Monday 27 May 2013

পোশাকশ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা

প্রায় ৬,০০০ পোশাক কারখানা আর ৩৬ লাখ কর্মরত শ্রমিক নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাক শিল্প, শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই যেখানে নারী। কিন্তু কারখানা-মালিক আর শ্রমিকরাই এই খাতের একমাত্র দেশীয় কুশীলব নন। প্রায় ২,০০০ কোটি ডলারের এই খাতের পেছনে সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং নীতিমালা এই খাতে বিগত তিন দশকে বড়ো ভূমিকা পালন করে এসেছে; যা অধিকাংশ সময় আলোচনায় আসে না। এই খাতে জনগণের অর্থে প্রদত্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সুফল এ পর্যন্ত ৩৬ লাখ শ্রমিকের বদলে প্রধানত মালিকদের স্বার্থ রক্ষায়ই ব্যয়িত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া, বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ও অবহেলাজনিত কারণে সবচেয়ে বড়ো-বড়ো দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে পোশাক কারখানাগুলোতেই; যার শিকার হয়েছে এই খাতে কর্মরত শ্রমিক এবং তাদের পরিবার-পরিজনরাই। গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার পাঁচটি পোশাক কারখানার ১১২৭ জন শ্রমিকের প্রাণহানি, কয়েক শত নিখোঁজ এবং আড়াই হাজার গুরুতরভাবে আহত হবার ঘটনা এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন। তাই, আজ শ্রমিকদের মঙ্গলের জন্য করণীয় নির্ধারণের এবং জনগণের অর্থ আরো কার্যকরভাবে ব্যবহারের, বিশেষত মালিকদের পরিবর্তে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজে লাগাবার বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে।

পোশাকশিল্প খাতের অব্যবস্থাপনা এবং শ্রমিকদের প্রতি সরকার ও মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি 

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের সাম্প্রতিক বিকাশের পেছনে সমভাবে অন্যতম ভূমিকা আছে এ খাতে কর্মরত নারী-পুরুষ শ্রমিকদের। দুঃখজনকভাবে এই শ্রমিকদের খুব কম মজুরিতে এবং নিপীড়নমূলক কর্মপরিবেশে কাজ করতে হয়। শ্রমিকস্বার্থ রক্ষায় সরকারি উদাসীনতা, দরকষাকষির জন্য ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিসহ শ্রমিক-মালিক স্বার্থরক্ষায় ভারসাম্যহীন একদেশদর্শী পরিবেশ মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ দেয়ায় শ্রমিকরা জীবনধারণ-উপযোগী ন্যূনতম মজুরি ও সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভয়ানকভাবে। এসব কারণে একতরফা শ্রমিক শোষণের সুযোগ নিয়ে মালিকরা সম্পদের পাহাড় গড়লেও শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তার কোনো উন্নতি হয় নি। গত প্রায় দুই দশকে কয়েকবার মজুরি সমন্বয় করা হলেও মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় আয়ের হিসাবে তাদের শ্রমের দাম প্রকৃতঅর্থে বাড়ে নি। একইভাবে নিশ্চিত হয় নি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম আবাসন, চিকিৎসা, যাতায়াত, নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তার মতো মৌলিক বিষয়গুলোও।

