এইচআইভি সংক্রমণ, সংক্রমিত ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য এবং
এইডসসংক্রান্ত মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনুন
এ বছরের বিশ্ব এইডস দিবসের (পহেলা ডিসেম্বর ২০১১) আহ্বান : ‘এইচআইভি সংক্রমণ, সংক্রমিত ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য এবং এইডসসংক্রান্ত মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা’ (Getting to Zero - Zero New HIV Infections. Zero Discrimination and Zero AIDS-Related Deaths)। এসব ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানোই এই স্লোগানের উদ্দেশ্য। এইডস সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা, এইডসআক্রান্তদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো এবং বিশ্ব পর্যায়ে এইডসসংক্রান্ত সামাজিক ও স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করার জন্য ১৯৮৮ সাল থেকে পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়ে আসছে। সকলের জন্য চিকিৎসার সম-সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সকল দেশকে এইডস রোগ প্রতিরোধে অঙ্গীকারাবদ্ধ করে তোলার মধ্যেই এই দিবসের তাৎপর্য নিহিত।
প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ৭১০০ মানুষ এইচআইভি-সংক্রমিত হয় এবং ৪৯০০ মানুষ এইচআইভি/এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বর্তমানে বিশ্বে তিন কোটি মানুষ এইডস-সংক্রমণ নিয়ে বেঁচে আছে। এইডসআক্রান্ত অধিকাংশ মানুষই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করে। বিশেষ করে, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এইডস মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে, যেখানে ১৫-২৪ বছর বয়সী নারীরা ভয়াবহভাবে এইচআইভি-সংক্রমণের শিকার হয়েছে।
এইডসআক্রান্ত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা এখনো সোনার হরিণ। এক্ষেত্রে প্রথম বাধা রোগ চিহ্নিত হওয়া এবং সামাজিক সংস্কার দূর করে চিকিৎসা নিতে এগিয়ে আসা। এরপর রয়েছে চিকিৎসার ব্যয়বহুলতার বিষয়টি, যা দরিদ্র দেশের আক্রান্তব্যক্তিদের একটা বড়ো অংশকেই চিকিৎসা থেকে দূরে রাখে। উন্নত বিশ্বে চিকিৎসার সহজলভ্য সুবিধা থাকলেও দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি এখনো একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।
এইডসআক্রান্ত মানুষের প্রতি সমাজে একটি মর্যাদাপূর্ণ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্বের ৮৪টি দেশে রোগটির প্রতিরোধ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা, সেবা ও সহায়তা দানের ক্ষেত্রে বৈরী অবস্থা বিরাজ করছে। ৫৯টি দেশে চিকিৎসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। তাছাড়া এইডসআক্রান্ত ব্যক্তিরা চলাচল ও জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হন।
বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও আমরা ঝুঁকিমুক্ত নই। সর্বশেষ সরকারি হিসেব অনুযায়ী ১৯৮৯ সালে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এইচআইভি পজিটিভের সংখ্যা ২০৮৮ জন, এইডসআক্রান্তের সংখ্যা ৮৫০ জন, যার মধ্যে মারা গেছেন ২৪১ জন। আমরা সচেতন না-হলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও এইডসের বিস্তার ভয়াবহতার মাত্রায় পৌঁছে যেতে পারে।
আমাদের দেশে এইডস রোগী শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কেননা এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য এখানে রক্ত পরীক্ষার সুযোগ যথেষ্ট নয়। সরকারি হিসেব মতে, দেশে এইচআইভি পরীক্ষার জন্য ৯৬টি ভলান্টারি কাউন্সেলিং অ্যান্ড টেস্টিং কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে রক্তে এইচআইভি ভাইরাস আছে কি না তা বিনামূল্যে পরীক্ষা করা হয়। কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে থাকে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। এসব কেন্দ্র মূলত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগী; যেমন কিছু কেন্দ্রে যৌনকর্মী ও কিছু কেন্দ্রে হিজড়াদের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। সাধারণ মানুষের জন্য এরকম কেন্দ্রের সংখ্যা খুব কম। তাছাড়া এই কেন্দ্রগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বিশেষ কয়েকটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।
এইডসআক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভি-সংক্রমণ চিহ্নিত হলে রোগীকে নিয়মিত এআরভি (এন্টিরেট্রোভাইরাল) ওষুধ দিতে হয়। এই ওষুধ খুবই ব্যয়বহুল, যেজন্য বিশেষায়িত গ্র“প হিসেবে সুবিধাপ্রাপ্তদের বাইরে চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এইডসআক্রান্ত সাধারণ দরিদ্ররা বৈষম্যের শিকার হন। আমরা মনে করি, এইডসআক্রান্তদের চিকিৎসার দায়িত্বটি সরকার গ্রহণ করলে এসব সমস্যা থেকে সহজেই উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।
এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের বাস্তবতাগুলো আমাদের সমাজেও বিরাজমান। মাদকসেবন, যৌনব্যবসায়, সাময়িকভাবে বিদেশে অবস্থান, অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, দারিদ্র্য, পর্যাপ্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার অভাব ছাড়াও আরো অনেক মৌলিক বিষয় রয়েছে, যা এ ধরনের রোগের বিস্তারে সহায়তা করে ও প্রতিরোধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এইডসআক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে নারী-পুরুষ উভয়েরই। দেশে প্রকট জেন্ডার বৈষম্য বিদ্যমান থাকায় নারীরা আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় পুরুষের তুলনায় বেশি ভুগছে। আক্রান্ত নারী পরিবারে, সমাজে সর্বত্র সন্দেহের শিকারে পরিণত হন। পরম আপনজনও তাদের দূরে ঠেলে দেয়। এছাড়া অতি দরিদ্র, ক্ষমতাহীন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন, নারীদের এইডসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং তাদের পরিণতি হয় আরো ভয়াবহ। সমাজে নারীদের অধস্তন অবস্থান, নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতাহীনতা ও মানবাধিকারবঞ্চনা এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে যেকোনো জাতীয় উদ্যোগের সফলতার পথে বড়ো প্রতিবন্ধক।
এই পরিস্থিতি ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডসের সংক্রমণ, রোগীদের প্রতি বৈষম্য এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য জরুরি করণীয়সমূহ হতে পারে নিম্নরূপ :
-প্রতিরোধই হচ্ছে এইডস থেকে রক্ষা পাবার সর্বোত্তম উপায়। এইচআইভি ভাইরাস যাতে আক্রমণ করতে না-পারে, সেজন্য নিরাপদ ও বিশ্বস্ত যৌনসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
-জরুরি মুহূর্তে শরীরে রক্ত গ্রহণের আগে স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে দানকৃত রক্তে এইচআইভি ভাইরাস আছে কি না তা পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সকল সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ সুবিধাসহ চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য করতে হবে।
-মাদক গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে সিরিঞ্জ দিয়ে মাদক গ্রহণ পরিহার করতে হবে। যারা এখনো পরিহার করতে পারছেন না তাদের একাধিকজনের একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করার প্রবণতা রোধ করতে হবে।
-এইডস প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। স্কুল পর্যায় থেকে জাতীয় কারিকুলামের আওতায় এইচআইভি/এইডস, প্রজননস্বাস্থ্য ও যৌনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত শিক্ষা ও সচেতনতা প্রদান করতে হবে। উন্নয়নকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়েও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
-আমাদের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের সচেতন করার মাধ্যমে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এইচআইভি/এইডসসহ বিভিন্ন যৌনরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
২০ নভেম্বর ২০১১-এর দৈনিক সমকালের ‘নারীস্থান’ পড়ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লদুটি ফিচারে। ‘প্রশংসনীয় উদ্যোগ’ নামের প্রথম ফিচারটি ভারী যান চালানোরপ্রশিক্ষণে নিয়োজিত নারী পুলিশদের নিয়ে। পড়ে উদ্দীপ্ত বোধ করলাম। ‘প্রথমপ্রথম মনে হয়েছে--- আমরা কি বাস চালাতে পারব! ভয়ও লাগছিল অত বড় গাড়ি কীভাবেম্যানেজ করব, এই ভেবে। কিন্তু এখন ভয় পুরোপুরি কেটে গেছে।’ এ কথা ১১ আর্মডনারী পুলিশের একজন সদস্যের, যিনি বেসিক ড্রাইভিং কোর্সে অংশ নিয়েছেন। এইব্যাটালিয়নের অধিনায়কও একজন নারী, আবিদা সুলতানা। তিনি বলছেন : ‘আমি আমারব্যাটালিয়নের সব সদস্যকে সব দিক থেকে পারদর্শী করে তুলতে চাই। মহিলা পুলিশকত আর কাজ জানবে--- এমন নেতিবাচক কথা যেন কেউ বলতে না পারে সেটাই চাই। তাইঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে নারী পুলিশ সদস্যদের এই প্রশিক্ষণেরব্যবস্থা করেছি।’ একই দিনে ছাপা নারীস্থানের আরেকটি ফিচার হলো ‘মহিলাক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব : ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নারীরা’, যেখানেবর্তমানে বাংলাদেশের মাটিতে চলমান ২০১৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের খেলার বর্ণনা উঠে এসেছে। আমাদের ক্রিকেটযোদ্ধামেয়েরা এই বাছাইয়ের লড়াইয়ে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। তারা জাপান ওআয়ারল্যান্ডের নারীক্রিকেটারদের পরাস্ত করে ওয়ানডে ক্রিকেটের মর্যাদাছিনিয়ে নিয়েছে। উল্লেখ্য, এই ক্রীড়োৎসবে সমাগত পৃথিবীর দশটি দেশের ক্রিকেটটিমের কোচ, ম্যানেজার এবং ফিজিওরাও নারী। ক্রিকেটের পাশাপাশি যাঁদের কেউকেউ চাকুরি করেন, সংসার-সন্তান সামলান ও পড়াশোনা করেন। ভাবছি, এই সংবাদদেখলে বেগম রোকেয়া কী ভাবতেন? বলতেন কি যে, ‘আমরা সবই পারি’--- এরকম আস্থারজমিতে দাঁড়ানো এই নারীরা আমাদের আগামী সময়ের দিশা? হয়ত তিনি আশার স্বপ্নবুনতেন আমাদের নারীদের নিয়ে। হয়ত এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভাবতেন, এখনকারদিনের স্ত্রীজাতির অবনতির প্রধান কারণ নারীর প্রজনন কর্মভার! এ অবস্থা থেকেএদের উত্তরণ ঘটাতে হবে।
