Monday, 5 October 2020

নারীর সমঅধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম : রোকেয়া কবীর

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আই এম জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি : রিয়ালাইজিং ওমেন’স রাইটস’ বাক্যটিকে— বাংলায় আমরা বলছি ‘নারী অধিকার বাস্তবায়নে আমি সমতার প্রজন্ম’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জন্যও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই প্রতিপাদ্য। কারণ ইউএন ওমেন-এর যে ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনের সাথে এই প্রতিপাদ্য সম্পর্কিত, তা এসেছে এমন কিছু উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে, বাংলাদেশও যার অন্যতম অংশীদার। ২০২০ সাল বেইজিং ডিক্লারেশন এবং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন, সংক্ষেপে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন-এর ২৫তম বার্ষিকী। ১৯৯৫-এ গৃহীত এই দলিলটি নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে অগ্রসরমান রোডম্যাপ হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত। এ ছাড়াও, এ বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ-এর নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা (ডব্লিউপিএস) বিষয়ক রেজুলেশন ১৩২৫-এর ২০ বছর, নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নিবেদিত জাতিসংঘ-এর বিশেষায়িত সংস্থা ইউএন ওমেন-এর ১০ বছর এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ৫ বছর পূর্তি।  

যে উদ্বেগজনক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ২০২০-এ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে এটা সর্বত্র উপলব্ধ হয়েছে যে, কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটছে বেদনাকরভাবে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই পরিপূর্ণভাবে লিঙ্গসমতা অর্জন করতে পারে নি। আইন, নীতি ও সংস্কৃতিতে থাকা নারী-পুরুষ সমতার বাধাগুলো কম-বেশি সকল দেশেই এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল বা পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ভীষণভাবে প্রকট। এখনো সর্বত্রই নারী ও কিশোরীরা অবমূল্যায়িত। বেশি কাজ করেও তাদের উপার্জন কম। এখনো তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কোনো মূল্য পায় না। বাড়িতে ও বাড়ির বাইরের জনপরিসর তাদের জন্য এখনো নিষ্কণ্টক ও নিরাপদ নয়। 

সার্বিক বিবেচনায় নারীর জীবনে অনেক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও তাদের এগিয়ে চলার পথ বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি প্রতিকূল। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে এখানে সতত জোরদার করে চলেছে ধর্মীয় আধিপত্য। এই দুয়ে মিলে এখানে এমন এক সংস্কৃতি ক্রমবিকাশমান, যেখানে নারী ও তার জীবনযাপনের বিরুদ্ধে যত্রতত্র হেইটস্পিচ বা ঘৃণ্য উক্তি করেও কাউকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় না। অথচ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সুরে সুর মিলিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান নারীর প্রতি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বৈষম্য না করবার অঙ্গীকার করেছে। তদুপরি, সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের আন্তর্জাতিক সনদ সিডও বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ।

চীনের বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে লিঙ্গসমতার পক্ষে সক্রিয় নারীদের এক বৃহৎ সম্মিলন ঘটেছিল। সেই সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কৌশলগত ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, সেগুলো হলো দারিদ্র্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, সহিংসতা, সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনীতি, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, গণমাধ্যম, পরিবেশ এবং মেয়েশিশু। বিগত ২৫ বছরে এই ১২টি ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী অর্জন একেবারে কম নয়, তবে সময়ের বিবেচনায় ২৫ বছরের অর্জন হিসেবে তা এখনো নগণ্য। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে এখনো এর প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়েই কথা বলতে হয়। এমন একটিও ক্ষেত্র নেই, যেখানে আরো শ্রম, শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ না করলেও চলে। 

তবে আশার কথা যে বর্তমানে সারা বিশে^ই বিভিন্ন বয়সী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েদের পক্ষে কথা বলছেন, যাদের একটা অংশ নতুন প্রজন্মের। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন একটা ছাঁচে গড়ে তুলবার জন্য কাজ করছেন, যা মানবাধিকার ও লিঙ্গসমতা অর্জনে সহায়ক হবে, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।  

ইউএন ওমেন তাদের ‘জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি’ ক্যাম্পেইনে লিঙ্গসমতার আন্দোলনে অগ্রবর্তী প্রবীণ সংগ্রামীদের সাথে পরবর্তী প্রজন্মকেও যুক্ত করেছে, যাতে সব বয়স ও লিঙ্গের মানুষ একত্রিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পিত অসমাপ্ত কাজগুলো করে ভবিষ্যতের জন্য নারী ও মেয়েদের অধিকারগুলো আদায় করে নিতে পারে। সেজন্য জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি ক্যাম্পেইন জোর দিয়েছে সমান কাজে সমান বেতন, মজুরিবিহীন সেবামূলক ও গার্হস্থ্য কাজ ভাগাভাগি করে করা, যৌন হয়রানি এবং নারী ও মেয়েদের প্রতি হওয়া সকল প্রকার সহিংসতার অবসান, নারী ও মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব ও তাদের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের ওপর। 

আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকালেও বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষদের একটা অংশকে নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলনে সক্রিয় ও নিষ্ঠাবান দেখতে পাই। তবে উদ্বেগজনকভাবে ব্যাপার হলো পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর কণ্ঠ কখনো কখনো এই অংশের চাইতে বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে, যারা নারীদের এখনো কেবল পুরুষদের সেবাদাসী হিসেবেই দেখতে চায়। এই গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নারীর উচ্চ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ এবং উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হবার অধিকারের বিপক্ষে বিষোদগার করে চলেছে এবং নির্যাতকদের পক্ষে গেয়ে চলেছে নানারকম সাফাই। এতদিন কেবল বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও অডিও ক্যাসেট তাদের কথা বলার ক্ষেত্র হলেও এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ফ্রি ইউটিউবের কল্যাণে তারা ভিডিও হয়ে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অংশের অপপ্রচার থামানো না গেলে এদেশে নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত তো হবেই না, বরং আরো ধীরগতির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে রাষ্ট্র ও সরকারের জোরালো ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল শর্ত দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য তা দূর করা। পাশাপাশি এদের কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে নারী সহায়ক অংশের কণ্ঠস্বর আরো উচ্চকিত হওয়া দরকার, যাতে আরো অনেক মানুষের কাছে নারীর সমঅধিকারের বার্তাটি পৌঁছে এবং আরো অনেক মানুষ দায়িত্ব বোধ করেন নারীর সমান অধিকারবিরোধী অংশের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে। সেজন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতে পারে এবারের নারী দিবসে আমাদের প্রধান অঙ্গীকার। 

পাশাপাশি আইনিভাবেও এই অংশের মোকাবেলা করবার প্রয়োজন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যুক্ত সরকারের একটা বিভাগ অনলাইন কার্যক্রম মনিটর করবার কাজে রত আছে। অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে নারীবিরোধী এ জাতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এই বিভাগের সক্রিয় তৎপরতা দেখা যায় না, যা এক ধরনের প্রশ্রয়ের নামান্তর। অন্তত দৃষ্টান্তমূলকভাবেও যদি দুয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যেত, তাহলে এ ধরনের অপতৎপরতার রাশ টেনে ধরা সহজ হতো। আশা করি এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যত্নবান হবে, কারণ বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯-এ নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক অ্যাকশন প্ল্যানও গ্রহণ করেছে, যা তাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। তা ছাড়া, সিডও সনদ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার অধীন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নারীবিরোধী অংশের ক্রমশ বিকশিত হবার সুযোগ উন্মুক্ত রেখে এসব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল অর্জন কিছুতেই সম্ভব নয়।           

No comments:

Post a Comment

লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)