৮০’র দশকে গড়ে ওঠা এ শিল্পে প্রথমবারের মতো ১৯৯৪ সালে শ্রমিকদের জন্য মাত্র ৯৬০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০০৬ সালে তা ১ হাজার ৬৬২ টাকা ও ২০১০ সালে ৩০০০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। সকল ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও তিন বছর ধরে এই মজুরিই বহাল রয়েছে। শ্রমিক অধিকার কনসোর্টিয়ামের (ডব্লিউআরসি) তথ্যমতে, এই মজুরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। এখানে শ্রমিকদের গড় মজুরি ঘণ্টাপ্রতি ২৪ সেন্ট, যেখানে পাকিস্তানে বাংলাদেশের দ্বিগুণ ৫২ সেন্ট, কম্বোডিয়ায় ৪৫ সেন্ট, ভিয়েতনামে ৫৩ সেন্ট ও চিনে ১ দশমিক ২৬ ডলার।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যেখানে ‘লিভিং ওয়েজ’কে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে একজন শ্রমিকের মাসে ৩০০০ টাকা বেতন কোনো অবস্থাতেই বর্তমান বাজারে ‘লিভিং ওয়েজ’ বা জীবনধারণ-উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারে না। আশার কথা, সাভার দুর্ঘটনার পর অতি সম্প্রতি বর্তমান সরকার নতুন করে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে, যে বোর্ডের সুপারিশ পহেলা মে থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের গ্রুপ বিমা ও ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা রেখে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। আশা করা যায়, এসব বিধান অনতিবিলম্বে কার্যকর করবার ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পোশাক কারখানায় বিদ্যমান অব্যবস্থাপনার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো, দেশের পোশাক কারখানাগুলোর একটা বড়ো অংশই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অমান্য করে নির্মিত আবাসিক ভবনে স্থাপিত, যেখানে জীবনের নিরাপত্তা বিধানকারী সামগ্রী (পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিকল্প সিঁড়ি, সতর্কতা সংকেত প্রদান যন্ত্র, ইত্যাদি) ও ব্যবস্থা (বাধাহীন প্রশস্ত নির্গমন পথ, দৃশ্যমান স্থানে বহির্গমন চিহ্ন, সর্বদা তালামুক্ত গেট, আত্মরক্ষার মহড়া, ইত্যাদি) অংশত বা সম্পূর্ণত অনুপস্থিত। এসবে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মালিকশ্রেণির নির্মম অবহেলাই প্রকাশ পায়। যে কারণে একের পর এক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো দুর্ঘটনায়, তা সে অগ্নিকাণ্ড, অগ্নি আতঙ্ক, বা ভবনধস যাই হোক, ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককেই হতাহত হতে হচ্ছে। এবং দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি এরকম ঘটনায়ই মালিকপক্ষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিচারের আওতার বাইরে থেকে যান। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে মালিকরা বিমাসুবিধা পেলেও আহত ও নিহত শত-সহ¯্র শ্রমিকের জন্য কোনো বিমাসুবিধা থাকে না। প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বড়ো বড়ো বিপর্যয়ের পর মালিকপক্ষের ক্ষতিপূরণ আহত শ্রমিক ও নিহতদের আত্মীয়স্বজন বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও পায় না। যদি কেউ পায়ও সে ক্ষতিপূরণ আন্তর্জাতিক মানদ-ে যথার্থ হওয়া দূরে থাক, যেকোনোভাবে পুনর্বাসনের নিশ্চয়তাটুকুও দেয় না। ফলে বাধ্য হয়ে জনগণের পয়সায় সরকারকেই নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবার উদ্যোগ নিতে হয়। এভাবে মালিকদের গাফিলতির দায়দায়িত্ব-- ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ব্যয়, উদ্ধার কাজের ব্যয়-- সরকার বা জনগণকেই বহন করতে হয়।

জীবনের পাশাপাশি চাকুরির নিরাপত্তাহীনতাও পোশাক কারখানার এক বেদনাকর বাস্তবতা। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র পর্যন্ত দেয়া হয় না। নিয়মিত বেতন ও অতিরিক্ত কাজের পাওনা নিয়ে শ্রমিকরা নিয়মিত হয়রানি ও অনিশ্চয়তার মুখে থাকেন। শ্রমিকদের আবাসন সমস্যা তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করার ক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা। মাসিক বেতনের সিংহভাগ ব্যয় করে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। উপরন্তু, চলতি বাজার দরের সাথে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কোনো সমন্বয় ছাড়াই তাদেরকে অতিরিক্ত ঘর ভাড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়ের ধকল পোহাতে হয়, যা কার্যত তাদের জীবনমানকে ক্রমশই নিম্নমুখী করে রাখে। অধিকাংশ কারখানায় নারীশ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না; সংবাদসূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় একাধিক অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিক আহত হন, যাদের দুজন দুর্ঘটনাস্থলেই সন্তাব প্রসব করেন। নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে খুব কম পোশাক কারখানাতেই। এছাড়া নারীশ্রমিকদের চলাচলের নিরাপত্তাহীনতাও একটি বড়ো সমস্যা; এজন্য তাদের নিয়মিতভাবে যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণ-হত্যার মতো সহিংসতার শিকার হতে হয়।

