Monday 5 October 2020

নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ : রোকেয়া কবীর

ক্ষমতায়ন হচ্ছে মানুষের বস্তুগত, দৈহিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ওপর স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, যার সঙ্গে দক্ষতার প্রশ্নটি জড়িত। কাজেই নারীর ক্ষমতায়ন বলতে এমন এক ধরনের অবস্থাকে বোঝায়, যে অবস্থায় নারী তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীন ও মর্যাদাকর অবস্থায় উন্নীত হতে পারে। এটি একটি প্রক্রিয়া, যার মানে হলো একদিনে হঠাৎ করে কারো ক্ষমতায়িত হয়ে ওঠবার সুযোগ নেই। এজন্য দীর্ঘ ও অব্যাহত উদ্যোগ দরকার হয়। নারীর ক্ষমতায়নের আওতাকে প্রধানত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই তিন ভাগে দেখানো হয়। আজকাল অবশ্য আইনগত, তথ্যগতসহ আরো কয়েক ধরনের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ উঠে এলেও মোটাদাগে উল্লিখিত তিন ধরনের ক্ষমতায়নের আওতায়ই সব চলে আসে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অর্জনের মান নিয়ে নিকট অতীতেও কিছু প্রশ্ন ছিল, সম্প্রতি প্রশ্নটি আরো জোরালো হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নটি অবশ্য গুরুত্বের দিক থেকে মানের প্রশ্নের চেয়েও এগিয়ে। সেটি হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখবার অবস্থা দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে কি না। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রবেশাধিকার কেবল তারই থাকবে, যার পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ আছে। বাণিজ্যিকীকৃত সেবাখাতের সামনে অধিকারের প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর হয়ে পড়ে। সেটা বোঝা যায় এই তথ্যেও যে, চিকিৎসাখাতে ব্যয়ের ৬০ শতাংশই নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়।  

এই সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সকল খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাকশিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীদের। সফল ক্ষুদ্রউদ্যোক্তাদের বড়ো অংশই নারী। পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি ও আধাসরকারি অফিস-আদালত, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং বড়ো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো আনুষ্ঠানিক কর্মস্থলেও। সরকার পরিচালনায়, রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, আইনশৃঙ্খলা বিভাগেও নারীদের অবস্থান ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে পথেঘাটেও। কারণ চার দেয়ালের বাইরে নারীদের চলাফেরা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। 

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্প সংখ্যক নারীর মধ্যেই। আমাদের সিংহভাগ নারীই এখনো এসব লক্ষণের বাইরে অবস্থান করেন, যাদের তথ্য ও শিক্ষায় অভিগম্যতা নেই, যাদের ‘পরবাসী’ হয়ে জীবনযাপন করতে হয়, যারা নিজের সিদ্ধান্তে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না এবং নিজের বস্তুগত ক্ষমতার পরিসর স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে বাধাগ্রস্ত হন। আগের বাক্যে ‘পরবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সচেতনভাবে। কারণ মেয়েরা জন্মগ্রহণ করবার পর থেকেই জানে সেটা তাদের বাপের বাড়ি, বিয়ের পর যায় শ্বশুরবাড়ি। এ সমাজে তারা এখনো নির্বিঘেœ রাস্তাঘাটে একা চলতে পারে না, রাতে হোটেলে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। এই অবস্থাটি স্বদেশে পরবাসী হওয়া নয় তো কী? এটা বোঝায় যে, এতসব উজ্জ্বলতা সত্তে¡ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে আমাদের এখনো অনেক হতাশার জায়গা রয়েছে, যেগুলো কাটিয়ে ওঠা না গেলে সময়ে অগ্রগতি ও অধোগতির নানা পরিসংখ্যান হাজির করা সম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে নারীমুক্তি সম্ভব নয়।  

