Sunday, 25 September 2011

দুটো খণ্ড দৃশ্য : রোকেয়া কবীর


হরতালের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলবার জন্য এই লেখা নয়, কথার সূত্রপাত যদিও হরতাল থেকেই
হরতালে অফিসে না-গিয়ে কাজ বন্ধ করে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি নাতবে হরতালে গাড়ি নিয়ে পথে বেরোনো ঝুঁকিপূর্ণ বলে এ দিনগুলোতে আমি সাধারণত সিএনজি অটোরিক্সার সেবা নিয়ে থাকি২২ সেপ্টেম্বরের হরতালের দিনও তাই করতে হলোঅটোরিক্সা মিটারে চলবে এরকম আশা এখন সম্পূর্ণই দুরাশাএজন্য জিজ্ঞেস করতে হলো ভাড়ার কথা
ড্রাইভার ১২০ টাকা হাঁকলোবনানী থেকে মোহাম্মদপুর যেতে এই ভাড়া হয়ত খুব বেশি না, যদিও মিটারে গেলে এর চেয়ে কমই লাগবার কথাতবু উঠে বসলাম, যেতে তো হবে
বললাম, ‘আজকে তো রাস্তা ফাঁকা, জ্যাম নেই, সেক্ষেত্রে ভাড়া তো আরো কম হওয়া উচিত
ড্রাইভার বলল, ‘আপা, হরতালের কথা বলে ভাড়া কম দিতে চাইতেছেনকিন্তু আপনি হয়ত জানেন না যে, এই গাড়িটা রাস্তায় নামাইতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগছেমাত্র চাইর দিন হইল গাড়ির বয়সএত টাকা দিয়া গাড়ি কিনতে হয় বইল্যাই মালিক আমদানিও বেশি নেয়সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার জন্য আমদানি সাতশ টাকা, রাতের জন্য সাড়ে তিনশ থেকে চারশএর কম ভাড়ায় আমগোর পুষাবো কেমনে?’ অকাট্য যুক্তি তার
কৌতূহল জাগল অটোরিক্সার দাম নিয়েবললাম, ‘এত ছোটো গাড়ি রাস্তায় নামাতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগবার তো কথা না!
ড্রাইভার জানাল ঘুষের কথাবলল, ‘আপনি তো জানেন, বর্তমানে সিএনজির লাইসেন্স দেওয়া বন্ধসেইজন্য এই লাইসেন্সটা পাইতে অনেক টাকা লাগছেগাড়ির ইঞ্জিন-বড়ি-নেট এইসব লাগাইতে সোয়া পাঁচ লাখের মতো লাগলেও বাকি টাকা গেছে নানা ঘাটে ঘুষ দিতে দিতেএই টাকাটা তো তার উঠানো লাগবোএই জন্যই মালিকরা আমদানি বেশি ধরে
তার কথাবার্তা ঘুরে ফিরে আবার হরতালের দিকে এলে বললাম, ‘হরতালটা কেন হচ্ছে?’
সরাসরি জবাবে না-গিয়ে সে বলল, ‘পথঘাট স্বাভাবিক, গাড়ি-ঘোড়া কম, গণ্ডগোল দেখলাম না কোনোখানেতবে ওইদিন জামাত যে কাজটা করল, সেইটা একদম ঠিক করে নাইপুলিশ চাইলে আগেই ঠেকাইতে পারতকিন্তু তারা সেইটা করে নাইআগে মাইর খাইছে, পরে মাইর দিছেএতে অনেক ক্ষতি হইছেএত গাড়ি পোড়াইলো, কিন্তু এইটা নিয়া মানুষ কথা কয় নাঅবশ্য পুলিশ আগে মারলে বলত, পুলিশই উসকানি দিছে
বললাম, ‘জামায়াত যে ইসলামের কথা বলে, এই ব্যাপারে আপনার মত কী?’