‘উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কিনাই? যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী”র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কিস্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?’ মতিচুর গ্রন্থভুক্ত ‘স্ত্রীজাতিরঅবনতি’ নামক প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া এই প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেক আগে, বিশ শতকেরসূচনালগ্নে। তিনি লক্ষ করেছিলেন তাঁর সময়ের বঙ্গীয় নারী, বিশেষ করেসিংহভাগ মুসলিম নারী অলঙ্কারের ভারে জড়পিণ্ড হয়ে এক বিড়ম্বনাকর জীবনযাপনেঅভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে জীবনে স্বামীর প্রভুত্ব সহ্য করে মুখ বুজে তার সেবাকরাই একমাত্র জীবনাদর্শ। যে জীবনে স্বামীগৃহের তাবৎ গার্হস্থ্যকর্মেযন্ত্রবৎ নিমজ্জিত হয়ে থাকার অধিক নিজের হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মন ওচিন্তাশক্তিকে নিজেদের বিকাশে কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছিলনা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরনির্ভরশীল, অলঙ্কার-বিড়ম্বিত ও ভীরু নারীজাতির তিনিতুখোড় সমালোচনা করেন। উল্লিখিত প্রবন্ধে পরনির্ভর নারীসমাজেরপশ্চাৎযাত্রার ছবি আঁকেন তিনি এভাবে : ‘আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞানবা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখনকাজেই তাহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন। আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশুপক্ষীর অন্তর্গত অথবামূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি।’ অলঙ্কারে মুগ্ধ স্ত্রীলোকদের তিনি মনেকরিয়ে দিয়েছেন যে, ‘বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছু নহে’।বাইরের বিশালতার সাথে যুক্ত না-থেকে গৃহকোণে বন্দি সুশ্রী পুতুলের মতোজীবনযাপনকারী অনেক ভীরু নারীকে তীব্র ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘সামান্য হইতেসামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়াথাকি!!... ব্যাঘ্র ভল্লুক ত দূরে থাকুক, আরসুলা, জলৌকা প্রভৃতি কীট পতঙ্গদেখিয়া আমরা ভীতবিহ্বলা হই! এমনকি অনেকে মূর্চ্ছিতা হন।’ এই সমুদয়বৈশিষ্ট্যকে (পরনির্ভরশীলতা, অলঙ্কার-ভারাচ্ছন্নতা ও ভীরুতা) অনেক আগেইতিনি নারীর সম্মানজনক ও স্বাধীন জীবনের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।ভাগ্যিস করেছিলেন! নইলে হয়ত আমাদের দুর্দশার পথ আরো দীর্ঘায়িত হতো।
তিনি বলেছেন, ‘অনেকে মনে করেন যে, পুরুষের উপার্জিত ধন ভোগ করে বলিয়াই নারীতাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক।’ আমরাও মনে করি যেকথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক, তবে সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কারণ পুরুষ-সহায়ক সমাজধর্ম ওসমাজসদস্যদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নিয়মিত উপার্জনে নিয়োজিতঅনেক শিক্ষিত নারীকেও এ সমাজে পুরুষের প্রভুত্ব ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়, ‘অকর্মণ্য’ পুরুষেরাই যখন তাদের ‘স্বামী’ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরোমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাইদ যেমনটি ছিলেন। অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘স্বামী’পুরুষের প্রভুত্ব ও অত্যাচার বেশি মাত্রায় সহ্য করতে হয় অর্থনৈতিকউপার্জনের সাথে যুক্ত নন এমন নারীদের। অবনত স্ত্রীজাতির এই অবস্থাপরিবর্তনের প্রয়োজনে বেগম রোকেয়া নারীদের উপার্জনশীল করে তুলবার ব্যাপারেপ্রচণ্ড তাড়া বোধ করেছেন। যে কারণে কেবল পাশ-করা বিদ্যাশিক্ষা না-করেঅনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করা, হস্ত দ্বারা সৎকার্য করা, চক্ষু দ্বারামনোযোগ সহকারে দর্শন, কর্ণ দ্বারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তাকরতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং স্বাধীনভাবে উপার্জনে নিযুক্ত হবার উপযোগী হয়েগড়ে উঠতে প্রণোদিত করতে চেয়েছেন ও পথ দেখিয়েছেন, যাকে বেগম রোকেয়া ‘স্বাধীনব্যবসায়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ‘আবশ্যক হইলে আমরা লেডী-কেরানীহইতে আরম্ভ করিয়া লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-ব্যারিস্টার, লেডী-জজ সবইহইব।’
বেগম রোকেয়ার দেখানো পথ ধরে আজ আমাদের সমাজ অনেক বদলেছে। ‘লেডী-কেরানী’ তো এখন শত শত, এমনকি ‘লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট’, ‘লেডী-ব্যারিস্টার’ ও ‘লেডী-জজ’ও বিরলদৃষ্ট নয়। আমাদের নারীরা আজ অনেক অপ্রচলিত পেশায়ও নিয়োজিত হয়েছেন ও হচ্ছেন। বিজ্ঞান ও কারিগরি সাধনা, বিমান ও অন্যান্য যান চালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও ফটোগ্রাফি, সামরিকবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন, জনপ্রশাসন পরিচালনা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব পালন, ক্রিকেট-ফুটবল-মুষ্ঠিযুদ্ধ প্রভৃতি খেলাধুলায় নিযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক নারী আজ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, যেটা তাঁর সময়ে প্রায়-অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল।
