Showing posts with label যুদ্ধাপরাধ. Show all posts
Showing posts with label যুদ্ধাপরাধ. Show all posts

Tuesday, 17 January 2012

বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চিঠি ও যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে/ রোকেয়া কবীর



গত ১৫ জানুয়ারি ২০১১ দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত নিজামীদের অবস্থা জানতে চেয়ে সরকারকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চিঠি শীর্ষক সংবাদটিতে এই নিবন্ধকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছেসংবাদটিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রেরি ডিটেনশন’-এর নামে গত ১২ সেপ্টেম্বর জেনেভাস্থ বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনপ্রধানের মাধ্যমে ৬০ দিনের মধ্যে ৩৫ দফার সুস্পষ্ট জবাব চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে কমিশনচিঠিটি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাত হয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে রয়েছেপ্রয়োজনে ওয়ার্কিং গ্রপকে জানিয়ে এক মাস সময় বাড়িয়ে নেওয়া যাবে বলে চিঠিতে একটি শর্ত যুক্ত ছিলওই শর্তের বলে ৬০ দিনেরও অতিরিক্ত সময়ের সুবিধা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট চিঠির জবাবদানের প্রস্তুতি চলছে বলে সংবাদসূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে

জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের ওয়ার্কিং গ্রুপ অব আরবিট্রেরি ডিটেনেশন’-এর প্রধান রেপোরটিয়ার এল হাডযি মালিক সো জেনেভায় অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রতিনিধি মো. আবদুল হান্নানের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে জানতে চেয়ে যে চিঠি দিয়েছেন তাতে উল্লিখিত ৩৫ দফার মধ্যে রয়েছে তখন পর্যন্ত আটককৃত ৬ যুদ্ধাপরাধীর আটকের কারণ, আইনের ভিত্তি, ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন

সংবাদটি থেকে জানা গেল, আটককৃতদের নিয়োগকৃত আইনজীবীরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ জানিয়ে পিটিশন জমা দেয়, যার ভিত্তিতে কমিশন এই চিঠি দিয়েছেএটা আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা উৎস থেকে শুনেছি ও দেখেছি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা, বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা দান, এমনকি বিচারের সমুদয় আয়োজন পণ্ড করার জন্য দেশের ভিতরে নানাভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও লবিয়িংয়ের কাজ চলছেআন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিয়িং নিয়ে এতদিন ধরে শোনা কথাগুলো যে মোটেই উড়োকথা নয়, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই চিঠিটিই তার প্রমাণযে চিঠির ভিতর দিয়ে আটককৃত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানবাধিকার কমিশনের একটি উদ্বেগই প্রকাশিত হয়েছে

আমরা জানি, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন যেকোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযোগ জানাবার জন্য প্রশস্ত ক্ষেত্র, যা সবার জন্যই উন্মুক্তসে বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এরকম পিটিশন সেখানে জমা পড়তে পারে না তা নয়কাজেই এতে বিস্ময়ের কিছু নেইকিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে  শহীদ ৩০ লক্ষ নারী-পুরুষ, হেনস্থা ও ধর্ষণের শিকার চার লক্ষ নারী, এক কোটিরও বেশি মানুষের শরণার্থী হতে হওয়ার বিপরীতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালনকারী দেশি-বিদেশি অপরাধীদের বিচার যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছরেও হলো না, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন? কমিশনের কাছে কি এসব তথ্য নেই? যদি থাকে তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, অপরাধীর মানবাধিকারের দেখভাল করার আগেই কি অপরাধের শিকার নারী-পুরুষের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি কমিশনের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবার কথা নয়?