প্রশ্ন শুনে উসকে উঠল সে, ‘আরে রাখেন জামাতএরা সব শয়তানের চ্যালাআমার এলাকার মসজিদের এক জামাতি ইমাম, মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়, মনে হয় ফেরেশতা, কিন্তু মসজিদের লাইট-ফ্যান সব বিক্রি কইরা খাইয়া ফেলেগত আওয়ামী লীগ সরকার মসজিদে কিছু টিন দিছিলোসে ওই টিন বাড়িতে খাটাইয়া মসজিদে লাগাইছে খারাপ টিনএলাকার টাকাপয়সাওয়ালা লোকজন শখ কইরা মানত কইরা মুসল্লিদের সুবিধার জন্য লাইট-ফ্যান-মাইক দেয়, কিন্তু সে বিক্রি কইরা দেয়মাঝে মাঝে লোকজন নামাজের শেষে মসজিদের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবার চেষ্টা করলে ইমাম সাব লাঠিয়াল সাঙ্গপাঙ্গ ডাকেসে আরো যোগ করে, জামাত নামাজ পড়া, ধর্মপালন করা নিয়া বড়ো বড়ো কথা কয়, কিন্তু এরা শয়তানের হাড্ডিঘুষ, চুরি, মেয়েমানুষ খাওয়া থেকে শুরু করে সবটাই করে 
জানতে চাইলাম, ‘বাড়ি কোথায় আপনার?’
ফরিদপুরতারপর সে হেসে ফেলে এবং বলে, ‘ফরিদপুর হইলে কী হইবো, আমার এলাকা কিন্তু বিএনপির ঘাঁটিকামাল সাব খুব ভালা মানুষকিন্তু তার পার্টি বিএনপি ভালা নাসে গরিব লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, বর্ষায় জনসাধারণের চলাচলের জন্য ট্রলার দেয়
এ কথায় তার রাজনীতি সম্পর্কে একটু সংশয়ে পড়ে গেলামআরেকটু খোলাসা হতে ইচ্ছে হলোজিজ্ঞেস করলাম, ‘আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে কেমন?’
না, চালাইতে পারতেছে না’, সে বললবিশেষ কইরা পুলিশ প্রশাসন একদমই চালাইতে পারতেছে নাএই মতের সঙ্গে সে ব্যাখ্যাও যুক্ত করলবলল, ‘কেমনে পারবো, সরকার আওয়ামী লীগ হইলেও পুলিশ, সরকারি অফিসার অনেকেই বিএনপি-জামাতেরআমার এলাকার থানায় যত পুলিশ অফিসার একের পর এক বদলি হইয়া আইছে, তারা সবাই বিএনপিরএরা সরকারের কথা মানে নাতার চাইতে সরকারকে ডোবানোর জন্য কাজ করেসে আরো বলল, ‘বিএনপির হাতে অনেক টাকাধরেন আমার এই গাড়ির মালিকের কথাইসে বিএনপির ৩০ জনরে চাকরি দিছেপ্রত্যেকের কাছ থেইকা নিছে ২ লাখ টাকাআওয়ামী লীগ দেশ চালাবো কেমনে? পারবো না
র‌্যাব বিষয়ে আপনার কী মত? সাধারণ মানুষ কি র‌্যাব চায়?’ আমি জানতে চাইলাম
তার স্পষ্ট মত হলো, ‘র‌্যাব দরকার আছের‌্যাব আছে বইলাই চাঁদাবাজগোর উৎপাত কমএখন কম চাঁদা দিতে অয়তবে মুশকিল হইল নকল র‌্যাবএরা ঘুষ নিয়া মানুষ মাইরা দেয়এরাই সরকাররে ডুবাইতাছে
জ্যাম-জটহীন রাস্তায় আলাপে আলাপে অল্পক্ষণেই আমার গন্তব্য বাবর রোডে পৌঁছে গেছি আমরানামবার আগে তার প্রতি আমার সর্বশেষ প্রশ্ন করলাম, ‘আগামীবার কারা নির্বাচিত হবে?’
এইটা আল্লায় জানে’, সে বলল
২.
গত সপ্তাহে একটা অফিসিয়াল ট্যুরে একদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিলএকটা ভাড়া গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে যাচ্ছিসিগন্যালে গাড়ি থেমেছেহঠাৎ চোখ গেল সড়কদ্বীপের দিকেদুটি শিশুবালককে দেখা গেল পালা করে একটা পলিথিনের প্যাকেট ফুলাচ্ছে
কী করে ওরা! খেলছে নাকি!ওদের দিকে তাকিয়ে আমি আনমনেই উচ্চারণ করে ফেললাম
গাড়িতে থাকা কলিগ ফেরদৌস বলল, ‘ওরা ড্রাগ নিচ্ছে
আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা ড্রাগ নেবার পয়সা পায় কোত্থেকে?’
