Thursday, 26 May 2011

‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-এর বক্তব্য

আগামী জুন মাসেই ২০১১-’১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষিত হবে। সে বিবেচনা থেকে আমরা নারীসমাজের উন্নয়নে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ নির্ধারণ এবং সরকার-ঘোষিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ বাস্তবায়নের দাবি বিষয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি।

গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বর্তমান সরকার ১৯৯৭-এ প্রণীত নীতি কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে প্রণীত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত নারীনীতির প্রধান একটি দুর্বলতা হলো নারীকে উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না দেওয়া। এ সত্ত্বেও আমরা মনে করি, ঘোষিত এই নীতিটির বাস্তবায়নই এখন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত, কারণ এমডিজি দলিলের জেন্ডার সমতা সম্পর্কিত লক্ষ্যসমূহের সাথেও এটি সঙ্গতিপূর্ণ। বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমরা উত্তরাধিকারে সমতা প্রতিষ্ঠার দাবিও পুনর্ব্যক্ত করছি।

সকলের একমত হবেন যে, নারীনীতি বাস্তবায়নের জন্য দরকার হবে জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা। নারীসমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং ঘোষিত নারীনীতি বাস্তবায়নে সরকারের কী কৌশল হওয়া উচিত এবং বাজেটে কোন কোন খাতে রাজস্ব ও উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, সংক্ষেপে সেসব সুপারিশ আমরা তুলে ধরছি। 
সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন বিএনপিএস নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর। তাঁর পাশে উপবিষ্ট কাজী মদিনা ও ওমর তারেক চৌধুরী (ডানে) এবং প্রতিমা পাল-মজুমদার ও সাফিনা লোহানি (বামে)
 ৫০ শতাংশ বঞ্চিতের প্রতি মনোযোগ

আমরা জানি, দেশের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই নারী, যাদের সিংহভাগই সম্পদহীন, ক্ষমতাহীন এবং উপার্জনের সুযোগবঞ্চিত ও পরাধীন। নাগরিকদের এই অর্ধাংশকে পিছনে ফেলে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, সম্ভব নয় প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চাও। এজন্য জাতীয় বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত সম্পদ ও ক্ষমতাহীন উল্লিখিত ৫০ শতাংশ নারীর দিকে সম্পদপ্রবাহ বৃদ্ধি করা।

সুনির্দিষ্টভাবে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ

আমরা মনে করি, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে সুনির্দিষ্টভাবে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। এজন্য কালবিলম্ব না করে সময়সীমা, বাস্তবায়নকারী সংস্থা/বিভাগ, বাজেট ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক যথাসম্ভব দ্রুত বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তাছাড়া ঘোষিত নারীনীতি বাস্তবায়নের জন্য এর সঙ্গে যুক্ত সরকারের সকল পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা ছাড়াও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ মন্ত্রণালয়ের আওতায় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারীসহায়ক দক্ষ লোকবল নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার, যাঁরা নারীনীতির টার্গেট অনুযায়ী কাজ করবেন। পাশাপাশি গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাকানিজম পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করা, তার দক্ষতা ও ক্ষমতার আওতাও বাড়ানো দরকার। নারীনীতি বাস্তবায়নের সাথে যুক্তদের জেন্ডার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও এক্ষেত্রে জরুরি।

জেন্ডার-বিভাজিত তথ্যউপাত্ত

রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতিসমূহের সুষম বাস্তবায়ন ও সুযোগসুবিধা বণ্টনে বৈষম্য নিরোধের জন্য সকল মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার-বিভাজিত তথ্যউপাত্ত প্রস্তুত করবার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমরা জানি, ২০১০-’১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ১০টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বিভাজিত উপাত্ত উপস্থাপন করেছিলেন। এবার এই সংখ্যা আরো বাড়াবার জোর দাবি জানাচ্ছি।

জেন্ডার ফোকাল পয়েন্ট

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার ফোকাল পয়েন্টগুলোকে কার্যকর করা এবং প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি প্রকল্পে নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করবার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