লক্ষণীয় যে, আজ এতকিছুর পরও নারীজাতির সবিশেষ উন্নতি হয় নি ও হচ্ছে না। পরনির্ভরশীল, অলঙ্কার-বিড়ম্বিত ও ভীরু নারী আমাদের সমাজে এখনো আছেন। একশ বৎসরেরও আগের সমাজে একজন মুসলিম নারী যে ধরনের বন্দি জীবনযাপন করতেন, আজো আমাদের অনেক নারী সেভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এখনো বিপুলসংখ্যক নারীর জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে মজুরিবিহীন ‘স্বামী’র গৃহকার্য, তথা প্রজনন ও গার্হস্থ্য কর্মভারে পীড়িত হয়ে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে একের পর এক সন্তান জন্মদান ও পরিবারের সকল সদস্যের জীবনপ্রবাহ সচল রাখতে পরিবার-অভ্যন্তরস্থ যাবতীয় কাজের দায় সামলাতে গিয়ে তাদের নিজেদের জীবনের দিকে ফিরে তাকাবার কোনো অবকাশই মিলছে না। এদের জীবনে কোনো বিনোদন নেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে যুক্ততা দূরে থাক, সবকিছু সামলে মেলে না প্রতিবেশীর বাড়িতে একটু বেড়াতে যাবার ফুরসৎ। পরিবারে ভিতরে সার্বক্ষণিক সক্রিয়তার পরও বৃহত্তর নাগরিক সমাজে তাদের পরিচয় ‘নিষ্ক্রিয় মানুষ’ হিসেবে। কারণ বৃহত্তর সমাজে তাদের কোনো ভূমিকা রাখবারই সুযোগ নেই। সমাজ অনেকাংশে তাকে সেই স্পেস দেয় না।
বেগম রোকেয়ার সময়ের বাংলায় জনসংখ্যা কোনো সমস্যা ছিল না। পরিবারের ভিতরের পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমের বিনিময়মূল্যও ততদিনে হিসেব করে ওঠা যায় নি কিংবা তখন এ দাবি তোলারও দিন আসে নি যে, গার্হস্থ্যকর্মের ভার কেবল নারীর নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সকল সদস্যের। আজ এদেশে জনসংখ্যা এক বড়ো সমস্যা। আজ আমরা জেনে গেছি পরিবারের ভিতরে উৎপাদিত হয়ে ভিতরেই খরচ হয় এরকম উৎপাদনের পেছনে ব্যয়িত শ্রমের অর্থমূল্য কত বিপুল। কাজেই এখন বেগম রোকেয়ার থেকে এগিয়ে আমাদের ভাবতে হবে নারীর কাঁধ থেকে এই সনাতনী কর্মভার কমাবার বিষয়ে। এই ভার কমিয়ে বিপুল পরিমাণ নারীকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে সক্রিয় নাগরিক হবার সুযোগ করে দেয়া গেলে গৎবাঁধা গ্লানিকর জীবন থেকে উত্তরিত হয়ে ব্যক্তিনারী জীবনকে আনন্দময় একটা ব্যাপার বলে আবিষ্কার করে উঠবে।
আশা করি এ কথায় কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করবেন না যে, পরিবারের সন্তান সংখ্যা কমলে সন্তানের খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অর্থ বিনিয়োগে পরিবারের সংগতি বাড়বে। কমবে নারীর প্রজননতন্ত্রসংশ্লিষ্ট অসুস্থতা এবং মা ও শিশুমৃত্যুর হার। তাছাড়া নারীর বিভিন্নমুখী উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ততার ভিতর দিয়ে পরিবারে ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা চালু হবারও একটা অবকাশ তৈরি হবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কমবে নারী নির্যাতন। আর এরকম পরিস্থিতিতে সচেতন নারী ক্ষমতায়নের সিঁড়ি খুঁজে পাবে।
সমাজে এরকম অবস্থা সৃষ্টি করা গেলে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও অনেক বড়ো সুফল আসবে বলে আশা করা যায়। প্রথমত এতে জনসংখ্যার ভার কমবে। আর তাতে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয়জল ও জ্বালানি খাতে নাগরিকদের চাহিদা মিটাতে ক্রমবর্ধমান চাপ অনেকটা হ্রাস পাবে। রাস্তা, বাসস্থান ও অবকাঠামো উন্নয়নে জমির ওপর এবং বন, জলাভূমি ও পরিবেশের ওপরে চাপ কমবে। এক্ষেত্রে দুর্যোগের পরিমাণ হ্রাস পাবে বলেও আশা করা যায়। অন্তত দুর্যোগের ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলায় জনসাধারণ ও রাষ্ট্র অনেক বেশি সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারবে। সবিশেষ রাষ্ট্রের জনগণের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ ও হার বৃদ্ধি পাবে এবং সব মিলিয়ে নাগরিকদের জীবনমানে আসবে দৃশ্যমান ইতিবাচক উন্নয়নের জোয়ার।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বেগম রোকেয়া পরিবার ও সমাজশৃঙ্খল থেকে বঙ্গীয় নারীর নিজের ভিতরে মুক্তি চেয়েছিলেন। সে মুক্তি আজ কমবেশি আসতে লেগেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের যে একাংশ নারী শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে স্বাধীনভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন, তাদের ভূমিকাকে আরো নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি শিক্ষা ও উপার্জনমুখী কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত বৃহদাংশ নারীকে এই স্রোতে শামিল হবার সুযোগ করে দিতে পারলে বেগম রোকেয়ার প্রত্যাশা পরিপূর্ণতা পাবে। আমরা নিশ্চয়ই তা করতে চাই!