সম্প্রতি জাতিসংঘের হাইকমিশনার বান কি মুন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের প্রতি তাঁর নিজের দেশের জনগণকে হত্যা করার তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেনতৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় নিজ দেশের জনগণকেই হত্যা করেছিলওদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে তাহরির স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত বিদ্রোহী মিশরবাসীর এক জমায়েতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ায় মিশরের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের এখন বিচারকার্য চলছেপ্রায় ৮৫০ জন মানুষকে হত্যার নির্দেশদান ও অন্যান্য অপরাধে তার ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেনঅথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এর কয়েক হাজারগুণ বেশি মানুষের মৃত্যুঘটনা এবং নানা ভোগান্তির শিকার মানুষের বিচার পাবার দাবি বছরের পর বছর উপেক্ষিত হচ্ছে দেখে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কোনো উদ্বেগ নেই

এখানে হয়ত বলা হবে যে, কমিশনের উদ্বেগ নির্ভর করে অভিযোগের ভিত্তিতেযেহেতু অপরাধীদের পক্ষ থেকেই অভিযোগ জমা পড়েছে, কাজেই তারা তাদের পক্ষেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেএক্ষেত্রে আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, যেহেতু জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন যন্ত্রচালিত নয় বরং মনুষ্যচালিত প্রতিষ্ঠান, কাজেই সংস্থাটির এ ধরনের কার্যকলাপ কি তার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না? সরকারের কাছে কমিশনের জানতে চাওয়ার তালিকায় এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের আটকের কারণপর্যন্ত যুক্ত হওয়াকে আমার কাছে নিতান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়ভাবতে হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের আটকের কারণ হয়ত তাদের জানা নেইকিন্তু এরকম একটা বড়ো গণহত্যার ঘটনার তথ্য তাদের কাছে না-থাকাটা রীতিমতো অবিশ্বাস্যএই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাই যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বলতে হবে যে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কেবল নামেই জাতিসংঘ কমিশন এবং সংস্থাটির কার্যক্রম আসলে প্রো-পিপল নয়!

সবারই জানা আছে যে, দরিদ্ররাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বেশি হয়একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার এবং শরণার্থীর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সিংহভাগই ছিল দরিদ্রমানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারপ্রার্থী হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন পরিচালনার সামর্থ্য ও সক্ষমতা দরিদ্রদের থাকে নাএই দরিদ্রশ্রেণির মানুষের পক্ষে যদি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে না-দাঁড়ায়, তাহলে এই শ্রেণির মানুষের মানবাধিকারবঞ্চিত হয়েই জীবন অতিবাহন করতে হবেসেক্ষেত্রে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে মানবাধিকার কমিশনের মহিমা রীতিমতো নিষ্প্রভ হয়ে যেতে বাধ্য, যদি তেমন কোনো মহিমা এ সংস্থার থেকে থাকে

আমরা জানি, আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি ও ছোটো-বড়ো অনেক মানবাধিকার সংগঠন কাজ করেতার মধ্যে কয়েকটি মাত্র সংগঠন তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করাসহ অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সহায়তা করছেকিন্তু মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সাথে যারা কর্মরত, তারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তর্জাতিক অপপ্রচারের বিষয়ে কী ভূমিকা পালন করছেন, তার কোনো নমুনা আমরা কোথাও দেখছি নাতারা কেন এতদিনেও দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে কোনো পিটিশন দাখিল করেন নি? তাদের কাজ নিশ্চয়ই কেবল প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়সেক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার কার্যকর করায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের জানতে ইচ্ছে করে

বর্তমান অবস্থায় আমাদের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিত একক ও সম্মিলিতভাবে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করার অনুকূলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠিত করাদেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনসমূহের কাছে একাত্তরে এদেশে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধসমূহের বিবরণ তুলে ধরা, যাতে কোটি কোটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিপরীতে সংঘটিত এসব অপরাধের যথাযথ বিচার নিষ্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে দেশে একটি ন্যায়ের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংঘটনের লক্ষ্যে পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব এককভাবে সরকারের নয়, এ দায়িত্ব সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিমানুষ পর্যন্তআমি আশা করব, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিচারপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষাটি বাস্তবায়নের অনুকূলে তৎপর হয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যথাযথ কাজটি করবে