এখানে অতি সংক্ষেপে পোশাকশ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে যা বিবৃত হয়েছে, তার সমাধানে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নেয়া পোশাক খাত এবং এখানে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

মালিকপক্ষের প্রতি সরকারি সম্পদ ও সুবিধাপ্রবাহ

পোশাক খাত নিয়ে যেকোনো আলোচনাতেই কারখানা-মালিকরা নিজেদের উদ্যোক্তা ভূমিকাকে বড়ো করে হাজির করে থাকেন। এই খাতে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ সবার অবদানকে খাটো ও অস্বীকার করার জন্য তারা নিয়মিতভাবে সকলকে দোষারোপ করে থাকেন। এই খাতের ভূমিকা ও গুরুত্ববিষয়ক যেকোনো আলোচনায় সাধারণত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি সচেতনভাবে সামনে না-এনে তা এড়িয়ে যাওয়া হয় বা আড়াল করা হয়। বিশেষ-বিশেষ সময়ে, বিরল কিছু গবেষণায়, সরকারি পরিসংখ্যানে এগুলো আচমকা সামনে উঠে আসে। অতি সম্প্রতি পোশাকশিল্প তো বটেই, দেশের সামগ্রিক শিল্পখাতের সবচেয়ে বড়ো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটার পর, বলা যায় যে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমে ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা’ বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও পরিসংখ্যান এবং গবেষক, সরকারি ও ব্যাংক কর্মকর্তা প্রমুখের স্পষ্ট কথাবার্তা সাধারণ মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়েছে (সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদনসমূহ উল্লেখ্য) । দেশ-বিদেশের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যমে  বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এর মালিকদের জীবনযাত্রা, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ প্রভৃতি নিয়ে আলোড়ন তৈরি করা প্রতিবেদন জনসমক্ষে উঠে আসছে।

দেখা যায়, শ্রমিকরা অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হলেই নিজেদের ‘দুরবস্থা’, বিদেশি ষড়যন্ত্র, শ্রমিক অসন্তোষ, অবকাঠামোগত নানা অভিযোগ তুলে মালিকগোষ্ঠী মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মালিকরা প্রায়ই ‘জিরো ক্যাপিটাল’ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে রপ্তানির কাজ পেলে ব্যাংকই পুঁজির ব্যবস্থা করে দেয়; যেমন বিদেশ থেকে কাপড় বা সুতা আনতে অথবা দেশের মধ্য থেকে তা সংগ্রহ করতে ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’ অথবা স্থানীয় ঋণপত্রের অর্থ ব্যাংকই জোগায়। আনুষঙ্গিক উপকরণ (এক্সেসরিজ) আনতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পান পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। আবার ইসিসি বা এক্সপোর্ট ক্যাশ ক্রেডিটের (রপ্তানির জন্য নগদ ঋণ) নামে এলে শ্রমিকের মজুরির অর্থও জোগায় ব্যাংক। ব্যাক টু ব্যাক ও ইসিসির সুদের হার ১৩ শতাংশ। দেশের অন্য কোনো খাতের উদ্যোক্তাদের এই ঋণ নিতে সুদ দিতে হয় অনেক বেশি।

একমাত্র পোশাক খাতের জন্যই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কোনো এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ছাড় দিয়েছে। কেবল তা-ই নয়, পোশাক খাতের ২৭০টি রুগ্ণ শিল্পের আসল ঋণ ও সুদ মওকুফ এবং ঋণকে ব্লক (একটি হিসেবে রেখে) করে রেখে নতুন সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন-- বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-- বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের একতরফা প্রচারণা চালিয়ে সরকারের ওপর সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের এই প্রভাব এবং রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে মালিকরা প্রথম থেকে ‘নীতি-সহায়তা’ নামের আড়ালে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করে আসছে জনগণের করের টাকায়।