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সর্বাপেক্ষা বড়ো প্রতিবন্ধকতাটি এখনো নারীবিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত¡। আমাদের সমাজে এখনো এই ন্যারেটিভ জনপ্রিয় যে, নারীর প্রাথমিক কাজ ঘর-সংসার দেখে রাখা, স্বামী-শ্বশুরের খেদমত করা। যদিও এই দেখে রাখা ও খেদমত করার নামে নারীর কাঁধে বিপুল পরিমাণ মজুরিবিহীন কাজের ভার চেপে বসে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গÐি পেরোবার আগে-পরে শিক্ষায় ইতি টানতে হয় এবং বয়স হবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। সম্প্রতি বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নানা কারসাজি করে এখনো যে বাল্যবিয়ে হচ্ছে, তা ওই নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী সমাজ মনস্তত্তে¡র কারণেই। ইউএনএফপি-র এপ্রিল ২০১৯-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। 

দুঃখজনকভাবে আমরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই এখনো নির্যাতনমুক্ত করতে পারি নি, যা অনেক সময়ই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই মেয়েদের শিক্ষাসমাপ্তির একটা অজুহাত হয়ে ওঠে। যতক্ষণ আমরা এ নিশ্চয়তা দিতে না পারব যে মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হবে না, ততক্ষণ এই বাধা ডিঙোনো মুশকিল হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের যত সংবাদ আমরা গণমাধ্যমে দেখি, বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রকৃত ঘটনা তার চাইতেও বেশি। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। সব ঘটনার ন্যায্য প্রতিবিধানও হয় না। গত এপ্রিলে সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় পরীক্ষা চলা অবস্থায়ই অভিযোগকারী শিক্ষার্থী নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে কোরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশব্যাপী যে আলোড়ন ওঠে তাতে বিচারের উদ্যোগ আশানুরূপ গতি পায়। আমরা লক্ষ করি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তখন নড়েচড়ে বসে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের একটি করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, ২০০৯-এ দেওয়া হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা সত্তে¡ও এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে শিক্ষা প্রশাসনের ১০ বছর লাগল কেন? বিষয়টি অতিশয় লজ্জাজনক শুধু নয়, অপরাধমূলকও। সরকারি প্রশাসনের নিজেরই যদি হাইকোর্টকে হাইকোর্ট দেখানোর অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়, তাহলে অন্যেরা উপেক্ষা করলে দোষ দেওয়া যায় না। 

শিক্ষা থেকে মাঝপথে কিশোরীদের ঝরে পড়ার আরেক কারণ স্কুল-মাদ্রাসায় মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধা না থাকা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন জরিপ অনুযায়ী, স্কুলগুলোতে প্রতি ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য আছে মাত্র ১টি টয়লেট। অথচ সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি টয়লেট থাকবার কথা। জরিপ অনুসারে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ৪৩ শতাংশ স্কুলে উন্নত ও কার্যকর টয়লেট রয়েছে, শহর এলাকায় যা ৬৩ শতাংশ। এই অব্যবস্থাপনার কারণে ৪০ শতাংশ মেয়েশিক্ষার্থী তাদের মাসিককালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এতে তারা একদিকে যেমন ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে, অন্যদিকে পরীক্ষায় ফলও খারাপ করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া। এ ছাড়াও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে কিশোরীরা প্রজননতন্ত্রের নানা সংক্রমণেও ভোগে, যা তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ এবং ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

গোটা বিশ্বেই অন্য মাধ্যমের পাশাপাশি তথ্যের জন্য আজকাল নারী-পুরুষ উভয়েরই অনলাইন মাধ্যমের ওপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষার অনলাইন কনটেন্ট বাংলাদেশের সমাজের মতোই নারীবিদ্বেষী ও নারীবিরোধী। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। উন্মুক্ত মাধ্যম বলে যে কেউ যখন তখন স্বনামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা বড়ো অংশ ব্যবহারকারীই নারীর প্রতি অবমাননাকর তথ্য, শব্দ, ছবি, প্রতীক, ইত্যাদি পোস্ট করে থাকে। যখন নারী ব্যবহারকারীরা কোনো কিছু পোস্ট করে, তখন সেখানে অধিকাংশ সময় যেসব মন্তব্য করা হয়, তার সিংহভাগ হয় আক্রমণাত্মক, অশ্লীল গালিপূর্ণ এবং অসংবেদনশীল, যা এখানে উল্লেখ করার মতো না। নারী-পুরুষ যারাই এসবের প্রতিবাদ করেন, তারা আরো কঠিন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হন। ফেসবুকের ইনবক্সগুলো প্রায়ই নারী ব্যবহারকারীদের জন্য একটা আতঙ্কের নাম। প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আবদার তো আছেই, এমনকি হামেশা তারা নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ছবি, পর্নক্লিপ, ইত্যাদিও পাঠিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে সেখানে সেক্সিস্ট বা নিপীড়নমূলক যৌনতাভিত্তিক একটা সমাজের প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে ওঠে। 