ফেরদৌস জানায়, ‘এটা করতে খুবই কম পয়সা লাগে আপাজুতার সোল লাগাতে যে সলিউশন ব্যবহার করে, ওটা পুড়ালে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, এরা ওটাই ইনহেল করছে
কথায় কথায় জানা গেল, কাঠমিস্ত্রিরা তাদের কাজে যে সস্তা স্পিরিট ব্যবহার করে ওটাও নাকি নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় আজকালওই স্পিরিটটা ঝাঁকালে যে গন্ধ বেরোয়, সেটাই নাকি নেশার কাজ করে
আমি ভাবলাম, অন্য কথাআমাদের পত্রপত্রিকাগুলোকে প্রায়ই মাদকবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় দেখিকিন্তু ওরা তো এসব নিয়ে কখনোই প্রায় কিছু লিখে নাওরা বেশি তৎপর ট্রানজিট দেয়া না-দেয়া, দেশ বিক্রি করা না-করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া না-হওয়া ইত্যাদি নিয়েকিংবা বিদেশি হুইস্কি, ভোদকা, ওয়াইন ইত্যাদি নিয়েকার বাসায় কত বোতল বিদেশি মদ পাওয়া গেল সে নিয়ে তাদের প্রচুর কৌতূহলএ অভিযোগে মন্ত্রী, নেতা, ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমরা এমনকি মামলা হতেও দেখেছি
হুইস্কি, ভোদকা, ওয়াইন কতটা ক্ষতিকর কতটা নয় সে ব্যাপারে বিতর্ক আছেকিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর দ্রব্য নেশা হিসেবে গ্রহণ করে যেভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে আমাদের বেশি করে কথা বলা দরকারকিন্তু এ ব্যাপারে মিডিয়াকে প্রায়ই নীরব থাকতে দেখি  
এমন কেন হয়? মিডিয়া কি কেবল বড়োলোকদের স্বাস্থ্যভাবনায় মগ্ন থাকবে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলামদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ বা যারা আগামী সময়ে শ্রম দেবে তারা ক্ষতিকর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে অর্থনীতির চাকাটাই তো অচল হয়ে যাবেএদের রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ কই?
জবাবটাও নিজেই খুঁজতে চাইলামএদের এই নেশার জগতে আসার বড়ো একটা কারণ বিনোদনহীনতা ও খেলাধুলার সুযোগ না-থাকাএকে তো দারিদ্র্যজনিত হতাশা, তার ওপরে হতাশা কাটাবার জন্য দরকারি বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগের সঙ্কট কাটানো না-গেলে এ অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে না
আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলায় মগ্ন থাকবার অনেক সুযোগ পেয়েছিকী গ্রাম কী শহর উভয় ক্ষেত্রেই এখন খেলাধুলার সুযোগ অনেক কমে গেছেগ্রামে যেমন এখন আর গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হাডুডু, বৌচি, ডাংগুলি, কেরামবোর্ড, লুডু, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা নেই, নেই শহরেওশহরের পাশাপাশি কয়েকটা মহল্লাজুড়ে একটিও খেলার মাঠ নেইযেখানে আছে, তারও নেই ব্যবহারোপযোগিতাএরকম অবস্থায় আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে করবেটা কী? বাধ্য হয়ে ওরা হয় কম্পিউটার গেমে ডুবে থাকে, নয় বাইরে গিয়ে গাঁজা-ফেনসিডিলের আড্ডায় মেশে
এদের বাইরে শহরে যারা ঘরহীন ছিন্নমূল, তাদের ক্ষেত্রে বিনোদন বা খেলাধুলার সুযোগ প্রায় অসম্ভবখেলার মাঠ থাকলেও ওদের সেখানে কমই প্রবেশাধিকার থাকেএরা প্রায়ই মা-বাবার সন্ধান জানে না, অথবা জানলেও তাদের থেকে আলাদা থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়এদের যে ধরনের হতাশাজনক অবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়, সেখানে জুতার আঠা দিয়ে ইনহেল করাকে খুব স্বাভাবিকই মনে হয়
ভাবি, এদের রক্ষায় সরকার ও আমাদের অনেক কিছুই করবার আছে