বিগত পাঁচ বছরে রপ্তানিমুখী বস্ত্র খাতের মালিকেরা সরকারি কোষাগার থেকে চার হাজার ২১৫ কোটি টাকার নগদ সহায়তা নিয়েছেন। চলতি অর্থবছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, ৯২৩ কোটি দুই লাখ টাকার নগদ সহায়তা নিয়েছেন বস্ত্র ও পোশাক খাতের মালিকেরা। গত অর্থবছরে (২০১১-’১২) এ খাতে ১ হাজার ৪১২ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। এর আগের বছর এ পরিমাণ ছিল ৮৭৭ কোটি ১১ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অর্থকরী খাত সরকারকে যে পরিমাণ কর দেয়, তার দশ ভাগের এক ভাগও পোশাক খাত থেকে সরকার পায় না। পোশাকশিল্প মালিকদের কাছ থেকে সরকার আয়করও পায় অতি সামান্য। অর্থাৎ, উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরাই সবচেয়ে বেশি করসুবিধা পেয়ে থাকেন। রপ্তানির সময় উৎসে কর হিসেবে মাত্র দশমিক ৮ শূন্য শতাংশ দিলেই সব ধরনের কর থেকে দায়মুক্তি পায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি। উৎসে করই চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হয়। গত অর্থবছর পর্যন্ত এই কর হার ছিল দশমিক ৬ শূন্য শতাংশ। তিন বছর আগে এই হার ১ দশমিক ২ শূন্য শতাংশ করার ঘোষণা থাকলেও পোশাকশিল্প মালিকদের চাপের মুখে তা কমানো হয়েছে।

চলতি ২০১২-’১৩ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকপ্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা কর পেয়েছে এনবিআর। আগের পুরো অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে তাঁরা নগদ সহায়তা নিয়েছেন ১ হাজার ৪১২ কোটি সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বিপরীতপক্ষে, এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) নিবন্ধিত দেশের শীর্ষ ও বড়ো ৩৫০টি প্রতিষ্ঠান ও এদের পরিচালকেরা গত অর্থবছরে (২০১১-’১২) মোট ৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা কর দিয়েছেন। এর আগের অর্থবছরে দিয়েছেন সাত হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।

শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ড-সুবিধাও পায়। অর্থাৎ এই সুবিধার আওতায় প্রয়োজনীয় সুতা, কাপড়সহ কাঁচামাল আনতে কোনো শুল্ক দেন না মালিকেরা। এমনকি তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচ্ছন্ন রপ্তানি খাতগুলোও (প্যাকেজিং, এক্সেসরিজ, ইত্যাদি) এই সুবিধা পায়। এনবিআরের নিজস্ব এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৭-’০৮ থেকে ২০১১-’১২ অর্থবছরের মোট এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বন্ড-সুবিধা নিয়েছে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরা। এর বাইরেও গত তিন দশক ধরেই তৈরি পোশাক খাতকে কর অবকাশ সুবিধা (ট্যাক্স হলিডে) দিয়ে এই শিল্পটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাছাড়া, তৈরি পোশাক খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতি আনতে মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দেন উদ্যোক্তারা, যেখানে অন্য খাতের যন্ত্রপাতি আনতে ৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।

সরকারি কোষাগার থেকে শুধু নগদ সুবিধা, বিবিধ ধরনের কর সুবিধা, শুল্ক মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা ভোগ করেই ক্ষান্ত নয় পোশাক খাত, এরা বৃহদাকারের আর্থিক দুর্নীতির সাথেও যুক্ত রয়েছে। ব্যাংক খাতে বড়ো-বড়ো অনিয়ম-জালিয়াতির বেশির ভাগই করা হয়েছে পোশাক খাতকে দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অপব্যবহার করে। আর সব ক্ষেত্রেই পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক গ্রুপের কেলেঙ্কারি এর শীর্ষস্থানীয় উদাহরণ। এই খাতের বিকাশে বন্ড-সুবিধা চালুর পর, করমুক্ত কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি করে বড়ো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে এ খাতের অনেক মালিকের সংশ্লিষ্টতার কথাও সর্বজনবিদিত।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক পণ্যের বাজার ও ক্রেতাগোষ্ঠীর দায়দায়িত্ব