সাধারণ ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনাকারী ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা নারীদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই। তবে আশার কথা এই যে, বিরূপতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে দিনে দিনে নারীরা অনলাইনেও নিজেদের একটা পরিসর তৈরি করে নিতে পেরেছেন। তারা সমানাধিকার ও সমমর্যাদার পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, নানা মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা ও অধিকারসচেতন নারীরা নিজেরা এবং নারী সহায়ক কিছু পুরুষই মাত্র সার্বিক অবদান রেখে চলেছেন, যেখানে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা আদৌ আছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।   

বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কম নয়, তবে এই অংশগ্রহণের বেশিরভাগটাই কর্মী-সমর্থক পর্যায়ে। দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত করবার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে শর্ত অন্তর্ভুক্ত হবার পর ৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও তেমন কোনো সুফল আসে নি। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী প্রার্থীদের উপেক্ষা করা হয় নির্বাচিত হতে পারবেন না এই অজুহাতে, যদিও গত নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যার তুলনায় বিজয়ী নারীর শতকরা হার বিজয়ী পুরুষের চাইতে বেশি। ভবিষ্যতে আরো বেশি নারীকে যাতে মনোনয়ন দেওয়া যায়, সেজন্য সমাজের পাওয়ার করিডোরে নারীদের অভিগম্যতা বাড়াতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে অনুকূলতা তৈরি করতে হবে।   

আর্থিক উপার্জনমূলক খাতে নারীদের পদচারণা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দুই ধরনের কর্মক্ষেত্রেই বাড়লেও বেশি বেড়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ খুব বেশি দিনের কথা নয়। যেহেতু বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষায় ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসার ইতিহাসটিই মাত্র কয়েক দশকের, তার আগে পর্যন্ত এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যারা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন, তাদের একটা অংশ কোনো না কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। এদের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। 

এক গবেষণায় জানা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা মোট কর্মীর প্রায় ৬০ ভাগ, অর্থাৎ পুরুষের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। যেহেতু অধিকাংশ নারীই এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করবার সুযোগ পান না এবং দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন, কাজেই তাদের উপার্জনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হতে হয়। এই খাতে সাধারণত পড়াশোনা জানা থাকা বাধ্যতামূলক নয়। যেখানে দরকার হয়, সেখানেও কম থাকলেই চলে। ফলে এ খাতে কর্মরতদের মজুরিও খুব কম এবং অনিয়মিত। কৃষিসহ অধিকাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরিবৈষম্যও চালু আছে। প্রায়ই এখানে কোনো নিয়োগপত্র থাকে না, থাকে না নিয়মিত কাজ করবার নিশ্চয়তাও। কাজ করতে হয় আট ঘণ্টার চেয়েও বেশি। এ খাতের কাজ চাকুরি হিসেবে মর্যাদা পায় না, ফলে মজুরি ছাড়া শ্রমআইনের অন্য কোনো শর্ত, যেমন ছুটি, শ্রমঘণ্টা, উৎসবভাতা, চিকিৎসাভাতা, অবসরভাতা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইত্যাদির এখানে কোনো বালাই নেই। অনেক কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে রয়েছে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অপর্যাপ্ততা, যা তাদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। এদিকে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নির্বিশেষে উভয় ধরনের কর্মক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনের আশঙ্কা এখনো একটি সমস্যা হিসেবে টিকে আছে। এই বাস্তবতা নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করতে আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অতি সম্প্রতি বিশেষ করে কলকারখানাভিত্তিক কাজে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। যা নারীকর্মীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। এটি অদক্ষ শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের আশঙ্কার সামনে ফেলছে। তা ছাড়া, দক্ষতার অভাবে নবাগতরাও এসব কাজে যুক্ত হতে পারছেন না। 

