পারিবারিক নির্যাতনসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন
নির্যাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন
জাতীয় প্রেসক্লাব। ১৬ জুন ২০১১
আজ আমরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ! নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন আর সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনায় আজ আমরা তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের জন্যে রাজপথে নেমে এসেছি। আজ এখানে আমরা বিচারের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। নারীর ওপর পারিবারিক নির্যাতনসহ সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ জানাতে এবং সর্বস্তরের মানুষকে এসব বর্বরতা প্রতিরোধে সাহসী, সংঘবদ্ধ আর সোচ্চার হবার আহ্বান জানাতে জমায়েত হয়েছি।
গত ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মনজুরকে তাঁর বর্বর স্বামী হাসান সাইদ সুমন যে অবর্ণনীয় নৃংশসভাবে শারীরিক নিপীড়ন করেছে, সে সংবাদ আমাদের সবার জানা আছে। আমরা অনুমান করি, আমাদের মতো পুরো দেশই আজ সে নিপীড়নের ঘটনায় হতবিহ্বল এবং ক্ষুব্ধ। আমাদের মতোই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসী রুমানা মনজুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসাসহ সার্বিক আরোগ্য কামনার পাশাপাশি এই বর্বরতার বিচার দাবি করছে।
আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গতকাল এই ঘৃণ্য অপরাধীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট বাহিনী এবং সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, অবিলম্বে এই ঘৃণ্য অপরাধীর বিচার শুরু হবে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব ছাড়া এই অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করবে।
আমাদের দাবি আজ শুধু রুমানা মনজুরকে কেন্দ্র করে নয়। কারণ, রুমানা মনজুরের ঘটনাটি বর্বর নৃশংসতায় অতুলনীয় এবং অবর্ণনীয় হলেও, আমাদের সমাজে নারীর ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রম নয়। বরং, জানা ও অজানা, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের কাছে আসা ও না-আসা, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি একটিমাত্র নেত্রীস্থানীয় ঘটনা। পরিবার, কর্মস্থল, বিদ্যাঙ্গন, রাস্তাঘাট সর্বত্র নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। স্বামীর নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তিহীন, ক্ষতবিক্ষত শরীরে অসহায় রুমানা মনজুর যখন হাসপাতালে নিরাপত্তাহীন দিনযাপন করছিলেন; তখনই গত ১৩ মে মতিঝিলে এক স্বামী পিটিয়ে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন। একই দিনে, নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা এলাকায় দুর্বৃত্তরা সিঙ্গাপুর প্রত্যাগত একজন প্রবাসী নারীশ্রমিককে গণধর্ষণের পর তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এগুলোও কোনো বিরল বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। নারী নিপীড়নের এমন ঘটনা সারা দেশে প্রতি মুহূর্তেই ঘটছে, যার প্রকৃত কোনো হিসেব হয়ত কারো জানা নেই। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করার, শাস্তি দেবার দৃষ্টান্ত এবং প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পদক্ষেপ অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর।
গত মে মাসে ৯ জন নারী ও ১০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছেন ও করতে বাধ্য হয়েছেন। নারীদের যৌন নির্যাতনের শিকার হবার ৭৪টি ঘটনা শুধু সংবাদপত্রেই এসেছে। বিভিন্ন স্থানে তিনজন তরুণী আত্মহত্যা করেছেন যৌন হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে। একই সময়ে সারা দেশ থেকে ৩৫ জনের ধর্ষিত হবার সংবাদ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ২৪ জন শিশু রয়েছে। গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫ জনকে। এসব নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতার আংশিক চিত্র মাত্র, যা কেবল সংবাদমাধ্যম বা পুলিশের হিসেবে এসেছে। আমরা জানি, সামগ্রিক অবস্থা এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ।
আমরা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই এই ভয়্কংর অমানবিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, মৌখিক হয়রানি, মানসিক নির্যাতন চূড়ান্ত বিচারে সমাজের সকল নারী-পুরুষ-শিশুকে সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ অবস্থা কোনো সুস্থ সমাজের জন্য কাম্য নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে এমন অবস্থার অবসান চাই। এই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা নিচের দাবি ও আহ্বান সবার সামনে তুলে ধরছি :
- অধ্যাপক রুমানা মনজুরের নিপীড়ক বর্বর স্বামীকে অবিলম্বে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া, এই অপরাধীকে সহায়তাদানকারীদেরও বিচারের আওতায় এনে ‘অপরাধীর সহায়কদেরও সহ্য না-করা’র দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
- অধ্যাপক রুমানা মনজুরের কন্যাসহ তাঁর পুরো পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
- বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দফতর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীকর্মীদের পারিবারিক নির্যাতনসহ যেকোনো ধরনের হয়রানি, নিপীড়নমূলক প্রকৃত বা সম্ভাব্য ঘটনায় তাদেরকে সহায়তা ও পরামর্শ দেবার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীসহ বিচারব্যবস্থাকে সত্যিকার অর্থে নারীসংবেদী করে গড়ে তুলতে হবে।
- আক্রান্ত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে হয়রানিবিহীন আইনি সহায়তা দেবার জন্য পর্যাপ্ত সরকারি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে।
- নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি উদ্যোগ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেবার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত আইনি সহায়তাদানকারী সংস্থা ও নারী সংগঠনগুলোকে সরকারি কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
- নিপীড়নের শিকার ও তার পরিবারের জন্য মনস্তাস্তি¡ক সহায়তা পরিষেবার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
- নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায় এমন ধরনের নাটক-গান-বিজ্ঞাপন-বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার থেকে গণমাধ্যমকে (রেডিও-টিভি-সংবাদপত্র) বিরত রাখতে কঠোর সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
- সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন সকল রেডিও-টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের জন্য নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ জনসচেতনতামূলক সরকারি বা বেসরকারি বিজ্ঞাপন প্রচার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- নারী নির্যাতনের সকল ঘটনাকে শহর-গ্রাম-ধনী-গরিব-পেশা ও সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে সমভাবে, সমগুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
সবশেষে, আমরা মনে করি যে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এক্ষেত্রে। নারীর ওপর নির্যাতন আসলে চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সবার ওপর নির্যাতন। রুমানা মনজুরের ঘটনা এই সত্যকে আমাদের সামনে স্বচ্ছ করে তুলে ধরেছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার সনাতনী ‘সম্মান’, ‘পারিবারিক মর্যাদা’, ‘দুর্নাম’ ইত্যাদি চিন্তার বাইরে বেরিয়ে নির্যাতন প্রতিরোধে সরব হওয়া, এর প্রতিবাদে মুখ খোলা, সংগঠিত হওয়া এবং অবিলম্বে নিকটজনের সহায়তা চাওয়া। আমাদের নীরবতা নির্যাতক-নিপীড়কদের বল্গাহীন বেড়ে ওঠাকে উৎসাহিত করে। আসুন, আমরা সবাই নীরবতার এই জালকে ছিন্ন করি। কেননা, এক্ষেত্রে সোচ্চার হওয়াই আমাদের অন্যতম রক্ষাকবচ।
No comments:
Post a Comment
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)