আরেকটি কথা, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক প্রেরিত চিঠিতে উল্লিখিত আছে অতিরিক্ত সময়েও চিঠির জবাব না-দিলে ওয়ার্কিং গ্রুপ তাদের কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বক্তব্য বা মতামত জানিয়ে দেবেআমার মনে হয়, কমিশনকে এরকম সুযোগ না-দিয়ে সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সময়ের মধ্যেই জবাব দিয়ে দেয়া উচিত, তা নইলে আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে নানা কথা উঠবেযদিও আমি মনে করি না যে, চিহ্নিত এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক চাপের কাছে পরাভূত হবার দরকার আছেকারণ এই বিচার নিশ্চিত হলে কোনো যুক্তিতেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না, বরং ৪০ বছর ধরে যে কোটি কোটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিচারের দাবি উপেক্ষিত হয়ে এসেছে, তাদের বিচার পাবার অধিকারের প্রতিই যথাযথ সাড়া প্রদান করা হবেকারণ আমি মনে করি, আগে বিবেচিত হওয়া উচিত অপরাধের শিকার হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানবাধিকার, তারপরে অপরাধীরআর সেটা হলে রাষ্ট্রে ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটা পাটাতন তৈরি হবে

বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খান তাঁর দেশে পশতুনদের ওপর পরিচালিত নির্যাতনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য কারাভানের জানুয়ারি সংখ্যায় বলেছেন যে, ১৯৭১ সালের ঘটনা থেকে পাকিস্তান কিছুই শিক্ষা নেয় নিবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধ সংঘটনকারীরা শাস্তি পেলে পাকিস্তানের বর্তমান পরিণতিতে উপনীত হতে হতো নাতিনি যথার্থই বলেছেনকোনো ব্যক্তিমানুষ বা সমাজ-রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ কোনো অপরাধ করে আইনানুগ শাস্তির আওতায় না-এলে সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়আজকের পাকিস্তানের দিকে তাকালেই সেখানকার অরাজকতা টের পাওয়া যায়যুদ্ধাপরাধের বিচার না-হওয়ায় ভিন্নমাত্রায় একইরকম পরিস্থিতি ঘটেছে আমাদের দেশেওধারণা করা হয়, স্বাধীনতার সাড়ে চার বছরের মাথায় ১৯৭৫-এ সপরিবারে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাটি ঘটত না, যদি এদেশে অবস্থানকারী পাকদোসরদের বিচারকার্য সম্পন্ন হতো৭৫-এর জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানি কায়দায় দেশে সামরিক শাসন শুরু হয়তার বলে বাহাত্তরে প্রণীত সংবিধান থেকে অনেক প্রগতিশীল ও আধুনিক ধারা কর্তন, গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান এবং রাজনীতিতে ধর্মের উগ্র ব্যবহার যুদ্ধাপরাধের বিচার না-হওয়ারই কুফলসর্বোপরি, এর ফলে আমাদের দেশের মানুষের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ থেকে শুরু করে ব্যবসায় ও রাজনীতি পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সংস্কৃতি গেঁড়ে বসেসামরিক-আমলাতান্ত্রিক পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিকাশ রহিত করে দেশে একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমরা এখনো প্রতিষ্ঠা করে উঠতে পারি নি১৫ বছরেরও বেশি সময়ের এই ক্ষত শুকাতে আমাদের হয়ত আরো সময় লাগবে

বাংলাদেশকে আমরা একটি ন্যায়তৎপর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইআর সেজন্যই যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার কার্যক্রম সফলতার সাথে সম্পন্ন হওয়া জরুরি; যে উদ্যোগের সাফল্যের জন্য বিচারের উদ্যোগগ্রহণকারী সরকারকে সহযোগিতা করে যেতে হবে সকল বিবেকবান মানুষেরবর্তমান সরকারের রাজনৈতিক বিরোধিতা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে সরকারের নেয়া উদ্যোগের বিরোধিতা করা কোনোভাবেই মানবাধিকারের পক্ষে যাওয়া নয়এক্ষেত্রে যারা ‘আন্তর্জাতিক মান’-এর প্রশ্ন টেনে আনছেন, তারা এ কথায় ঠিক কী বোঝাতে চান সে ব্যাপারে তাদের আরো ঝেড়ে কাশতে হবেঢালাও বক্তব্য না-দিয়ে চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট কোনো ঘাটতি থাকলে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে তার সমাধান করা যায়, প্রকৃতপক্ষে এখন দরকার সেরকম পরামর্শ