পেশাজীবী নারীদের সিংহভাগকেই বাসস্থান ও কর্মস্থলের মধ্যে যাতায়াত করতে হয় গণপরিবহণে, যেখানে নিয়মিতভাবে তাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব অপরাধে যুক্ত থাকে একইসঙ্গে পুরুষ যাত্রী এবং পরিবহণ শ্রমিকরা। নারীরা যাতে নির্বিঘেœ বাসে চলাচল করতে পারে, সেজন্য বিধি মোতাবেক কিছু আসন সংরক্ষণ করা হলেও প্রায়ই ওসব আসন দখল করে রাখে পুরুষ যাত্রীরা। তা ছাড়া, অধিকাংশ যাত্রী ও হেলপারের ধারণা, কেবল সংরক্ষিত আসনগুলোই নারী যাত্রীদের, এর বাইরে নারীরা বসতে পারবেন না। ফলে অনেক সময়ই নারী যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে হয়। তাতে তাদের হয়রানিমূলক মন্তব্য তো শুনতে হয়ই, এমনকি শরীরে হাত দেওয়া, গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো, ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া, চিমটি কাটা, কাঁধে হাত রাখার মতো ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়। হেলপাররাও প্রায়ই নারী যাত্রীদের বাসে ওঠানো-নামানোর সময় সাহায্য করার ছলে সুকৌশলে শরীরে হাত দেয়, বিশেষ করে চলন্ত অবস্থায় যখন যাত্রী ওঠানো হয়। স¤প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক-এর দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন, যেখানে সিংহভাগ পারপেট্রেটরই গণপরিবহণের চালক ও হেলপাররা। সম্প্রতি চালক ও হেলপারের দ্বারা বাসে দলগতভাবে ধর্ষণ ও হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আজো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।  

আমাদের দেশে নারীদের উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হবার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা হলো গৃহকর্মের দায়িত্বের ন্যায্য বণ্টন না হওয়া। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন, সেখানেও বাড়িতে ফিরে নারীকেই সমস্ত দায়িত্ব সামলাতে হয়, যেটি অনেক সময় অমানবিক পর্যায়ে চলে যায়। এতে তারা প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও বিনোদনের সুযোগ পান না। নিজেকে আরো যোগ্য করে তুলতে পড়াশোনা কিংবা সুকুমারবৃত্তির চর্চা করতে পারেন না। 

দেশে কাজের স্বল্পতা ও স্বল্প পারিশ্রমিকের কারণে তরুণ বয়সী অনেক নারী অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের আশায় কাজের সন্ধানে প্রতিবছরই দেশের বাইরে যান। এরা যান প্রধানত গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। ২০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সংবাদসূত্রে জানা যায়, রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৮-র জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন মোট ২ হাজার ২২২ জন নারী গৃহকর্মী। চিঠিতে জানানো হয়, আরো অনেকেই দেশে ফেরার জন্য সেফহোমে অবস্থান করছেন এবং নতুন করে অনেকেই সেফহোমে আসছেন। ফেরত আসাদের প্রায় প্রত্যেকেই ধর্ষণসহ নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার, যাদের অনেকে ফিরেছেন অন্তঃসত্ত¡া অবস্থায়। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ২০১৫ থেকে এ পর্যন্ত গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়া মোট ২,০৩,০০০ জন নারী শ্রমিক কী অমানবিক পরিস্থিতিতে ওখানে ছিলেন ও আছেন। 