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের সিংহভাগ ক্রেতা ইউরোপ-আমেরিকার খ্যাতনামা পোশাক ব্রান্ডগুলো, যেগুলোর মধ্যে আছে ওয়াল-মার্ট, প্রাইমার্ক, এইচ অ্যান্ড এম, গ্যাপ, ইন্ডিটেক্স, টেস্কো, ম্যাংগো, জেসি পেনি, হেনস অ্যান্ড মারুইজ, দ্যা চিলড্রেন্স পেন্স, জো ফ্রেশ, বেনেট্টন, সিয়ার্স, প্রভৃতি। রানা প্লাজায় অবস্থিত ৫টি গার্মেন্টস কারখানায়ও মূলত পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ীই পোশাক তৈরি হতো। ‘সস্তা মূল্য, ভালো মান, বিশাল উৎপাদন ও অগ্রিম সেবা’ চাহিদার সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এসব প্রতিষ্ঠানের মূল সুবিধাভোগী তারাই। বাংলাদেশি শ্রমিকদের সস্তা শ্রমে উৎপাদিত এসব পণ্যই তারা উন্নত দেশগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় গড়ে চলেছে। অভিযোগ রয়েছে, পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করার তাগিদ থেকেই রানা প্লাজায় ফাটল ধরা পড়ার পরও শ্রমিকদের জোর করে কারখানার কাজে যেতে বাধ্য করেন এর মালিকেরা। সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহের এই চাপ সবসময়ই মোকাবেলা করতে হয় মালিক-শ্রমিকদের। কাজেই পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিকা- ও ভবনধসে একের পর এক হাজার হাজার শ্রমিকনিধনের দায়দায়িত্ব আন্তর্জাতিক ব্রান্ড মালিক ও পোশাক ক্রেতারাও এড়াতে পারেন না। রানা প্লাজার বেদনাকর ঘটনার পর পৃথিবীব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠবার পর বেশ দেরিতে হলেও কোনো কোনো ব্রান্ড সহানুভূতি জানিয়েছে ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সহানুভূতি ও ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুফল দেবে না, যদি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নিজেদের দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়।

আশার কথা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র উদ্যোগে জেনেভাভিত্তিক ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রিঅল পৃথিবীর বড়ো বড়ো পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে একটা চুক্তিতে আনতে সক্ষম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় আগামি পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও উন্নত করা হবে, যার অর্থ জোগাবে এই কোম্পানিগুলো এবং তত্ত্বাবধান করবে আইএলও। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সামান্য হলেও দায়িত্ববান হতে দেখা গেল। যদিও চুক্তিতে এখনো অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান স্বাক্ষর করে নি। অথচ সকল ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানেরই এক্ষেত্রে দায় অনুভব করা উচিত। বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিসহ আইএলও ও ইন্ডাস্ট্রিঅলের সাথে মিলে সকল ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে এই চুক্তির আওতায় আনবার জন্য ভূমিকা রেখে পোশাক খাতের সকল পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে বলে আমরা মনে করি। তাতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বাজারও হারাবে না, শ্রমিকদের জীবন ও কর্মের অধিকারও রক্ষা পাবে।

পোশাক খাতের মালিক ও শ্রমিকদের অবস্থার এই বিপরীত চিত্র এবং ক্রেতাগোষ্ঠীর দোদুল্যমান ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় নিচের সুপারিশসমূহ তুলে ধরছি :