Thursday, 12 January 2012

গোলাম আযমের গ্রেফতার ও বিচারের আন্তর্জাতিক মান প্রসঙ্গে/রোকেয়া কবীর

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কুখ্যাত গোলাম আযমের গ্রেফতারে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের নাগরিকদের ৪০ বছরের প্রত্যাশার একাংশ পূর্ণ হলোমুষ্টিমেয় কিছু যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সমর্থকরা ছাড়া বাংলাদেশের আমজনতার সবাই এই কুখ্যাতদের বিচারের পক্ষে

গ্রেফতারের দিন গত বুধবার টেলিভিশনের সন্ধ্যার খবরে শুনলাম, গোলাম আযমের আইনজীবীদের পক্ষে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলছেন, তাকে জামিন না-দিয়ে, তার পক্ষে আপিলের অনুমতি না-দিয়ে তার সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছেতিনি বলছেন, দেশের নাগরিক হিসেবে চোর-গুন্ডা-বদমাশ সবারই সাংবিধানিক অধিকার রয়েছেতবে, এই তালিকায় তিনি কসাইশব্দটি বলেন নি! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, গোলাম আযমকে তিনি উল্লিখিতদের মধ্যকার কোন ধরনের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করলেন?

লক্ষণীয় যে, ব্যারিস্টার রাজ্জাক তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে স্বীকার করেছেন যে, এদেশে একটি সংবিধান আছে, সেই সংবিধানের দৃষ্টিতে সব মানুষের সমান অধিকার আছে গোলাম আযমকে রক্ষার জন্য হলেও তিনি সব মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের শরণাপন্ন হয়েছেন, যেটা গোলাম আযমরা হরহামেশাই অস্বীকার করেন

কথা হলো, যার জন্য তিনি সাংবিধানিক অধিকারের দাবি তুলছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর সমস্ত অপকর্ম সমর্থন করেছেন, তাদের সেসব কাজ সংগঠিত করার জন্য ভূমিকা রেখেছেন ও সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিয়েছেন, নিজে তার অনুসারীদেরসহ মানবতাবিরোধী শাস্তিযোগ্য কর্মে জড়িত হয়েছেন, যার ভুরি ভুরি বাস্তব প্রমাণ আছেতার ও তার দলের আরো অনেকের এ ধরনের অপরাধ বিষয়ে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই

গোলাম আযম যে দলের প্রাক্তন আমির, সে দল জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত নীতি হচ্ছে যে, তারা মানুষের প্রণীত কোনো আইনে বিশ্বাস করে নাএজন্য তারা দেশে আল্লাহর আইন তথা ইসলামি আইন চালু করতে চানতাদের অজস্র বক্তৃতা-বিবৃতি-ক্যাসেট-সিডি থেকেই তাদের প্রত্যাশিত আল্লাহর আইনের প্রতি অনুরক্তির কথা আমরা অহরহ শুনে থাকি

আমরা জানি, তারা তাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সৌদি সহায়তা পানপাশাপাশি তারা ইসলামি বা আল্লাহর আইনের নামে এদেশে সৌদি আইন চালু করতে চানযদি তাই চান, তাহলে এখানে আরেকটা দৃশ্যের কথা মনে হয়গোটা দেশবাসী গণমাধ্যমসূত্রে দেখেছে, গত অক্টোবরে ৮ বাংলাদেশি নাগরিককে সৌদি আইনে প্রকাশ্য রাজপথে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে, যাদের অপরাধ গোলাম আযমের অপরাধের তুলনায় তুচ্ছ

