হরতালের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলবার জন্য এই লেখা নয়, কথার সূত্রপাত যদিও হরতাল থেকেই।
হরতালে অফিসে না-গিয়ে কাজ বন্ধ করে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তবে হরতালে গাড়ি নিয়ে পথে বেরোনো ঝুঁকিপূর্ণ বলে এ দিনগুলোতে আমি সাধারণত সিএনজি অটোরিক্সার সেবা নিয়ে থাকি। ২২ সেপ্টেম্বরের হরতালের দিনও তাই করতে হলো। অটোরিক্সা মিটারে চলবে এরকম আশা এখন সম্পূর্ণই দুরাশা। এজন্য জিজ্ঞেস করতে হলো ভাড়ার কথা।
ড্রাইভার ১২০ টাকা হাঁকলো। বনানী থেকে মোহাম্মদপুর যেতে এই ভাড়া হয়ত খুব বেশি না, যদিও মিটারে গেলে এর চেয়ে কমই লাগবার কথা। তবু উঠে বসলাম, যেতে তো হবে।
বললাম, ‘আজকে তো রাস্তা ফাঁকা, জ্যাম নেই, সেক্ষেত্রে ভাড়া তো আরো কম হওয়া উচিত।’
ড্রাইভার বলল, ‘আপা, হরতালের কথা বলে ভাড়া কম দিতে চাইতেছেন। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না যে, এই গাড়িটা রাস্তায় নামাইতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগছে। মাত্র চাইর দিন হইল গাড়ির বয়স। এত টাকা দিয়া গাড়ি কিনতে হয় বইল্যাই মালিক আমদানিও বেশি নেয়। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার জন্য আমদানি সাতশ টাকা, রাতের জন্য সাড়ে তিনশ থেকে চারশ। এর কম ভাড়ায় আমগোর পুষাবো কেমনে?’ অকাট্য যুক্তি তার।
কৌতূহল জাগল অটোরিক্সার দাম নিয়ে। বললাম, ‘এত ছোটো গাড়ি রাস্তায় নামাতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগবার তো কথা না!’
ড্রাইভার জানাল ঘুষের কথা। বলল, ‘আপনি তো জানেন, বর্তমানে সিএনজির লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ। সেইজন্য এই লাইসেন্সটা পাইতে অনেক টাকা লাগছে। গাড়ির ইঞ্জিন-বড়ি-নেট এইসব লাগাইতে সোয়া পাঁচ লাখের মতো লাগলেও বাকি টাকা গেছে নানা ঘাটে ঘুষ দিতে দিতে। এই টাকাটা তো তার উঠানো লাগবো। এই জন্যই মালিকরা আমদানি বেশি ধরে।’
তার কথাবার্তা ঘুরে ফিরে আবার হরতালের দিকে এলে বললাম, ‘হরতালটা কেন হচ্ছে?’
সরাসরি জবাবে না-গিয়ে সে বলল, ‘পথঘাট স্বাভাবিক, গাড়ি-ঘোড়া কম, গণ্ডগোল দেখলাম না কোনোখানে। তবে ওইদিন জামাত যে কাজটা করল, সেইটা একদম ঠিক করে নাই। পুলিশ চাইলে আগেই ঠেকাইতে পারত। কিন্তু তারা সেইটা করে নাই। আগে মাইর খাইছে, পরে মাইর দিছে। এতে অনেক ক্ষতি হইছে। এত গাড়ি পোড়াইলো, কিন্তু এইটা নিয়া মানুষ কথা কয় না। অবশ্য পুলিশ আগে মারলে বলত, পুলিশই উসকানি দিছে।’
বললাম, ‘জামায়াত যে ইসলামের কথা বলে, এই ব্যাপারে আপনার মত কী?’
