, এসব আইনের প্রভাবে নারীকে জন্মলগ্ন থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়; যেমন, আজান না দেওয়া, অধিকারে বৈষম্য, ইত্যাদি ক্ষেত্রে।   

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটা বড়ো প্রতিবন্ধকতা উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নারীবিরোধী প্রচারণা। এই গোষ্ঠী ওয়াজ মাহফিল থেকে শুরু করে মসজিদের খুতবায়, ধর্মীয় তালিমে নারী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে বিষোদগার প্রকাশে অক্লান্ত হলেও দেশে ঘটে চলা অব্যাহত নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কখনো টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করে না। সম্প্রতি এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রভাব বিস্তার করেছে। ইউটিউবে ছেড়েছে অজ¯্র নারীবিরোধী ঘৃণ্য উক্তিতে ভরা ওয়াজের ক্লিপ, যেগুলো প্রায়ই ফেসবুকে শেয়ারও করা হয়। প্রতিনিয়ত এসব হেইটস্পিচ বা ঘৃণ্য প্রচারণার ফলে নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ আরো জোরদার হচ্ছে। তাদের এসব প্রচারণা নারীর শিক্ষা ও চাকুরির বিপক্ষে এবং বাল্যবিয়ের পক্ষে মানুষকে প্রভাবিত করে, যা সংবিধানের মূল চেতনাবিরোধী। এমনকি এসব প্রচারণা পারিবারিক নির্যাতনকেও ইন্ধন দেয়। এই তৎপরতার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী পরিবেশ সৃষ্টিকারীরা ক্রমশ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যাল্প জনগোষ্ঠীর অধিকার, বৈচিত্র্যময়তা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং মুক্তচিন্তাবিরোধী এই শক্তিকে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যতে অনেক বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে হতে পারে।

নারীর ক্ষমতায়নের আরেক প্রতিবন্ধকতা প্রচারমাধ্যমে তাদের স্বল্প ও নেতিবাচক উপস্থাপন। একজন নবীন নারী যখন প্রতিনিয়ত এ ধরনের প্রচারণার সামনে পড়ে, তখন নিজেকে তার ভাইটির তুলনায় হেয় ভাবতে শুরু করে, যা তার ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কৃত এক গবেষণার আওতায় জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে ১০টি সংবাদপত্র, ৫টি টেলিভিশন চ্যানেল এবং একটি বেতার কেন্দ্রের ১৪ দিনের প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ থেকে মোট ৩,৩৬১টি সংবাদ প্রতিবেদন পরিবীক্ষণ করে দেখা যায়, মোট প্রচারিত সংবাদের মাত্র ১৪ শতাংশে নারীকে কাভার করা হয়েছে। আর সংবাদের বিষয় হিসেবে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে মাত্র ৭.২৩ শতাংশ। এতে নারীর কৃতিত্বের চাইতে দুরবস্থার চিত্রই প্রধান হয়ে উঠেছে। 

এখনো পর্যন্ত আমাদের নারীদের সিংহভাগই গ্রামে বসবাস করে। কিন্তু গ্রামের উপস্থিতি গণমাধ্যমে কম থাকা মানে সিংহভাগ নারীর সমস্যা ও সম্ভাবনা উপেক্ষিত হওয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগ নেবার কথা বলেছেন, যা খুবই প্রশংসনীয়। সেজন্য গ্রামকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে গণমাধ্যম বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি, গ্রামাঞ্চলে এখনো আধুনিক জীবনযাপনের সুবিধা নেই। সেখানে রাস্তাঘাট ও যানবাহনের সংকট রয়েছে, নারীদের চলাচলের ওপরে যার প্রভাব পড়ে। আজকাল পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো দূষিত হয়ে গেছে। পুকুর ও নদী থেকে আর নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। এদিকে নলকূপের পানিতেও আর্সেনিকের উপস্থিতি। যেহেতু প্রয়োজনীয় পানি আহরণের দায়িত্ব নারীদেরই পালন করতে হয়, কাজেই এই বিরূপ পরিস্থিতি নারীকে আরো শ্রমঘন ও ক্লান্তিকর কাজে বাধ্য করে তাদের অধিকতর পশ্চাৎপদতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমরা জানি, প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও অধিকাংশ গ্রামেই এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে নি। ফলে তারা টিভি-ফ্রিজ-ফ্যান চালাতে পারে না। এমনকি গ্রামাঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহও নেই। কষ্ট করে লাকড়ি আহরণ করে রান্নার ভোগান্তি কমাতে গ্রামীণ নারীদের রান্নাঘরে সুলভমূল্যে গ্যাস সরবরাহের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। অনেক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি ক্লিনিক কাছাকাছি থাকলেও উচ্চ বিদ্যালয়গুলো বাড়ি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হয়, ফলে তারা তাদের মেয়েদের নির্বিঘেœ স্কুলে পাঠাতে পারে না। গ্রামের অনেক নারীই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। কিন্তু জমির মালিকানা না থাকায় তারা কৃষক হিসেবে স্বীকৃত হন না। ফলে কৃষকদের জন্য সরকারি প্রণোদনামূলক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হন। গ্রামীণ নারীদের এসব সমস্যা দূর করায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছানো গেলে গ্রামীণ নারী-পুরুষ যেমন অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনযাপন করতে পারবে, তেমনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও গ্রামে থাকতে রাজি হবেন। বর্তমান অবস্থায় যেটা সম্ভব হচ্ছে না। 

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৪৮ বছরেও আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছি। সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অতি অবশ্যই এর ৫ নম্বর লক্ষ্য (জেন্ডার সমতা এবং সকল নারী ও কিশোরীর ক্ষমতায়ন) অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে। তা না হলে এসডিজির অন্য লক্ষ্যগুলোর অর্জন ব্যাহত হবে, যেহেতু দেশের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই নারী। আশা করি আমরা আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারগুলোর প্রতি যত্নবান হব। 

তবে এ পর্যায়ে মনে রাখতে হবে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কেবল নারীর নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, মানসিক শক্তি, ইত্যাদি বৃদ্ধি করাই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি অর্জিত যোগ্যতা, দক্ষতা ও শক্তি কাজে লাগাবার পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সেজন্য আইনগত, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে পরিণত করতে হবে। তাহলেই কেবল নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা অর্থপূর্ণ অগ্রগতি আশা করতে পারব।