আমাদের বর্তমান জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে জেন্ডার, প্রজননস্বাস্থ্য ওএইচআইভি/এইডসসম্পর্কিত বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে জেন্ডারসংবেদনশীল করে গড়ে তোলা দরকার। এ লক্ষ্যে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিএনপিএস-এর উদ্যোগে নেত্রকোনাজেলার সদর ও বারহাট্টা উপজেলা এবং ঢাকা মিলিয়ে মোট ৬টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকবিদ্যালয়ে একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে আমরা যে বিরল অভিজ্ঞতাঅর্জন করেছি, তা প্রণিধানযোগ্য। এর মাধ্যমে বুঝেছি যে, বড়ো বড়ো কাজে নানারকম বাধা থাকলেও মানুষের মনেরবাধাটিই আসলে বড়ো বাধা। যেটি অতিক্রম করা গেলে সাফল্য সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
কর্মসূচিবাস্তবায়নের শুরুর দিকে মডিউল প্রস্তুত, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদেরটিওটি সফলভাবে সম্পন্ন করার পরও আমরা যারা মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম, তারা ভুগছিলাম এক অজানা আশঙ্কায়, যে, না জানি কীহয়! শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন তো!নাকি মাঝখানে এসে বলবেন যে, আমাদের পক্ষে এই আলোচনা সম্ভব না! আবারশিক্ষকগণ আলোচনা করলেও অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যগণ বিষয়টিকেস্বাভাবিকভাবে নিবেন তো! এ ধরনের নানা আশঙ্কা আমাদের মনের মাঝে ঘুরপাকখাচ্ছিল। কিন্তু তবু নিজের মনের এই অবস্থাটি কারো কাছেই প্রকাশ করতেপারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, যদি পূর্বেই এই আশঙ্কা বা ভবিষ্যৎ ঝুঁকির কথাবলি, তবে অনেকেই হয়ত আমাদের কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।
ভাবনাচিন্তারশেষে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন পর্বে গিয়ে দেখা গেল, শুরুতে আমরা যে ধরনেরআশঙ্কা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম, বাস্তবে কোথাও তারছিটেফোঁটাও নেই। খুব আন্তরিক ও সাবলীলভাবেই শিক্ষকগণ পড়াচ্ছেন বিষয়গুলো।এমনকি অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে যে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম, তাদের দিক থেকেও কোনো বাধা এল না। বরং এল প্রতিক্রিয়া। তাঁরা বললেন, এইকাজটি তো আমাদের সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই হওয়া দরকার। অথচকরছেন আপনারা। তাঁরা আরো জানালেন যে, বয়ঃসন্ধিকালে এ ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্যসকল শিক্ষার্থীকে জানানো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কর্মসূচিবাস্তবায়নের শুরুর দিকে পরিকল্পিত কর্মসূচি বিষয়ক ধারণা প্রদান অনুষ্ঠানেউপস্থিত বারহাট্টা উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বললেন, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের জেন্ডার সংবেদনশীল করে গড়ে তোলারজন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করলেও বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনও প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক শিক্ষা সেইভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় নি।এইচআইভি/এইডস বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অনেক শিক্ষকই তাক্লাসে না পড়িয়ে বাড়িতে পড়ে নিতে বলেন। অথচ বিষয়গুলো অত্যন্ত দরকারি। তিনিআরো বলেন, প্রয়োজনীয় এসব বিষয় জানতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝেও যেআগ্রহ আছে তা আপনারা প্রমাণ করলেন এবং আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে যে অনেককঠিন কাজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব তা আপনারা হাতেকলমে করে দেখাচ্ছেন।
আমারমনে হয়, যেকোনো কাজের মনের বাধা ডিঙানো গেলে কখনো কখনো অসম্ভবকেও সম্ভবকরে তোলা যায়। প্রথম ধাপে আমরা সফল হয়েছি। এই সাফল্য আমাদের যে সাহসদিয়েছে, তা নিয়ে এই লক্ষ্যে আমরা আরো অনেকদূর যেতে পারব বলে বিশ্বাস করি।হয়ত এ পথ বেয়ে একদিন আমরা দেখব পাবো, আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামটিইজেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। সেই স্বপ্নেই এখন আমাদের বসবাস।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গ্রামীণ নারীরা যেসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস সেদিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ২০০৭-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের একটি সাধারণ অধিবেশনে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতি, খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি সাধন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আদিবাসীসহ গ্রামীণ নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়। যদিও ১৯৯৫ সালেই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত নারীবিষয়ক চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় গ্রামীণ নারীদের অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে এরকম একটি দিবস পালনের প্রস্তাব আনা হয়। ২০০৮-এর ১৫ অক্টোবর নিউইয়র্কে দিবসটি প্রথমবারের মতো উদযাপিত হয়। তার পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজ দিবসটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে উদযাপন করে আসছে।