প্রশ্ন শুনে উসকে উঠল সে, ‘আরে রাখেন জামাত। এরা সব শয়তানের চ্যালা। আমার এলাকার মসজিদের এক জামাতি ইমাম, মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়, মনে হয় ফেরেশতা, কিন্তু মসজিদের লাইট-ফ্যান সব বিক্রি কইরা খাইয়া ফেলে। গত আওয়ামী লীগ সরকার মসজিদে কিছু টিন দিছিলো। সে ওই টিন বাড়িতে খাটাইয়া মসজিদে লাগাইছে খারাপ টিন। এলাকার টাকাপয়সাওয়ালা লোকজন শখ কইরা মানত কইরা মুসল্লিদের সুবিধার জন্য লাইট-ফ্যান-মাইক দেয়, কিন্তু সে বিক্রি কইরা দেয়। মাঝে মাঝে লোকজন নামাজের শেষে মসজিদের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবার চেষ্টা করলে ইমাম সাব লাঠিয়াল সাঙ্গপাঙ্গ ডাকে। সে আরো যোগ করে, জামাত নামাজ পড়া, ধর্মপালন করা নিয়া বড়ো বড়ো কথা কয়, কিন্তু এরা শয়তানের হাড্ডি। ঘুষ, চুরি, মেয়েমানুষ খাওয়া থেকে শুরু করে সবটাই করে।’
জানতে চাইলাম, ‘বাড়ি কোথায় আপনার?’
‘ফরিদপুর।’ তারপর সে হেসে ফেলে এবং বলে, ‘ফরিদপুর হইলে কী হইবো, আমার এলাকা কিন্তু বিএনপির ঘাঁটি। কামাল সাব খুব ভালা মানুষ। কিন্তু তার পার্টি বিএনপি ভালা না। সে গরিব লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, বর্ষায় জনসাধারণের চলাচলের জন্য ট্রলার দেয়।’
এ কথায় তার রাজনীতি সম্পর্কে একটু সংশয়ে পড়ে গেলাম। আরেকটু খোলাসা হতে ইচ্ছে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে কেমন?’
‘না, চালাইতে পারতেছে না’, সে বলল। ‘বিশেষ কইরা পুলিশ প্রশাসন একদমই চালাইতে পারতেছে না।’ এই মতের সঙ্গে সে ব্যাখ্যাও যুক্ত করল। বলল, ‘কেমনে পারবো, সরকার আওয়ামী লীগ হইলেও পুলিশ, সরকারি অফিসার অনেকেই বিএনপি-জামাতের। আমার এলাকার থানায় যত পুলিশ অফিসার একের পর এক বদলি হইয়া আইছে, তারা সবাই বিএনপির। এরা সরকারের কথা মানে না। তার চাইতে সরকারকে ডোবানোর জন্য কাজ করে।’ সে আরো বলল, ‘বিএনপির হাতে অনেক টাকা। ধরেন আমার এই গাড়ির মালিকের কথাই। সে বিএনপির ৩০ জনরে চাকরি দিছে। প্রত্যেকের কাছ থেইকা নিছে ২ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ দেশ চালাবো কেমনে? পারবো না।’
‘র্যাব বিষয়ে আপনার কী মত? সাধারণ মানুষ কি র্যাব চায়?’ আমি জানতে চাইলাম।
তার স্পষ্ট মত হলো, ‘র্যাব দরকার আছে। র্যাব আছে বইলাই চাঁদাবাজগোর উৎপাত কম। এখন কম চাঁদা দিতে অয়। তবে মুশকিল হইল নকল র্যাব। এরা ঘুষ নিয়া মানুষ মাইরা দেয়। এরাই সরকাররে ডুবাইতাছে।’
জ্যাম-জটহীন রাস্তায় আলাপে আলাপে অল্পক্ষণেই আমার গন্তব্য বাবর রোডে পৌঁছে গেছি আমরা। নামবার আগে তার প্রতি আমার সর্বশেষ প্রশ্ন করলাম, ‘আগামীবার কারা নির্বাচিত হবে?’
‘এইটা আল্লায় জানে’, সে বলল।
২.
গত সপ্তাহে একটা অফিসিয়াল ট্যুরে একদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। একটা ভাড়া গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে যাচ্ছি। সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। হঠাৎ চোখ গেল সড়কদ্বীপের দিকে। দুটি শিশুবালককে দেখা গেল পালা করে একটা পলিথিনের প্যাকেট ফুলাচ্ছে।
‘কী করে ওরা! খেলছে নাকি!’ ওদের দিকে তাকিয়ে আমি আনমনেই উচ্চারণ করে ফেললাম।
গাড়িতে থাকা কলিগ ফেরদৌস বলল, ‘ওরা ড্রাগ নিচ্ছে।’
আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা ড্রাগ নেবার পয়সা পায় কোত্থেকে?’
