গত তিন দশক ধরে ক্রমাগতভাবে তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা ঘরের বাইরে এসে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন। তারা ইউনিয়ন পরিষদসহ তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন নেতৃত্বে বিভিন্নভাবে জায়গা করে নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনসমূহে ভোটার হিসেবে নারীর ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর এ সাফল্য বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নারী সংগঠন ও এনজিওসমূহের দীর্ঘদিনের আন্দোলেনরই ফসল। এ সাফল্যের ফলে সরকারও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার চাপও সরকারকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে বাধ্য করছে। এরই ফসল হিসেবে নবম জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে, মন্ত্রিসভায় ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী স্থান করে নিয়েছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করেছেন, সুযোগ পেলে তাঁরাও দক্ষতা দেখাতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার সরকার গঠনের পর থেকেই নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে একের পর এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এসব আমাদের মনে আশার সঞ্চার করছে। কিন্তু এ আশার আলো ম্লান হয়ে যায়, যখন দেখি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী বর্বর সংহিসতার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি নারীর ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় দোররা মারার বেশ কিছু খবরও এসেছে মিডিয়ায়। ফতোয়াবাজদের হিংস্রতার শিকার হয়ে নারী যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সফল নারীরা দরিদ্র অসহায় এসব নারীর সহায়তায় কতটা এগিয়ে আসছেন।
১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে নারীদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের আইন পাস হওয়ার পর বহু নারী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর সমাজের কাছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে দেয়া প্রতিশ্র“তি পালন করতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁদের যথেষ্ট ক্ষমতা ও সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে না। তারপরও তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। এই সমস্ত উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠনও তাদের সহযোগিতা করেছে। তৃণমূলের নারীর এ অগ্রগতিকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ভালোভাবে নিতে পারে নি। কারণ এতে তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত লেগেছে। ২০০১-এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন পর্যায়ে ইতঃপূর্বে নির্বাচিত নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের বোরকা পরে নমনীয় হয়ে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি ওই স্বার্থান্বেষী মহলের কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের নারী নেতৃত্বকে চরম অপমানও করেছে। কিন্তু নির্যাতিত নারীরা এতে দমে যান নি। তাঁরা সংগঠিত হয়ে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রত্যাখান করেছেন ২০০৮-এর নির্বাচনে।
আশার কথা, ২০০৮-এ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেশবাসীও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সরব অংশগ্রহণের সুযোগ পুনরায় কিছুটা হলেও অবারিত হওয়ার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হওয়ার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। এর ফলে সমাজে তাদের ক্ষমতা সংহত করার উদ্দেশ্যে এরা হিংস্র আচরণের মাধ্যমে নারীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নারীকে দোররা মেরে গলায় জুতার মালা পরিয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ভূমিকা ন্যাক্কারজনক। তারা এই ধরনের নারী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে প্রায়ই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। কেবল ওপর থেকে চাপ সৃষ্টি হলে কিছু করার চেষ্টা করে থাকে, যা প্রায়ই যথাযথ হয় না।
লক্ষ করা গেছে, দরিদ্র নারীরাই প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থানেষী মহলের নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। এ বিবেচনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাই হতে পারে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির বড়ো হাতিয়ার। এক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষা অধিক ফলপ্রসূ হতে পারে। এছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু পরিবারের নারীরাও তুলনামূলকভাবে অধিক হারে নির্যাতনের শিকার। যশোরে সম্প্রতি এক দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণের ঘটনা এসবেরই ধারাবাহিক ফল। কাজেই এই নির্যাতিতদের রক্ষায়ও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
অভিযুক্তরা যত প্রভাবশালীই হোক, তারা যেন পার পেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না সে বিষয়ে মনিটরিংও জোরদার করতে হবে। প্রশাসনকে গতিশীল করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে কাজ হবে, নইলে নয়; এ সংস্কৃতির অবসান হওয়া আবশ্যক। প্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর না-হলে এরা একসময় বেপরোয়া হয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইবে।
সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। স্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরই নৈতিক দায়িত্ব। এটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই যে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কেবল নারীরাই সোচ্চার হবেন। নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এই মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় হওয়া সকলের নাগরিক দায়িত্বও বটে। কারণ মানবাধিকার ক্রমাগত লঙ্ঘিত হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।
No comments:
Post a Comment
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)