বাংলাদেশের বয়স ৪০ বৎসর পূর্ণ হলো। বহুবিধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চড়াই-উৎরাই অতিক্রমের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে আসা এই দেশে দীর্ঘ নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭-এ সর্বপ্রথম এ দেশের নারীসমাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একটি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০৪-এ তদানীন্তন সরকার ঘোষিত এই নীতির হাত-পা ভেঙ্গে খোঁড়া করে ফেলে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের বিষয়ে যেসব অঙ্গীকার ব্যক্ত রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৯৭-এ নারীনীতি ঘোষিত হয়েছিল। সেই সমঅধিকারের বিষয়গুলো ঘোষিত নীতি থেকে ছেঁটে ফেলা হয় গত জোট সরকারের আমলে।
১৯৯৭-এর নারীনীতি পুনর্বহালের দাবিতে নারীসমাজ পুনরায় সংগ্রামে নামে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার আশ্বাস দিলেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকির মুখে এটাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা না করে হিমঘরে তুলে রাখে। বর্তমান সরকার বিপুল ভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এলে নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে নারীসমাজের পক্ষ থেকে একই দাবি তোলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ৮ মার্চ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা করেন। ঘোষিত এই নীতিতে সরকার ‘অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’র কথা বলেছেন। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি ‘উত্তরাধিকারে সমঅধিকার’ থেকে সরকার যদিও সরে দাঁড়িয়েছে, তবু কিছু কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এই নারীনীতিকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।
নারী আন্দোলনের অনেকেই উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার ব্যপারটায় সন্তুষ্ট হন নি; এই জন্য যে, সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার ও সমানাধিকারের যে বিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ২০১১-এর নারীনীতি তার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশেষ করে উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার প্রসঙ্গটা। এর ফলে যে শুধু নারী-পুরুষ ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য হবে তা নয়, বরং বিভিন্ন ধর্মের নারীদের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। কারণ বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইনে নারীর অংশে বিভিন্নতা রয়েছে। তার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের উত্তরাধিকারে কোনো অংশই নেই। এর পরও নারী আন্দোলন মনে করে, ঘোষিত ২০১১-এর নারীনীতিতে উত্তরাধিকারে নারীকে সমঅধিকার না দিলেও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য যেটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পদক্ষেপ, নতুন আইন বিশেষ করে বিভিন্ন সূত্রে অর্জিত সম্পদ ও সম্পত্তিতে অধিকার ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরিভাবে প্রয়োজন। এই নীতি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা এখন অন্যতম প্রধান কাজ।
সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি, যারা এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোরহস্তে গ্রহণ করতে হবে। ধর্মের/ইসলামের অজুহাতে যে গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করছে তাদের পরিচয় নূতন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের পরিচয় জাতির কাছে স্পষ্ট। যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন যে,
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর যে অংশটি নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন (নারীনীতির অনুচ্ছেদ ২৫ এর ২৫.২ উপ-অনুচ্ছেদের হুবহু ভাষ্য : ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’)। এখানে উত্তরাধিকারে সমানাধিকারের কথা কোথাও বলা হয় নি; বলা হয়েছে, উল্লিখিত বিভিন্ন সূত্রে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার’ প্রদানের কথা। অথচ অনর্থকই তারা ‘কোরানবিরোধী আইন করা হচ্ছে’ গুজবে বিশ্বাস করে নানারকম হুমকি-ধামকি দিয়ে চলেছেন। কানে হাত না দিয়ে কান নিয়েছে অজুহাতে চিলের পিছনে দৌড়ানো ছাড়া একে আর কী বলা যায়!
দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার দলীয় অনেককেও (পুরুষ) বলতে শোনা যায়, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরুর প্রাক্কালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ঘোষণা দিয়ে উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তারা ‘ভোট’-এর রাজনীতির কথা চিন্তা করে হয়তো কথাটি বলছেন। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভোটারদের অর্ধেক নারী। বর্তমানে নারী নির্যাতনের যেসব নৃশংস পন্থা প্রয়োগের খবর পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, তার মৌলিক প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা; যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীর অধস্তন অবস্থা তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করে এবং নারীকে পরিবারের (বাবা বা স্বামীর) বোঝা হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই মানসিকতাই নারীকে অক্ষম ও দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবার, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে নির্যাতন বা আক্রমণের সহজ টার্গেটে পরিণত করে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে কেবল নির্যাতনবিরোধী আইন তৈরি ও তার প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, বরং এর উৎসভূমিতে আমাদের হাত দিতে হবে; অর্থাৎ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নির্যাতন ছাড়াও নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার রয়েছে আর্থ-সামাজিক আরো নানা কুফল। যেমন যারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য বা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন তাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, উত্তরাধিকার ও সম্পদে মেয়েসন্তানের সমঅধিকার এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকায় পরিবারপ্রতি ‘দুই সন্তান’ নীতিটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। দুই সন্তান মেয়ে হলে কেবল পুত্রের আশায় পরিবারপ্রতি সন্তানের সংখ্যা কখনো কখনো সাত-আটজনকেও ছাড়িয়ে যায়! শুধু তাই নয়, কেন পুত্রসন্তান জন্ম দিতে পারে না সে কারণে পরিবারে স্ত্রীর ওপর নানামাত্রার নির্যাতনের খড়্গও নেমে আসে, যদিও শিশু মেয়ে কী ছেলে হবে তা নির্ধারণের দায়দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। এ ছাড়াও এর ফলে আরেকটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়-- কন্যাসন্তান যখন হয় কোনো পিতামাতার একমাত্র সন্তান, তখন ওই পরিবারের সম্পদের ওপর আত্মীয়স্বজন উত্তরাধিকার দাবি করে থাকে, যা প্রায়শই পারিবারিক-সামাজিক কলহ, হত্যা, মামলা পর্যন্ত গড়ায়। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখি এবং আইনজীবীদের কাছ থেকেও এই অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য মেলে।
সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যদি আমরা গণতন্ত্র দেখতে চাই, তা হলে পরিবারে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ মানুষের আচার-আচরণ বিষয়ক শিক্ষাটা পরিবার থেকেই শুরু হয়। এই অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী আচার-আচরণ ওসব পরিবারের সদস্যরা সর্বত্রই প্রয়োগ করেন, তা তিনি রাজনৈতিক দল বা আমলাতন্ত্র বা যেকোনো পেশায়ই যান না কেন। পরিবারে গণতন্ত্র তখনি সম্ভব যখন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে, নারীও পরিবারের সম্পদের সমান ভাগিদার হবে ও সেই সম্পদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধানে প্রদত্ত সকল নাগরিকের সমানাধিকারের প্রসঙ্গ এ আলোচনায় মুখ্যই থেকে যায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নের মূল ফলশ্রুতি একই-- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন।
১৯৯৭-এর নারীনীতি পুনর্বহালের দাবিতে নারীসমাজ পুনরায় সংগ্রামে নামে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার আশ্বাস দিলেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকির মুখে এটাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা না করে হিমঘরে তুলে রাখে। বর্তমান সরকার বিপুল ভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এলে নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে নারীসমাজের পক্ষ থেকে একই দাবি তোলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ৮ মার্চ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা করেন। ঘোষিত এই নীতিতে সরকার ‘অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’র কথা বলেছেন। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি ‘উত্তরাধিকারে সমঅধিকার’ থেকে সরকার যদিও সরে দাঁড়িয়েছে, তবু কিছু কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এই নারীনীতিকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।
নারী আন্দোলনের অনেকেই উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার ব্যপারটায় সন্তুষ্ট হন নি; এই জন্য যে, সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার ও সমানাধিকারের যে বিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ২০১১-এর নারীনীতি তার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশেষ করে উত্তরাধিকারে সমানাধিকার না দেয়ার প্রসঙ্গটা। এর ফলে যে শুধু নারী-পুরুষ ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য হবে তা নয়, বরং বিভিন্ন ধর্মের নারীদের মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। কারণ বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইনে নারীর অংশে বিভিন্নতা রয়েছে। তার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের উত্তরাধিকারে কোনো অংশই নেই। এর পরও নারী আন্দোলন মনে করে, ঘোষিত ২০১১-এর নারীনীতিতে উত্তরাধিকারে নারীকে সমঅধিকার না দিলেও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য যেটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পদক্ষেপ, নতুন আইন বিশেষ করে বিভিন্ন সূত্রে অর্জিত সম্পদ ও সম্পত্তিতে অধিকার ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরিভাবে প্রয়োজন। এই নীতি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা এখন অন্যতম প্রধান কাজ।
সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি, যারা এই জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোরহস্তে গ্রহণ করতে হবে। ধর্মের/ইসলামের অজুহাতে যে গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করছে তাদের পরিচয় নূতন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের পরিচয় জাতির কাছে স্পষ্ট। যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন যে,
- মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গোষ্ঠীই লাখ লাখ নারী ধর্ষণ, ত্রিশ লাখ মানুষ নিধন এবং বাংলাদেশের তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটিকেই ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছিল।
- এই গোষ্ঠী কখনোই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এ দেশীয় রাজাকারদের এহেন মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধকে ইসলামবিরোধী বলেছেন বলে কেউ শোনে নি।
- ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনের পর অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু এ ধরনের জঘন্য অপরাধ যে ইসলামবিরোধী এই কথা কখনো তাদের কেউ উচ্চারণও করেন নি।
- এখনো অনেক নারী ধর্ষিত হচ্ছেন, বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এগুলো যে ইসলামবিরোধী কাজ সে সম্পর্কে কখনো তারা কোনো উচ্চবাচ্য করছেন না।
- তারা পাহাড়সমান দুর্নীতি আর মুনাফা লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন না, বলছেন না যে এগুলো ইসলামবিরোধী। এর বিরুদ্ধে তারা মাঠেও নামছেন না।
- ছোটবেলায় ফতোয়া শুনেছি, ছবি তোলা, মাইকে আজান দেয়া ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কাজ, এখন তারা ওই কাজগুলো হরহামেশাই করছেন দেখতে পাই।
- কয়েকদিন আগেই পত্রিকায় দেখা গেল, সৌদি সরকার ঘোষণা দিয়েছে বিক্ষোভ ও সরকারবিরোধী আন্দোলন ইসলামবিরোধী। তারা এ সম্পর্কেও কিছু বলছেন না।
নারীনীতি বাস্তবায়নের দাবিতে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি আয়োজিত গণজমায়েতে অংশগ্রহণকারী বিএনপিএস দলসদস্যদের একাংশ |
দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার দলীয় অনেককেও (পুরুষ) বলতে শোনা যায়, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরুর প্রাক্কালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ঘোষণা দিয়ে উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তারা ‘ভোট’-এর রাজনীতির কথা চিন্তা করে হয়তো কথাটি বলছেন। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভোটারদের অর্ধেক নারী। বর্তমানে নারী নির্যাতনের যেসব নৃশংস পন্থা প্রয়োগের খবর পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, তার মৌলিক প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা; যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীর অধস্তন অবস্থা তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করে এবং নারীকে পরিবারের (বাবা বা স্বামীর) বোঝা হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই মানসিকতাই নারীকে অক্ষম ও দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবার, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে নির্যাতন বা আক্রমণের সহজ টার্গেটে পরিণত করে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে কেবল নির্যাতনবিরোধী আইন তৈরি ও তার প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, বরং এর উৎসভূমিতে আমাদের হাত দিতে হবে; অর্থাৎ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নির্যাতন ছাড়াও নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার রয়েছে আর্থ-সামাজিক আরো নানা কুফল। যেমন যারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য বা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন তাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, উত্তরাধিকার ও সম্পদে মেয়েসন্তানের সমঅধিকার এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকায় পরিবারপ্রতি ‘দুই সন্তান’ নীতিটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। দুই সন্তান মেয়ে হলে কেবল পুত্রের আশায় পরিবারপ্রতি সন্তানের সংখ্যা কখনো কখনো সাত-আটজনকেও ছাড়িয়ে যায়! শুধু তাই নয়, কেন পুত্রসন্তান জন্ম দিতে পারে না সে কারণে পরিবারে স্ত্রীর ওপর নানামাত্রার নির্যাতনের খড়্গও নেমে আসে, যদিও শিশু মেয়ে কী ছেলে হবে তা নির্ধারণের দায়দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নয়। এ ছাড়াও এর ফলে আরেকটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়-- কন্যাসন্তান যখন হয় কোনো পিতামাতার একমাত্র সন্তান, তখন ওই পরিবারের সম্পদের ওপর আত্মীয়স্বজন উত্তরাধিকার দাবি করে থাকে, যা প্রায়শই পারিবারিক-সামাজিক কলহ, হত্যা, মামলা পর্যন্ত গড়ায়। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখি এবং আইনজীবীদের কাছ থেকেও এই অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য মেলে।
সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যদি আমরা গণতন্ত্র দেখতে চাই, তা হলে পরিবারে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ মানুষের আচার-আচরণ বিষয়ক শিক্ষাটা পরিবার থেকেই শুরু হয়। এই অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী আচার-আচরণ ওসব পরিবারের সদস্যরা সর্বত্রই প্রয়োগ করেন, তা তিনি রাজনৈতিক দল বা আমলাতন্ত্র বা যেকোনো পেশায়ই যান না কেন। পরিবারে গণতন্ত্র তখনি সম্ভব যখন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে, নারীও পরিবারের সম্পদের সমান ভাগিদার হবে ও সেই সম্পদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধানে প্রদত্ত সকল নাগরিকের সমানাধিকারের প্রসঙ্গ এ আলোচনায় মুখ্যই থেকে যায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নের মূল ফলশ্রুতি একই-- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন।
চমৎকার লেখা।
ReplyDeleteধর্মব্যবসায়ীদের কঠোরহস্তে দমন করা দরকার।