শ্রমিকদের মজুরি, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, বিমা, রেশন ও অন্যান্য সুবিধা
  1. চলতি বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে এবং প্রতি বছরের মুদ্রাস্ফীতি হারের সাথে সমতা বিধান করে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আইএলও-প্রস্তাবিত ‘লিভিং ওয়েজ’, তথা স্বাভাবিক জীবনধারণ-উপযোগী হওয়া ন্যায়সংগত। মজুরি বোর্ডের ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হওয়া দরকার। 
  2. তৈরি পোশাক খাতে সরকারি সম্পদ ও সুবিধাপ্রবাহ এককভাবে মালিকদের স্বার্থে না-হয়ে সমহারে তা শ্রমিকদের স্বার্থেও ব্যবহার করা দরকার। কারখানা মালিকদের কর, নগদ সহায়তা, শুল্ক রেয়াত, সুদের হার, ঋণ মওকুফ প্রভৃতি খাতে যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়, সকল ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশ কমিয়ে সে অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য আবাসন সুবিধা, হাসপাতাল, শ্রমিকদের আবাসস্থলের কাছে তাদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় প্রভৃতি নির্মাণ করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন।
  3. সকল কারখানায় শ্রমিকদের শ্রম আইন মেনে নিয়োগপত্র প্রদান করা এবং কর্মরত নারীশ্রমিকদের সরকারি বিধানমতো মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করা বাধ্যতমূলক করা দরকার বলে আমরা মনে করি। গর্ভধারণজনিত কারণে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচনা করারও বিধান রাখা দরকার।
  4. পোশাকশ্রমিকরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বাবা-মা-সন্তান পরিজনকে রেখে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাতে মূল্যবান অবদান রাখেন। সেই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং তাদের স্বল্প আয় ও পেছনে ফেলে আসা পরিজনদের কথা বিবেচনা করে সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরের ন্যায় কারখানাবহুল এলাকায় নারীশ্রমিকদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করা দরকার। এসব বাস ব্যবহারকারী নারীশ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেখানো সাপেক্ষে বাসভাড়া অর্ধেক হিসেবে নির্ধারিত হতে পারে। এছাড়া, সাধারণ পরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ সকল পোশাকশ্রমিকের ক্ষেত্রে অর্ধেক ভাড়া চালু করার বিধান করা দরকার। 
  5. সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা ও ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা চালু করবার সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়। আইনটি সংসদে উত্থাপিত হবার আগে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যাচাইবাছাই করে একে আরো যুগোপযোগী করে তোলা ও পাসের পর দ্রুত যথাযথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া দরকার। 
  6. নির্বাচনী অঙ্গীকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার গত বছর ঘোষণা দিয়েছিল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করবার। কিন্তু বিজিএমইএ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দরকষাকষির কারণে আজো তা চালু হয় নি। আমরা মনে করি, বাড়িভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে পোশাকশ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
  7. পোশাক কারখানার ৮০ শতাংশ নারীশ্রমিকের জন্য প্রত্যেক কারখানায় আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও মনিটরিং 
  1. কারখানাগুলোতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে কি না, শ্রম আইনের বিধি-বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, বেতন-ভাতা ও সুযোগসুবিধা দেবার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকে বৈষম্য করা হচ্ছে কি না, কারখানা-অভ্যন্তরে নারীশ্রমিকরা নির্যাতিত হচ্ছে কি না-- সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ের মনিটরিং জোরদার করা ও সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সেজন্য মনিটরিং কমিটিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
  2. মনিটরিং কমিটির ওপরে মালিক শ্রেণির কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকা যৌক্তিক নয়। মনিটরিং কমিটিতে থাকবেন কেবল শ্রমিক, ক্রেতাগোষ্ঠী ও সরকারের প্রতিনিধি; কিন্তু কিছুতেই বিজেএমইএ বা বিকেএমইএ তথা মালিকদের প্রতিনিধি রাখা যাবে না। এই কমিটি মালিকদের কাছ থেকে যাতে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুবিধা নিতে না পারে তা-ও নিশ্চিত করা দরকার। 