ফেরদৌস জানায়, ‘এটা করতে খুবই কম পয়সা লাগে আপা। জুতার সোল লাগাতে যে সলিউশন ব্যবহার করে, ওটা পুড়ালে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, এরা ওটাই ইনহেল করছে।’
কথায় কথায় জানা গেল, কাঠমিস্ত্রিরা তাদের কাজে যে সস্তা স্পিরিট ব্যবহার করে ওটাও নাকি নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় আজকাল। ওই স্পিরিটটা ঝাঁকালে যে গন্ধ বেরোয়, সেটাই নাকি নেশার কাজ করে।
আমি ভাবলাম, অন্য কথা। আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোকে প্রায়ই মাদকবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় দেখি। কিন্তু ওরা তো এসব নিয়ে কখনোই প্রায় কিছু লিখে না। ওরা বেশি তৎপর ট্রানজিট দেয়া না-দেয়া, দেশ বিক্রি করা না-করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া না-হওয়া ইত্যাদি নিয়ে। কিংবা বিদেশি হুইস্কি, ভোদকা, ওয়াইন ইত্যাদি নিয়ে। কার বাসায় কত বোতল বিদেশি মদ পাওয়া গেল সে নিয়ে তাদের প্রচুর কৌতূহল। এ অভিযোগে মন্ত্রী, নেতা, ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমরা এমনকি মামলা হতেও দেখেছি।
হুইস্কি, ভোদকা, ওয়াইন কতটা ক্ষতিকর কতটা নয় সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর দ্রব্য নেশা হিসেবে গ্রহণ করে যেভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে আমাদের বেশি করে কথা বলা দরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে মিডিয়াকে প্রায়ই নীরব থাকতে দেখি।
এমন কেন হয়? মিডিয়া কি কেবল বড়োলোকদের স্বাস্থ্যভাবনায় মগ্ন থাকবে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ বা যারা আগামী সময়ে শ্রম দেবে তারা ক্ষতিকর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে অর্থনীতির চাকাটাই তো অচল হয়ে যাবে। এদের রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ কই?
জবাবটাও নিজেই খুঁজতে চাইলাম। এদের এই নেশার জগতে আসার বড়ো একটা কারণ বিনোদনহীনতা ও খেলাধুলার সুযোগ না-থাকা। একে তো দারিদ্র্যজনিত হতাশা, তার ওপরে হতাশা কাটাবার জন্য দরকারি বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগের সঙ্কট কাটানো না-গেলে এ অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে না।
আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলায় মগ্ন থাকবার অনেক সুযোগ পেয়েছি। কী গ্রাম কী শহর উভয় ক্ষেত্রেই এখন খেলাধুলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। গ্রামে যেমন এখন আর গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হাডুডু, বৌচি, ডাংগুলি, কেরামবোর্ড, লুডু, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা নেই, নেই শহরেও। শহরের পাশাপাশি কয়েকটা মহল্লাজুড়ে একটিও খেলার মাঠ নেই। যেখানে আছে, তারও নেই ব্যবহারোপযোগিতা। এরকম অবস্থায় আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে করবেটা কী? বাধ্য হয়ে ওরা হয় কম্পিউটার গেমে ডুবে থাকে, নয় বাইরে গিয়ে গাঁজা-ফেনসিডিলের আড্ডায় মেশে।
এদের বাইরে শহরে যারা ঘরহীন ছিন্নমূল, তাদের ক্ষেত্রে বিনোদন বা খেলাধুলার সুযোগ প্রায় অসম্ভব। খেলার মাঠ থাকলেও ওদের সেখানে কমই প্রবেশাধিকার থাকে। এরা প্রায়ই মা-বাবার সন্ধান জানে না, অথবা জানলেও তাদের থেকে আলাদা থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়। এদের যে ধরনের হতাশাজনক অবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়, সেখানে জুতার আঠা দিয়ে ইনহেল করাকে খুব স্বাভাবিকই মনে হয়।
ভাবি, এদের রক্ষায় সরকার ও আমাদের অনেক কিছুই করবার আছে।
লেখাটি ৯ অক্টোবর তারিখে দৈনিক সমকালে ছাপা হয়েছে। লিংক হলো :
ReplyDeletehttp://www.samakal.com.bd/details.php?news=20&view=archiev&y=2011&m=10&d=09&action=main&menu_type=&option=single&news_id=198967&pub_no=837&type=