Showing posts with label নারীর ক্ষমতায়ন. Show all posts
Showing posts with label নারীর ক্ষমতায়ন. Show all posts

Tuesday, 11 December 2012

বাংলাদেশের চল্লিশ বছর : নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্জন : রোকেয়া কবীর

‘পরিবার ও পরিবারের পুরুষ সদস্য-- বাবা, ভাই, স্বামী নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি’-- এমন প্রচলিত ধারণা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে। কোনো পুরুষ নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, পরিবারের বাবা-ভাই-স্বামী তাদের রক্ষা করে নি ও করতে পারে নি। একদিকে যুবক ও সক্ষম পুরুষদের বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা যুদ্ধকালে বর্তমান ছিল না, অন্যদিকে এদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন ও একাংশ পালিয়ে বেড়িয়েছেন আত্মরক্ষার স্বার্থে। এমনকি বাবা, ভাই বা স্বামীর কাছ থেকেও নারীদের হায়েনারা ছিনিয়ে নিয়েছে, যারা নিদারুণ নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এটা এখন প্রমাণিত যে লক্ষ লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় যৌন নির্যাতনের শিকার বা যুদ্ধাহত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এর বাইরে যারা দেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাদের বৃহদাংশ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যারা অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেন নি, তারা অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন, বৃদ্ধ ও শিশুদের সেবা দিয়েছেন, গরুবাছুর-ঘরবাড়ি-গাছপালা দেখে রেখেছেন, দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে ধরে রেখেছেন। যার অনেক দলিল আমরা পেয়েছি আমাদের গবেষণা ও সাহিত্যকর্মে, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাসে। নারীর এই অবদানকে মনে রেখে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে আমরা যদি বাংলাদেশে নারীর স্থান নির্ধারণ করতে যাই তাহলে আমরা দেখি যে, তার অর্জন বৃহৎ। যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষভাবে সামনে এগিয়ে গেছে বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে; যেমন সামাজিক উন্নয়ন, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা, আন্তর্জাতিক মন্দার ধাক্কা সামলানো, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার, তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষমতায়ন, ভোটার হিসেবে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ, পোশাক রফতানিতে প্রথম সারিতে স্থান লাভ, ইত্যাদি সবকটির পেছনেই নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য।  

স্বাধীনতার পর প্রণীত মহান সংবিধানে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত হবার পর ক্রমান্বয়েই নারী দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নারীবর্ষ’ ঘোষিত হলে সে অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সক্রিয় হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৯৭৬-১৯৮৫ মেয়াদের ১০ বছরকে ‘নারী দশক’ হিসেবে ঘোষণার প্রেক্ষাপটে নারী অধিকারের বিষয়গুলো উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের সর্বস্তরের নারীদের সার্বিক উন্নয়ন ও অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি মহিলা সংস্থার রূপরেখা প্রণীত হয়, যা জাতীয় মহিলা সংস্থা নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, ১৯৯১ সালে যা একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। এই সংস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে, তা অধিকার সচেতন করার পাশাপাশি নারীদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। নারীদের কল্যাণে আলাদাভাবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, জাতীয় সংসদে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নারীর সুরক্ষা ও অগ্রগতির জন্য ক্রমশ প্রণীত হয়েছে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, নারী নির্যাতন (নিবর্তন) আইন, প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলককরণ) আইন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, পারিবারিক আদালত বিধিমালা, এসিড অপরাধ দমন আইন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রভৃতি। নারীর অনুকূলে আইন-বিধি ও নীতিমালার মধ্যে সিডও সনদের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য পদক্ষেপ, ২০০৪-এ রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হলেও পরে ২০১১-এ এসে যা পুনরায় চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছে। এই নারী উন্নয়ন নীতিই স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে; যা তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের ক্ষমতায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার নিয়োগবিধির খসড়ায় একজন সিইসি ও দুজন কমিশনারের একজন নারী নিয়োগের বিধান রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করে করা নির্বাচন কমিশনের বিধান, সন্তানের পরিচয়ে বাবার নামের পাশে মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী নিয়োগের বিধান প্রভৃতি সিদ্ধান্তও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে দেখলে বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে নারীরা এক্ষেত্রে ক্রমাগত যে সাফল্য অর্জন করেছে, সরকারের বর্তমান মেয়াদে তা সর্বাপেক্ষা বেশি। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র ৫ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ৪ জন, ১৯৯৬-এর নির্বাচনে ১১ জন ও ২০০১-এর নির্বাচনে ৬ জন নারীর বিজয়ের রেকর্ডকে টপকিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনে ১৯ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এদিকে সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ২০১১ সালে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এ। সব মিলিয়ে চলতি সংসদে সর্বমোট ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও সংসদ উপনেতার প্রত্যেকেই নারী। হুইপ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন তাঁরা। এছাড়া বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় এ মুহূর্তে পররাষ্ট্র, কৃষি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন তাঁরা।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার, যা পুরুষ ভোটারের চেয়েও প্রায় ১৫ লাখ বেশি। সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় তৃণমূলসহ সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায় নারীরা ভোটার হিসেবে অংশ নিয়েছিল অন্য যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এই নির্বাচনে নারীরাই প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।   