সবাই জানে, সৌদি আরবে তাদের বর্ণিত কোরানিক আইন তথা ইসলামিক আইন প্রচলিত আছে, যেখানে চুরির মতো তুচ্ছ অপরাধেও হাত কেটে ফেলার বিধান আছেগোলাম আযমের অপরাধের যে ব্যাপকতা, তাতে সেই কথিত ইসলামি আইন অনুযায়ী বহু আগেই ঢাকার রাজপথে জনসমক্ষে তার শিরচ্ছেদ হবার কথা ছিলবিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা তুলে তারা তাদের এই ইসলামি বিধান লঙ্ঘন করছেন কি না, এ প্রশ্নের তারা কী উত্তর দেবেন?

যারা সংবিধান মানে না, নারী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার স্বীকার করে না, বরং নারী ও প্রগতিশীল মানুষ এবং আইনের বিরুদ্ধে জেহাদ করে, বোমা মারে, তাদের আইনজীবীর মুখে সংবিধানকে সাক্ষী মেনে এ ধরনের কথা মানায় নাতাতে তাদের কথা ও কার্যকলাপের মধ্যকার বিস্তর ফারাকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠেসংবিধানের মৌলিক নীতি যারা মানে না, তারা স্পষ্টত রাষ্ট্রদ্রোহীতাদের আন্তর্জাতিক মানের আইনি অধিকার পাওয়ার অধিকার থাকতে পারে নাএকাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুষ্ঠনের মাধ্যমে তারা মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধ করেছে, এসব অপরাধের যারা ভুক্তভোগী, যারা হারিয়েছেন তাদের মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়পরিজন, বাড়িঘর-সম্পদ-- তাদের সুবিচার পাবার অধিকার তো চল্লিশ বছর ধরেই লঙ্ঘিত হয়ে চলেছেএখানে এসে আমার প্রশ্ন যে, কোনটা আগে বিবেচ্য হওয়া উচিত-- যুদ্ধাপরাধীর অধিকার নাকি ভুক্তভোগীদের সুবিচার পাওয়ার অধিকার?

বাংলার মানুষ যে ধরনের একটি দেশের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছিল, গোলাম আযমের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গোষ্ঠীর তৎপরতা সেরকম দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্তরায়তারা দেশ ও মানুষের যেকোনোরকম অগ্রসরমানতাকে ঠেকিয়ে রেখে প্রকারান্তরে তাকে আরো পেছন দিকে ঠেলে দিতে চায়অপরাধ তারা একাত্তরে করেছে, করেছে একাত্তরের পরেও এবং এখনো তারা একই ধরনের তৎপরতায় লিপ্ততারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীর সমানাধিকার না-মেনে সংবিধানের মৌলনীতি লঙ্ঘন করে চলেছেযাদের জন্য এদেশের জনগোষ্ঠীর ৫০ ভাগ নারী উত্তরাধিকার ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সমানাধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত, যারা এদেশে প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নে বাধা সৃষ্টি করে, যারা ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে বাধার সৃষ্টি করেছিল বিগত জোট সরকারের আমলে, যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রগকাটা, হত্যা, বোমাবাজি ইত্যাদির হোতা, তাদের জন্য বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়ে যারা অস্থির হয়ে পড়েছেন, তারা এ দেশের সাধারণ জনগণের ন্যায্য অধিকার ও সুবিচার পাওয়ার অধিকার নিয়ে কেন সোচ্চার হচ্ছেন না-- এ প্রশ্ন তাদের ভূমিকাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধারণা দেয়কাজেই যথাসম্ভব দ্রুত গোলাম আযমসহ গ্রেফতারকৃত ও গ্রেফতারের বাইরে থাকা সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর করে দেশকে রাহুমুক্ত করবার কোনো বিকল্প নেই, যদি আমরা সত্যিই এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইদেশের স্বজনহারা, সম্পদহারা, শারীরিকভাবে নির্যাতিত ও শরণার্থীর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের বিচারদৃশ্য দেখবার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের বিচার পাবার অধিকারকে নিশ্চয়ই আমরা লঙ্ঘন করতে পারি না