২৪ জুলাই ২০১৮ তারিখে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ জানিয়েছেন, ‘সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশিরভাগই নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী থাকেন না। ফলে সৌদি সরকার কিংবা সে দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু করার থাকে না।’ এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভিনদেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটবার পর আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে অনিরাপদ অবস্থায় বিচারের আশায় কেউই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে রাজি হবেন না। কিন্তু এখনো যারা রয়ে গেছেন, তারা যাতে নির্যাতিত না হন সে ব্যাপারে তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না রাষ্ট্রদূত তা নিয়ে কিছুই বলেন নি। তাঁর এই দায়সারা মন্তব্যে এতগুলো নারীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কারণ থাকে। যতদূর জানি, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা বিপর্যস্ত নারীদের কোনোই খোঁজ নেয় নি, যেটা খুবই আপত্তিকর।

আমরা মনে করি, নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাবার আগে তাদের যৌন ও শারীরিক নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সে ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর কৌশল প্রণীত হওয়া দরকার। তা ছাড়া, যে দেশে পাঠানো হবে সে দেশের ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কাজ বিষয়ে মৌলিক শিক্ষা, স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান এবং কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে কোথায় কীভাবে সাহায্য চাইতে হবে সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। আমরা যদি নারীকর্মীদের মাধ্যমে রেমিটেন্স আশা করি, তাহলে তাদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে।

বাংলাদেশে এখনো নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন, আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা বিদ্যমান রয়ে গেছে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে বাংলাদেশ এখনো সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে নি, যে কারণে অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো এখনো বৈষম্যমূলক ধর্মভিত্তিক আইন দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৈষম্যমূলক এসব আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন। এখনো পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন দিয়েই নির্ধারিত হচ্ছে অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক এবং উত্তরাধিকারসহ বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ের মধ্যে কে বেশি অগ্রাধিকার পাবে, তা নির্ধারণ করে এসব আইন, যা স্পষ্টতই সংবিধান ও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সাথে সাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, এসব আইনের প্রভাবে নারীকে জন্মলগ্ন থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়; যেমন, আজান না দেওয়া, অধিকারে বৈষম্য, ইত্যাদি ক্ষেত্রে।   

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটা বড়ো প্রতিবন্ধকতা উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নারীবিরোধী প্রচারণা। এই গোষ্ঠী ওয়াজ মাহফিল থেকে শুরু করে মসজিদের খুতবায়, ধর্মীয় তালিমে নারী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে বিষোদগার প্রকাশে অক্লান্ত হলেও দেশে ঘটে চলা অব্যাহত নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কখনো টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করে না। সম্প্রতি এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রভাব বিস্তার করেছে। ইউটিউবে ছেড়েছে অজ¯্র নারীবিরোধী ঘৃণ্য উক্তিতে ভরা ওয়াজের ক্লিপ, যেগুলো প্রায়ই ফেসবুকে শেয়ারও করা হয়। প্রতিনিয়ত এসব হেইটস্পিচ বা ঘৃণ্য প্রচারণার ফলে নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ আরো জোরদার হচ্ছে। তাদের এসব প্রচারণা নারীর শিক্ষা ও চাকুরির বিপক্ষে এবং বাল্যবিয়ের পক্ষে মানুষকে প্রভাবিত করে, যা সংবিধানের মূল চেতনাবিরোধী। এমনকি এসব প্রচারণা পারিবারিক নির্যাতনকেও ইন্ধন দেয়। এই তৎপরতার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী পরিবেশ সৃষ্টিকারীরা ক্রমশ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যাল্প জনগোষ্ঠীর অধিকার, বৈচিত্র্যময়তা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং মুক্তচিন্তাবিরোধী এই শক্তিকে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যতে অনেক বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে হতে পারে।

নারীর ক্ষমতায়নের আরেক প্রতিবন্ধকতা প্রচারমাধ্যমে তাদের স্বল্প ও নেতিবাচক উপস্থাপন। একজন নবীন নারী যখন প্রতিনিয়ত এ ধরনের প্রচারণার সামনে পড়ে, তখন নিজেকে তার ভাইটির তুলনায় হেয় ভাবতে শুরু করে, যা তার ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কৃত এক গবেষণার আওতায় জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে ১০টি সংবাদপত্র, ৫টি টেলিভিশন চ্যানেল এবং একটি বেতার কেন্দ্রের ১৪ দিনের প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ থেকে মোট ৩,৩৬১টি সংবাদ প্রতিবেদন পরিবীক্ষণ করে দেখা যায়, মোট প্রচারিত সংবাদের মাত্র ১৪ শতাংশে নারীকে কাভার করা হয়েছে। আর সংবাদের বিষয় হিসেবে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে মাত্র ৭.২৩ শতাংশ। এতে নারীর কৃতিত্বের চাইতে দুরবস্থার চিত্রই প্রধান হয়ে উঠেছে। 