এছাড়া নারীর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে যে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয় তার অধিকাংশেরই সদ্ব্যবহার হয় না। এসব কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা দরকার।

নারীর প্রজনন ভার লাঘবে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ

নারী উন্নয়ন নীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে পৌঁছতে হলে নারীর প্রজননভার কমিয়ে এনে সামাজিক ও উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের লক্ষ্যে স্বাবলম্বী নাগরিক হিসেবে বিকাশে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য জরুরিভিত্তিতে নারীবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মতো কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বত্র যাতে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা সহজলভ্য হয় সে ব্যাপারেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মাত্র সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠী ৪০ বছরে ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশিতে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে জনসংখ্যার যে বৃদ্ধি ঘটেছে তার ৮৭ শতাংশই দরিদ্র। এর ফলে পরিবেশ, অর্থনীতি, কৃষিজমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পানীয় জল, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, সরকারি সুযোগসুবিধা প্রাপ্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নারীর জন্য শিক্ষায়, কর্মদক্ষতায় ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠবার সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে জনবিস্ফোরণের সংকটকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা যাবে।

সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসকরণ

এমডিজি দলিলে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ১৪৪ জনে নামিয়ে আনবার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা পিছিয়ে আছে। ‘নারীনীতি ২০১১’ মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৫’র মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে নারীনীতি ২০১১’র ৩৪.৩ উপধারাটি অতি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে :
  • কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের ঘোষণাটি অতি দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া।
  • দরিদ্র প্রসূতি মায়েদের জন্য মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতা বৃদ্ধি করা।
  • ধাত্রী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সরকারি-বেসরকারি যৌথউদ্যোগে ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাটি নতুনভাবে চালু ও আধুনিকীকরণ করা এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের সকল হাসপাতালে জরুরি ধাত্রীসেবা কার্যক্রম চালু করা।
  • গ্রামে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক ব্যবস্থা চালু করা।
  • নারীর জন্য সাধারণ, প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য সেবা এবং নারীর শরীরের জন্য নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করা। একই সাথে পুরুষদের উপযোগী জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সহজলভ্য ও তা ব্যবহারের প্রসার ঘটানের ব্যবস্থা নেয়া।
  • সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে যথাযথভাবে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রসূতি সেবা এবং মানম্পন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা পৌঁছানোর জন্য জেন্ডার পোভার্টি ম্যাপিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নারী ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে তাঁদের বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান এবং চলাফেরার নিরাপত্তা বিধান করা।
  • নারীর পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।
কর্মসংস্থান ও কর্মস্থলে সমসুযোগ, অংশীদারিত্ব, সমমজুরি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

এই বিষয়গুলো এমডিজিরও অন্তর্ভুক্ত। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি। দক্ষতা এবং সক্ষমতা না থাকলে শ্রমবাজারে সুযোগ দিলেও নারীরা তা গ্রহণ করতে পারবেন না। দক্ষতা এবং সক্ষমতার প্রশ্নে সরকারি চাকুরির ১৫ শতাংশ পদ, যা নারীর জন্য কোটা করে দেওয়া হয়েছিল তা এখনো পূরণ হয় নি। তাই নারীনীতি ২০১১-এর উল্লিখিত ধারাগুলো কার্যকর করার জন্য বাজেটে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে :
  • নারীকে উচ্চ প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং বেসরকারি খাতকে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে প্রণোদিত করা। গ্রামাঞ্চলেও এসব সুযোগ প্রসারিত করা।
  • মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও অন্যান্য দেশে নারীকর্মীর যে চাহিদা রয়েছে সে চাহিদা পূরণ করতে অদক্ষ নারীদের প্রেরণ না করে ধাত্রী, নার্স ও অন্যান্য ক্ষেত্রের দক্ষকর্মী প্রেরণের ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিদেশে নারীকর্মীদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দূতাবাসসমূহে নারীসংবেদী জনবল বৃদ্ধি করা ও কনস্যুলার সার্ভিসকে শক্তিশালী করা।
  • দেশি ও বিদেশি কর্মক্ষেত্রে সুফল দেয়, এমন বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার জন্য নারীদের জন্য জেলা পর্যায় পর্যন্ত ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। 
  • ‘১০০ দিনের নিশ্চিত কর্মসূচি’র আদলে ‘১০০ দিনের নিশ্চিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি’ গ্রহণ করা। 
  • নারীদের মধ্যে যারা অতিশয় দরিদ্র, তাদের জন্য সেফটি নেট কর্মসূচিগুলোর পরিমাণ ও আওতা বৃদ্ধি করা এবং সকল বার্ধক্যপীড়িত নারীর জন্য বিমার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে সন্তান বা অন্য কারো ওপর তাঁদের নির্ভরশীল থাকতে না হয়।
নারীকর্মীদের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা, বাসস্থান, বিশ্রামাগার, পৃথক টয়লেট স্থাপনসহ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ

কর্মস্থলের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত কতগুলো মৌলিক ও অবকাঠামোগত অসুবিধা দূর করা না গেলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সম্ভব হবে না। এসব সমস্যা দূরীকরণে আগামী বাজেটে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে :

  • প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা।
  • কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতকালে নারী কর্মজীবীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকেন। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে প্রশাসনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
  • পরিবহণ সুবিধা প্রদানের জন্য বিআরটিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসে নারী কর্মজীবীদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে টিকেটের ব্যবস্থা করা।
  • নারী কর্মজীবীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি উদ্যোগে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপন করা।
  • নারীর উপস্থিতি বেশি এরকম কর্মস্থলে নারী কর্মজীবীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
নারীদের জন্য শিক্ষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করা

গত কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক স্তরে নারীর জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকার ফলে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে সংখ্যাগত বৈষম্য দূর হয়েছে। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও বাংলাদেশ সফল হয়েছে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই। কিন্তু ঝরে পড়ার হার এখনো অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থেকে যাওয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষায় এখনো ব্যাপক জেন্ডার বৈষম্য রয়েছে। গত ১০ বছরে এই বৈষম্য কমেছে অতি সামান্যই। তাই এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে উচ্চতর শিক্ষাস্তরে জেন্ডার সমতা অর্জন করার জন্য নারীনীতির ২১.১ উপধারাটি বাস্তবায়নের জন্য আসন্ন বাজেটে নিম্নোক্ত খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে :
  • উচ্চতর শিক্ষা নারীর জন্য অবৈতনিক করা। স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করার সরকারি ঘোষণাটি দ্রুত কার্যকর করা।
  • শিক্ষার উচ্চস্তরে, বিশেষ করে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষায় নারীর প্রবেশের পথ সুগম করার জন্য বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
  • শিক্ষাব্যবস্থাকে জেন্ডার সংবেদনশীল করবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ।
  • উচ্চস্তরে শিক্ষারত নারীশিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা।
  • কারিগরি শিক্ষায় নারীর প্রবেশ সুগম করতে সব জেলা এবং উপজেলা স্তরে পাবলিক-প্রাইভেট যৌথউদ্যোগে কেবল নারীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। 
  • তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর প্রবেশ সুগম করতে নারীর জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট স্থাপনকে উৎসাহিত করা।
  • কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতন ও পাচার রোধে যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
নারী কৃষিশ্রমিকদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ

নারীর শ্রমকে দৃশ্যমান করার নীতি গ্রহণ নারীনীতি ২০১১’র একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একাধিক ধারায় এই নীতির প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন, ২৩.৯ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান প্রতিফলনের জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ সকল প্রতিষ্ঠানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ২৩.১০ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারের জাতীয় হিসাবসমূহে, জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সকল নারীশ্রমের সঠিক প্রতিফলন ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর শ্রম স্বীকৃত হলে কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, কৃষক কার্ড, ঋণ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে নারী কৃষিশ্রমিকদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আগামী বাজেটে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে :

  • কৃষিক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে নারীর জন্য কোটা রাখা।
  • কৃষি উপকরণ, সার, বীজ, কৃষক কার্ড, ইত্যাদি প্রদানের জন্য নারীর জন্য পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করা।
  • কৃষির যেসব ক্ষেত্রে নারী ৬০-৮০ শতাংশ শ্রম দান করে, সেসব ক্ষেত্রে গৃহীত বাজেটারি প্রণোদনার সিংহভাগ নারীর জন্য বরাদ্দ করা;
  • গার্হস্থ্য উদ্যান বিকাশের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
  • কৃষিঋণ প্রদানের জন্য পৃথকভাবে নারীর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর হলে কৃষিক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা আনয়নে অবদান রাখবে। আর এই অবদানের কারণে সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা আনার জন্য এমডিজির লক্ষ্যসমূহও অদূর ভবিষ্যতে অর্জিত হবে।

নারীউদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করতে সহায়তা প্রদান

নারীনীতির এই ধারাটি এমডিজির লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমডিজির লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে অকৃষিখাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে গত তিন দশকে নানা বাজেটীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যার প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক কর্মের লাভজনকতা ও প্রসারের সম্ভাবনা খুব কম হওয়ায় গত কয়েক বছরে আর কর্মসম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় নি। তবে গত কয়েক দশকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে যে নারীউদ্যোক্তা গোষ্ঠীটি গড়ে উঠেছে, সহায়তা পেলে তারা মধ্যম বা বৃহৎ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।

নারীউদ্যোক্তাদের বিকাশ হলে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনাও তুলনামূলকভাবে বেশি হবার সম্ভাবনা আছে। নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাও নারীনীতি ২০১১-র আরেকটি লক্ষ্য। অর্থাৎ নারীউদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করা গেলে একের অধিক লক্ষ্য অর্জিত হবে। এজন্য আমরা নিম্নলিখিত বাজেটারি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করছি।
  • সম্পদে নারীর সীমিত অভিগম্যতাই নারীউদ্যোক্তাদের বিকাশের জন্য সবচাইতে বড়ো প্রতিবন্ধকতা। সম্পদে নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি এবং সহজ করার জন্য বাজেটে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন নারীউদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া।
  • নারীর মালিকানা ও পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নারীবান্ধব সুবিধাদিসহ (টয়লেট, শিশু দিবাযত্ন ব্যবস্থা, যাতায়াত প্রভৃতি) একটি বিশেষ সংখ্যায় নারীকর্মী নিয়োগ দেয়, তবে সে প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্টমাত্রায় কর রেয়াত দেওয়া।
  • নারী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেগুলোতে শতভাগ কর্মী নারী, সেসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানির ওপর শুল্ক রেয়াত দেওয়া। 
  • নারীউদ্যোক্তাদের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য লাভজনকভাবে বাজারজাত করার সুযোগ সৃষ্টিতে নারীদের সমবায়ী উদ্যোগে স্থায়ী বিপণন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য করউৎসাহ প্রদান করা।
  • প্রকৃত নারীউদ্যোক্তারা যাতে সহজেই গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ পেতে পারেন, সেজন্য রাজস্ব বাজেটে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া। এক্ষেত্রে নারীকে ব্যবহার করে জালিয়াতি যাতে না হয় তেমন পদক্ষেপও রাখতে হবে।
  • সর্বোপরি, সর্বক্ষেত্রে নারীউদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রাজস্ব বরাদ্দ রাখা।
আমরা মনে করি, দ্রুত নারীনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজির নারীবিষয়ক ক্ষেত্রগুলোতে সাফল্য অর্জনে আমাদের প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো আগামী বাজেটে বিবেচনায় নেওয়া হলে বিশেষভাবে সুফলপ্রসূ হবে।

[গত ১৮ মে ২০১১ সাংবাদিক সম্মেলনে (ভিআইপি লাউঞ্জ, জাতীয় প্রেসক্লাব) নিম্নোক্ত বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়]
সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য
সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের খবর

No comments:

Post a Comment

লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)