  3. মূলত পোশাক খাতকে বিবেচনায় রেখেই জনগণের অর্থে শিল্প পুলিশ নামে আলাদা বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। কার্যত দেখা যাচ্ছে, দুঃখজনকভাবে এই বাহিনী কেবল শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। আজ পর্যন্ত কখনোই এই বাহিনীকে কোনো কারখানামালিকের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে শিল্প পুলিশকে ন্যায়সংগতভাবে মালিকদের অন্যায় প্রতিরোধেও সমভাবে সক্রিয় হওয়া দরকার। এছাড়া শিল্প পুলিশকে নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানেও বিশেষভাবে তৎপর হতে হবে। তারা যাতে মালিকদের পক্ষ হয়ে শ্রমিক নিপীড়নে ব্যবহৃত না হয়, বরং শ্রমিকদের যাতায়াত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে তা নিশ্চিত করা জরুরি। শিল্প পুলিশ যাতে কারখানা মালিকদের গাড়ি ব্যবহার বা মালিকশ্রেণির কাছ থেকে অন্য কোনো সুবিধা নিতে না-পারে সে ব্যবস্থাও করা দরকার। 
দায়দায়িত্ব, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং স্বচ্ছতা
  1. আইএলওর সহায়তায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মেনে ব্যবসা করতে বাধ্য করা উচিত, যাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের জন্য একেকটা মৃত্যুকূপ হয়ে উঠতে না-পারে। তাছাড়া, দুর্ঘটনা ঘটবার পর নিজেদের দায়দায়িত্ব ভুলে বাংলাদেশ থেকে আর পোশাক কিনবে না, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এরকম হুমকি ন্যায়সংগত নয়। বরং তাদের উচিত তাদের জন্য পোশাক সরবরাহকারী কারখানাগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কর্মপরিবেশ উন্নত করা ও শ্রমিকদের ‘লিভিং ওয়েজ’ বিবেচনায় রেখে পোশাকের মূল্য নির্ধারণ করে তা কিনে নেয়া। 
  2. যেসব কারখানা মালিক শ্রমিকদের আবাসন, যাতায়াতের জন্য পরিবহন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিনিয়োগ করবেন, কেবল তাদের ক্ষেত্রেই সরকারি ‘নীতি-সহায়তা’ বা আর্থিক রেয়াত প্রযোজ্য হতে পারে। 
  3. শ্রমিকদের জীবননাশের কারণ হয়েছে, এ যাবৎ সংঘটিত এমন সকল গার্মেন্টস দুর্ঘটনার প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা এবং হতাহতদের আন্তর্জাতিক মানের যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেয়া জরুরি। ক্ষতিপূরণের অর্থের জোগান কিছুতেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে নয়, বরং মালিকপক্ষের মুনাফালব্ধ অর্থে ও ক্রেতাগোষ্ঠীর সহায়তায় পরিশোধ করবার ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
  4. রানা প্লাজার দুঃখজনক শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের পর, আন্তর্জাতিকভাবে পোশাক ক্রেতারা শ্রমিকদের কল্যাণার্থে তহবিল গঠন প্রভৃতির মতো উদ্যোগ নেবার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, কখনোই শ্রমিক কল্যাণ বা তাদের স্বার্থে সক্রিয় ছিল না এমন ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব তহবিলের ব্যাপারে হঠাৎ করে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা এ ধরনের উদ্যোগ ও ওকালতি নিয়ে সন্দিহান। শ্রমিকদের কল্যাণে যেকোনো আন্তর্জাতিক তহবিল স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সরকার-তহবিলদাতা-আইএলও-শ্রমিক সংগঠনগুলোর যৌথ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়া উচিত। এখানে মালিকদের সংগঠনকেও সম্পৃক্ত করা উচিত নয়। মধ্যপ্রাচ্যর একাধিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে প্রত্যাগত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জাতিসংঘ তহবিল যেমন সরকার স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালনা করেছে, এক্ষেত্রেও তা করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
  5. বছরে তৈরি পোশাক খাতে কত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলো, শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ কত ব্যয় হলো, পোশাকশিল্প মালিকরা সরকারকে কত কর দিলেন এবং এই খাতে সরকারকে কত টাকা বিনিয়োগ করতে হলো স্বচ্ছতার স্বার্থে তার বছরওয়ারি হিসাব গণমাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার।

এই প্রবন্ধটি গত ২৭ মে ২০১৩ বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত 'তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় করণীয়' শীর্ষক আলোচনাসভায় মূল আলোচনাপত্র হিসেবে উত্থাপিত হয়।

No comments:

Post a Comment

লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)