বলাবাহুল্য যে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমুদয় খাদ্যই উৎপাদিত হয় গ্রামাঞ্চলে। এই উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় গ্রামীণ নারীসমাজ যে বিপুল পরিমাণ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শ্রমে অংশ নিয়ে থাকে, আমাদের দেশে তার কার্যকর স্বীকৃতি এখনো অনুপস্থিত। আমরা জানি, গ্রামীণ কি শহুরে, শিক্ষিত কি নিরক্ষর, পেশাজীবী কি গার্হস্থ্যকর্মী সকল পর্যায়ের নারীদেরই কমবেশি পুনরুৎপাদনমূলক কাজে সময় ব্যয় করতে হয়, যে কাজ সর্বাংশে মজুরিহীন। আর মজুরিহীন বলে এ কাজ সাধারণত কাজ বলেই স্বীকৃত হয় না। সমাজ কাজ বলে স্বীকৃতি দেয় কেবল উৎপাদনমূলক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে অর্থ উপার্জন করাকে। খুব বেশি দিনের ঐতিহ্য না-থাকলেও বর্তমান বাংলাদেশের শহর পর্যায়ে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত নারী অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও কল-কারখানায় কাজ করে নগদ অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের নারীরা পুনরুৎপাদনমূলক কাজে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নেয়ার পাশাপাশি উৎপাদনমূলক কাজ, বিশেষ করে কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অংশ নিলেও তারা এ কাজে কোনো অর্থ পান না। অবশ্য দিনমজুর হিসেবে যেসব নারী অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করেন, তারা পুরুষ শ্রমিকের চাইতে কম হলেও কিছু মজুরি পেয়ে থাকেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব মতে, কৃষিকাজে বাংলাদেশের একজন পুরুষ যেখানে শ্রম দেন বছরে ১৮শ ঘণ্টা, একজন নারী সেখানে দেন ২৬শ ঘণ্টা। অর্থাৎ কৃষক পরিবারের একজন নারী কৃষিকাজে দৈনিক সাত ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করে থাকেন। এ হিসেব অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, বিশেষত যারা কৃষিকাজ বলতে কেবল মাঠের কাজকেই বুঝে থাকেন। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে, বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় নারীরা মাঠের কাজে অধিক পরিমাণে অংশ নিলেও সারাদেশের বাস্তবতা একইরকম নয়। কোনো কোনো এলাকায় মাঠের কাজে নারী উপস্থিতি কম দেখা যায়। কিন্তু এর মানে এ নয় যে ওই এলাকার নারীরাও কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অংশ নেন না। বস্তুতপক্ষে কৃষিকাজের আওতা অনেক ব্যাপ্ত। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, পুকুরে মাছ চাষ, বাড়িতে হাঁসমুরগি ও গবাদি পশুপালন, খোঁয়াড় ও গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, নানারকম কৃষি সরঞ্জাম তৈরি, আঙিনা ও বাড়ির পাশে শাকসবজি চাষ ও নিয়মিত সেচকাজ, বাড়ির আশেপাশে ফুল, ফল ও ভেষজ গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, ইত্যাদি কাজও কৃষিকাজেরই আওতাভুক্ত; যার সিংহভাগই সম্পাদন করেন গ্রামীণ নারীরা। কাজেই ফসলের মাঠে নারীদের শারীরিক উপস্থিতি পুরুষের তুলনায় কম দৃষ্ট হলেও কৃষিকাজের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যানুযায়ী এক্ষেত্রে নারীরাই যে অংশগ্রহণ ও শ্রমদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষিকাজের ১৩টি ধাপের মধ্যে নারীরা ৯টি ধাপের কাজে সরাসরি সম্পন্ন করে থাকেন।
পুনরুৎপাদনমূলক কাজে নারী যেমন মজুরিবিহীন শ্রম দিয়ে থাকেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রে নারীর শ্রমটাকেও মজুরিবিহীন শ্রম বলেই ধরে নেয়া হয়। নিজের পরিবারের জন্য কাজ করে তার বিপরীতে নগদ পারিশ্রমিক নেয়া বা নেয়ার প্রস্তাব ওঠানোটা আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু পরিবারের উপার্জনে তার অংশগ্রহণের স্বীকৃতিটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তাছাড়া কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবারের যে মোটমাট উপার্জন, যে উপার্জনের পেছনে নারীর শ্রম পুরুষের চেয়ে বেশি, সে উপার্জন পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে ব্যয়িত হবার সংস্কৃতিটাও চালু হওয়া জরুরি। দুঃখজনক যে, সে সংস্কৃতি আমাদের দেশে ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত।
দেখা যায়, যে কাজে অর্থ নেই, অর্থাগমের সম্ভাবনা নেই, সে কাজগুলোর ক্ষেত্রে সমাজ সহজেই নারীনেতৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু যখনই কাজটা নগদ অর্থের সম্ভাবনা দেখায় বা অর্থাগম হতে শুরু করে, তখনই সেটার নেতৃত্ব চলে যায় পুরুষের হাতে, তা সে যে কর্মই হোক। এক্ষেত্রেও তাই ঘটে। কৃষি উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই ঘনিষ্ঠ হলেও যখন কৃষিপণ্য বিক্রির প্রসঙ্গ আসে, তখন তা পরিবারের পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। অর্থাৎ কৃষিপণ্যের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ পরিবারকর্তা পুরুষের হাতে চলে যায়। এটাই পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির নিয়ম। আর এ নিয়মে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তারাই একক সিদ্ধান্তে সেই অর্থ খরচের পরিকল্পনা করেন ও খরচ করেন। মুশকিল হলো, একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে এ পরিকল্পনায় পরিবারের নারীসদস্যদের প্রয়োজন ও চাহিদা সমান গুরুত্ব পাবার কথা থাকলেও, কার্যত কোনোই গুরুত্ব পায় না।