এখনো পর্যন্ত আমাদের নারীদের সিংহভাগই গ্রামে বসবাস করে। কিন্তু গ্রামের উপস্থিতি গণমাধ্যমে কম থাকা মানে সিংহভাগ নারীর সমস্যা ও সম্ভাবনা উপেক্ষিত হওয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগ নেবার কথা বলেছেন, যা খুবই প্রশংসনীয়। সেজন্য গ্রামকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে গণমাধ্যম বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি, গ্রামাঞ্চলে এখনো আধুনিক জীবনযাপনের সুবিধা নেই। সেখানে রাস্তাঘাট ও যানবাহনের সংকট রয়েছে, নারীদের চলাচলের ওপরে যার প্রভাব পড়ে। আজকাল পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো দূষিত হয়ে গেছে। পুকুর ও নদী থেকে আর নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। এদিকে নলকূপের পানিতেও আর্সেনিকের উপস্থিতি। যেহেতু প্রয়োজনীয় পানি আহরণের দায়িত্ব নারীদেরই পালন করতে হয়, কাজেই এই বিরূপ পরিস্থিতি নারীকে আরো শ্রমঘন ও ক্লান্তিকর কাজে বাধ্য করে তাদের অধিকতর পশ্চাৎপদতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমরা জানি, প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও অধিকাংশ গ্রামেই এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে নি। ফলে তারা টিভি-ফ্রিজ-ফ্যান চালাতে পারে না। এমনকি গ্রামাঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহও নেই। কষ্ট করে লাকড়ি আহরণ করে রান্নার ভোগান্তি কমাতে গ্রামীণ নারীদের রান্নাঘরে সুলভমূল্যে গ্যাস সরবরাহের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। অনেক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি ক্লিনিক কাছাকাছি থাকলেও উচ্চ বিদ্যালয়গুলো বাড়ি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হয়, ফলে তারা তাদের মেয়েদের নির্বিঘেœ স্কুলে পাঠাতে পারে না। গ্রামের অনেক নারীই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। কিন্তু জমির মালিকানা না থাকায় তারা কৃষক হিসেবে স্বীকৃত হন না। ফলে কৃষকদের জন্য সরকারি প্রণোদনামূলক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হন। গ্রামীণ নারীদের এসব সমস্যা দূর করায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছানো গেলে গ্রামীণ নারী-পুরুষ যেমন অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনযাপন করতে পারবে, তেমনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও গ্রামে থাকতে রাজি হবেন। বর্তমান অবস্থায় যেটা সম্ভব হচ্ছে না। 

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৪৮ বছরেও আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছি। সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অতি অবশ্যই এর ৫ নম্বর লক্ষ্য (জেন্ডার সমতা এবং সকল নারী ও কিশোরীর ক্ষমতায়ন) অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে। তা না হলে এসডিজির অন্য লক্ষ্যগুলোর অর্জন ব্যাহত হবে, যেহেতু দেশের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই নারী। আশা করি আমরা আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারগুলোর প্রতি যত্নবান হব। 

তবে এ পর্যায়ে মনে রাখতে হবে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কেবল নারীর নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, মানসিক শক্তি, ইত্যাদি বৃদ্ধি করাই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি অর্জিত যোগ্যতা, দক্ষতা ও শক্তি কাজে লাগাবার পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সেজন্য আইনগত, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে পরিণত করতে হবে। তাহলেই কেবল নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা অর্থপূর্ণ অগ্রগতি আশা করতে পারব।


No comments:

Post a Comment

লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)