গ্রামীণ নারীর সাধারণ ও প্রজননস্বাস্থ্যজনিত জটিলতা, পুষ্টিহীনতা, বিনোদনহীনতা, পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পানি ও জ্বালানির অপ্রতুলতা, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধার অনুপস্থিতি ইত্যাদি প্রয়োজনকে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনই মনে করা হয় না। নানা অপ্রাপ্তি ও সমস্যা-সীমাবদ্ধতার মধ্যে হাবুডুবু খেয়েও তাদের একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে যেতে হয়, যেখানে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, শারীরিক সুস্থতা-অসুস্থতাকে মোটেই পাত্তা দেয়া হয় না। তাছাড়া গর্ভে সন্তান ধারণ ও সন্তান জন্মদান করেই তাদের দায় ফুরায় না। নবজাত শিশুর লালনপালনের পুরো ভারও তাদের কাঁধেই বর্তায়। এ এক ভয়াবহ অবিচার, যার শিকার হয়ে চলেছে আমাদের কোটি কোটি সর্বংসহা গ্রামীণ নারী। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আছে নানারকম পারিবারিক-সামাজিক হয়রানি ও নির্যাতনের ধকল। গ্রামীণ নারীরা শহরের নারীদের তুলনায় অনেক রেশি নির্যাতনের শিকার হন। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ফতোয়া, পাচার ইত্যাদি নির্যাতনের একটা বেড়াজালের মধ্যে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করতে তারা বাধ্য হন। প্রায়ই এসব সমস্যার প্রতিকার পান না দরিদ্র গ্রামীণ নারীরা।
সহজেই বোধগম্য যে, গ্রামীণ কৃষিপরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েশিশুদের অবস্থাও হয় অতিশয় করুণ। সাধারণত এদের স্কুলে পাঠাতেই চাওয়া হয় না। পাঠালেও প্রাথমিক পর্যায়ের পর তাদের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো খুব একটা উৎসাহ দেখায় না। এখনো পরিবারগুলোর এই নিরুৎসাহের পেছনে কাজ করে প্রধানত ‘মেয়েদের অত শিক্ষার দরকার নেই’ ধরনের রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ ধারণা। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া বা শিকারের আশঙ্কা, কাছাকাছি বিদ্যালয় না-থাকা, যাতায়াত সমস্যা ইত্যাদিও এক্ষেত্রে কমবেশি ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে পরিবারগুলো চায়, মেয়েরা অনর্থক স্কুলে না-গিয়ে বাড়িতে থেকে পরিবারের নৈমিত্তিক কাজে হাত লাগাক ও বিয়ের পাত্রী হিসেবে শারীরিক-মানসিকভাবে তৈরি হোক। এর পর দেখতে-না-দেখতে তাদের শৈশব-কৈশোর ছিনতাই হয়ে যায় বিয়ে নামক প্রায়-অনিবার্য সনাতনী বাস্তবতার হাতে।
ইউএনডিপির ২০০৯ সালের এমডিজি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঝরে পড়া কিশোরীদের ৪১ ভাগকে স্কুল ত্যাগ করতে হয় বাল্যবিবাহের কারণে। স্বামীর বাড়ি গিয়ে এই কিশোরীদের অবিশ্রান্তভাবে নতুন সংসারের ঘাঁনি টানার দায়িত্ব নিতে হয়। এদের একাংশ নিজে শিশু অবস্থায়ই আরেক শিশুর মা হয় বা মা হতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সন্তান ও সংসারের ভারে কাবু হতে হতে যারা বেঁচে যায়, তাদের জীবনেও আর কোনো রং থাকে না, সুযোগ থাকে না জীবনের ভালোমন্দ নিয়ে ভাববারও। এ যেন এক বিশাল চক্রের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া, যেখানে নিজে নিজে থামবার আর কোনো সুযোগ নেই। বিয়ের আগে যে কিশোরী তার মায়ের সারাদিনের মাত্রাতিরিক্ত কর্মভার কমাতে মাকে কিছু সহায়তা দিত, নতুন সংসারে এসে তার কাঁধেও চেপে বসে মায়ের সমান কর্মভার, যদিও তার পাশে কেউ থাকে না তাকে সহায়তা দেবার জন্য।
আমরা জানি, একাংশ গ্রামীণ নারী, যাদের নিজেদের চাষ জমি নেই, দারিদ্র্যপীড়িত ও অনিরাপদ গ্রামীণ জীবনের নিগড় থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি স্বাধীন ও স্বপ্নময় জীবনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পদার্পণ করেছেন ও করছেন। গ্রামীণ নারীদের এই অংশই বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত গার্মেন্টসের প্রধান শ্রমশক্তি। গবেষণাতথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই নারী, যাদের সিংহভাগই গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত। গার্মেন্টস মালিকরা কারখানার শ্রমিক হিসেবে এসব অল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর ও অদক্ষ গ্রামীণ নারীদের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখান, কারণ এদের শ্রম খুব কম মজুরির বিনিময়ে কেনা যায়। এখানেও যে তারা খুব ভালো থাকেন, তা বলা যায় না। মজুরি ও বোনাসসহ অন্যান্য সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে নারীশ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হন। তাদের কাজ করতে হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তার ওপরে রয়েছে জীবন ও শরীরের নিরাপত্তাহীনতা। এত কিছুর পরও এরা নিজেরা কষ্টে থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে নিয়মিত গ্রামে বসবাস তাদের স্বজনদের কাছে পাঠান। এই টাকা তাদের পরিবারে যেমন বিশেষ আনন্দের সঞ্চার ঘটায়, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও রাখে কমবেশি ইতিবাচক প্রভাব।
অনিশ্চিত জীবন থেকে উদ্ধার পেতে ও একটি ভালো জীবনের আশায় শহরে এসে একাংশ গ্রামীণ নারী প্রতারণারও শিকার হন। বিদেশে কাজে পাঠাবার নামে কার্যত তাদের যৌনকর্মী হিসেবে পাচার করে দেয়া হয়। প্রতিনিয়ত এরকম খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলেও পাচারের ঘটনা এখনো বন্ধ হয় নি। কষ্টেসৃষ্টে যোগাড় করা টাকার বিনিময়ে কিছু মেয়ে বিদেশে কাজে যাবার সুযোগ পেলেও, ভাষা ও কাজ বিষয়ে প্রশিক্ষণ না-থাকায় তারা ভালো কাজ যেমন যোগাড় করতে পারেন না, তেমনি তাদের নানা সমস্যায়ও পড়তে হয়।
গ্রামের নিস্তরঙ্গ অর্থনীতির পরিসর ছেড়ে গ্রামীণ নারীদের শহরে কাজের আশায় অভিবাসনের প্রবণতা এখনো চলমান। মাসে মাসে নগদ অর্থ হাতে পাবার মতো অভিজ্ঞতা সিংহভাগ গ্রামীণ নারীর জীবনে কখনোই ঘটে না। শহরে এলে সেটা ঘটতে পারে এই সম্ভাবনাটি গ্রামীণ কিশোরী-যুবতী ও তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে শহরে অভিবাসনে। অথচ গ্রামাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা গেলে শহরমুখী না-হয়েও গ্রামীণ নারীরা বর্তমান অবস্থার চাইতে অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের নিশ্চয়তা পেতে পারেন।
বলা যায়, গ্রামীণ নারীদের বিদ্যমান অবস্থাটা প্রত্যাশিত নয়, কাজেই এতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কঠোর পরিশ্রমী ও উৎপাদনসক্ষম গ্রামীণ নারীদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারলেই কেবল আমরা বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবসের চেতনার প্রতি সম্মান দেখাতে পারব। সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার সুযোগ আছে। এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু সুপারিশ যুক্ত হলো, যেসব সুপারিশ উদ্যোগে রূপান্তরিত হলে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায় :
কৃষিকাজের সনাতনী যে পদ্ধতি, তাতে পরিবর্তন আনার জন্য কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিতে উৎসাহিত করা ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা দেয়া দরকার। এতে করে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নারী-পুরুষের শারীরিক পরিশ্রমও অনেকখানি লাঘব হবে।
গ্রামাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে উন্নত জীবনের আশায় নারী-পুরুষের বর্তমান শহরমুখী স্রোতটিকে নিরুৎসাহিত করা যায়। উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক সনাতনী হাঁসমুরগি পালন ও শবজিচাষের মতো প্রকল্পের বাইরে বেরোতে হবে, স্থাপন করতে হবে কারিগরিভিত্তিক আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্পন্ন নিরাপদ কর্মক্ষেত্র।
কম সন্তান নেবার ব্যাপারে প্রচারণায় বর্তমানে যে ভাটা পড়েছে, তাতে নতুন করে জোয়ার আনতে হবে। গ্রামীণ নারী-পুরুষকে বোঝাতে হবে যে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরে কম সদস্যের পরিবারের সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব আছে। এ ধরনের প্রচারণার পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী গ্রামীণ নারী-পুরুষের জন্য সহজলভ্য ও সুলভ করতে হবে।
পুনরুৎপাদনমূলক কাজ পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে ভাগাভাগি করে করবার সামাজিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ প্রচারণা চালাতে হবে যে, পারিবারিক ও সামাজিক কাজ কেবল নারীর নয়, নারী-পুরুষ সকলের।
গ্রামীণ মেয়েশিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমানো ও বাল্যবিবাহ রোধে বিদ্যমান উদ্যোগকে আরো জোরদার ও কার্যকর করতে হবে।
পুকুর ও নদীর পানি দূষণ রোধ করতে হবে ও নিরাপদ পানীয়জলের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পরিবারের খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের দুর্ভোগ পোহাতে না-হয়।
একদিকে বনজঙ্গল ধ্বংস করা, অন্যদিকে পরিবারের দৈনন্দিন জ্বালানি ও শাকপাতা সংগ্রহের দায় কেবল নারীদের ওপর চাপিয়ে রাখার যে সংস্কৃতি সেটা বদলাবার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে ভরতুকি দিয়ে হলেও সস্তায় গ্যাস পাবার বন্দোবস্ত করতে হবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত পারিবারিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রসহ সক্রিয় করতে হবে এবং ক্লিনিকগুলোতে ঝামেলামুক্তভাবে দরিদ্র নারীদের চিকিৎসা নেবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যেখানে এ ধরনের ক্লিনিক নেই, সেখানে তা স্থাপন করবার ব্যবস্থা করতে হবে।
যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনকে কঠোরহস্তে দমন করবার ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের আওতায়ই কার্যকর ও সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। নারী ও মেয়েশিশু পাচার রোধে বহুপাক্ষিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
গ্রামীণ নারীদের মধ্যে যারা দেশের অভ্যন্তরে শহরে ও বিদেশে কাজ করতে যেতে আগ্রহী, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে তারা অজ্ঞতার কারণে প্রতারণার শিকার না-হন এবং ভালো মানের নিরাপদ কাজে যুক্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে মেয়েদের শরীর ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানেও যত্নবান হতে হবে।
আমরা দেখেছি, অপর্যাপ্ত হলেও উল্লিখিত কোনো কোনো খাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নানা সময়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তার কার্যকর বাস্তবায়ন, নিবিড় মনিটরিং ও ফলোআপের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা এবং সুনির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না-থাকায় প্রত্যাশিত সুফল আসে নি। বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস ২০১১ উদযাপনের প্রাক্কালে আমরা আশা করি, আগামী বার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োজিত অর্ধেক শ্রম প্রদানকারী গ্রামীণ নারীদের অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বিশেষভাবে উদোগী হবে।