স্থানীয় সরকার, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নারীর ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ পৃথিবীর মধ্যে নজিরবিহীন। সর্বশেষ ২০০৩ সালের পর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের চার হাজার ৫০৪টি ইউনিয়নে সংরক্ষিত কোটায় সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৩ হাজার ৫১২ জন নারী সদস্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এর পাশাপাশি ২৩২ জন নারী চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন ২২ জন। সারা দেশে ৪৮২টি উপজেলার মধ্যে ৪৮১টির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি। এর মধ্যে সংরক্ষিত কোটায় ৪৮১ জন ভাইস চেয়ারম্যান ছাড়াও সরাসরি নির্বাচনে তিনজন নারী উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। কাজ করছেন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর নারীরাও। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রভাবশালী পুরুষ প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হবার গৌরবজনক স্থানটিও দখল করে নিয়েছেন একজন নারী।

প্রশাসনে নারী অংশগ্রহণের চিত্র এখনো হতাশাব্যঞ্জক হলেও অংশগ্রহণের পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ৮ হাজার ৬০০ জন কর্মকর্তার মধ্যে এক হাজার ২৪৬ জন নারী। সচিব ও সমমানের ৬৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী ৪ জন। ১৫৭ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৯ জন এবং ৪২৯ জন যুগ্মসচিবের মধ্যে নারী ২৭ জন। সব মিলিয়ে প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ। জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান হিসেবে নারীরা সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পউদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬ শত ৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম ক্ষেত্র গার্মেন্টস খাতের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী। দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের করা এক হিসেবে জানা যায়, নারী বিনা পারিশ্রমিক ও কম পারিশ্রমিকে যে পরিমাণ শ্রমদান করে, তা টাকার অঙ্গে জিডিপির শতকরা ৪৮ ভাগ। এই চিত্র নারীর অর্থনৈতিক অবদানের ব্যাপ্তিটা সামনে হাজির করে, যার মাধ্যমে জাতীয় আয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে আজ আমাদের নারীসমাজ।

মাত্র ১৪ জন সদস্য নিয়ে ১৯৭৪ যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ পুলিশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন নারীরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩৭ জন; যাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদেও (একজন ডিআইজি, ৪ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, অতিরিক্ত এসপি ১৯ জন, সিনিয়র এএসপি ১০ জন, এএসপি ৭৭ জন, ইন্সপেক্টর ৫৩ জন, এসআই ১৮৯ জন, এএসআই ও হেড-কনস্টেবল ২৫৩ জন) অনেকে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০১১ সাল থেকে ৩৭১ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন একটি নারী ইউনিট। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ১১ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এই ইউনিটটি ৭০০-র অধিক সদস্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন হবার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক’। এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিমিশন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ট্রেনিং স্কুল এবং থানার ওসি হিসেবেও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ও করছেন আমাদের নারীরা। নারীরা আজ সাফল্যের সাথে কাজ করে চলেছেন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীতেও, যাঁদের অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে নিয়োজিত।

আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবেও নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন অনেকে।

বর্তমান সরকারের মেয়াদে গঠিত তথ্য কমিশনে কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন একজন নারী। জেলা তথ্য বাতায়ন এবং জাতীয় ই-তথ্যকোষ বর্তমান সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ই-তথ্যকোষ তথ্যপ্রযুক্তির সাথে পরিচিত নারীর হাতে তার জীবন ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ধরনের তথ্য (কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন ও মানবাধিকার, নাগরিক সেবা, পর্যটন, অকৃষি উদ্যোগ, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শিল্প ও বাণিজ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান) পৌঁছে দিয়েছে, যা তাদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সাংবাদিকতার মতো পেশায় সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এটা ঠিক যে, মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী অংশগ্রহণ এখনো প্রায় নেই বললেই চলে। তবু নারীদের এই খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অংশগ্রহণ তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও অর্জনকে গণমাধ্যমে হাজির করার ক্ষেত্রে অনুকূলতা দিয়েছে।

শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুবই প্রশংসনীয়, তবে সেটা বিদ্যালয়ে ভর্তি ও পাসের ফলাফল অর্জনের দিক থেকে। তবে দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, পরিবারের অনাগ্রহ, বাল্যবিয়ে প্রভৃতি কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হতে না-হতেই বিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার প্রবণতা এখানে এখনো উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থা চর ও হাওর এলাকার মতো প্রত্যন্ত ও অনগ্রসর অঞ্চলে বেশি। তবে উচ্চশিক্ষাস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সার্বিকভাবেই কম। বেনবেইসের ২০১১-এর হিসেব অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৫০.৫০ ও ৫৩.৬১ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মেয়েশিক্ষার্থী মাত্র ২৯.৯৮ শতাংশ। পেশাগত এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়ও তাদের অংশগ্রহণ এখনো খুব একটা বাড়ে নি। এ হার যথাক্রমে মাত্র ৩৬.৪২ ও ২৭.০২ শতাংশ। এ সময়ের আরেকটি প্রবণতা লক্ষণীয় যে, মাদ্রাসায় মেয়েদের অংশগ্রহণ আগের চেয়েও বেড়েছে। বেনবেইস রিপোর্ট বলছে, এ হার ২০১১-এ ছিল ৫৩.২৩ শতাংশ। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, মাদ্রাসায় পড়া মেয়েরা শিক্ষিত হলেও তাদের মুক্তচিন্তার দুয়ার সেভাবে উন্মোচিত হয় না। নারীর সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের আন্দোলনে মেয়েদের এ অংশ অনুকূল শক্তি হিসেবে যুক্ত হয় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জেন্ডার অসংবেদনশীল উপাদান রয়ে গেছে। যেমন, পাঠ্যবইয়ের পিতা যখন সম্পত্তি বা অর্থের ভাগবাটোয়ারা করেন, তখন ছেলে যত বড়ো ভাগ পায়, মেয়ে ততটা পায় না। নারী-পুরুষ উভয়কে যখন কর্মরত দেখানো হয়, তখন পুরুষকে বিমান চালনায় দেখানো হলেও মেয়েকে দেখানো হয় রান্নাবান্না করতে। পাঠ্যপুস্তক যাঁরা প্রণয়ন করেন, যাঁরা এর জন্য ছবি আঁকেন, যাঁরা সম্পাদনা করেন তাঁদের মনোগঠনে যে পুরুষতান্ত্রিকতা জায়গা করে নিয়েছে, প্রকারান্তরে তার ছাপই পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রিত হয়ে যায়। কী ছেলে কী মেয়ে উভয়েই এসব উপাদানের কারণে নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে শৈশব থেকেই নেতিবাচক ধারণা লাভ করতে শুরু করে। ছেলেরা মেয়েদের তাদের চেয়ে হীন ভাববার অবকাশ পায়, বিপরীতে মেয়েরা ভোগে হীনম্মন্যতায়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীবিরোধী মনোভাব বিকাশে এই শিক্ষাব্যবস্থারও ভূমিকা আছে। নতুন করে প্রকাশিত পাঠ্যবইয়ে এসব উপাদান একটু একটু করে কমে আসলেও পরিপূর্ণভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যপুস্তকের জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে। তা না হলে একদিকে আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে কাজ করে যেতে থাকব, অন্যদিকে সকল শিশুর মাথায় বৈষম্যের বীজ বপন করা হতে থাকবে।

বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। নারীদের জন্য এটা অনেক বেশি হতাশাব্যঞ্জক। এ সমাজ নারীকে তার অসুখ গোপন করতে ও সহ্য করতে শেখায়। এভাবে অসুখ যখন ভয়ানক হয়ে ওঠে, তখনো প্রায়ই তাদের জন্য জোটে না আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ। ঝাক-ফুঁক, তাবিজ-কবিরাজ এদেশে আজো নারীদের চিকিৎসার প্রধান ক্ষেত্র। সমাজ নারীর সুস্থ থাকার প্রয়োজনকেই আজো গৌণ করে দেখে। যেজন্য একই পরিবারে একইরকম স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছেলের দেখা দিলে যে ব্যবস্থা, মেয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা ভিন্ন হয়। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে লুকোছাপা করতে হওয়াই যেন সামাজিক রীতি। অথচ প্রজননতন্ত্রের যেকোনো রোগ ভবিষ্যৎ জীবনে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় নিজেরা উদ্যোগী হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবার ক্ষেত্রেও নারীর জন্য নানা বাধা আছে। প্রথমত, পরিবার প্রায়ই নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার স্বাধীনতাকে মেনে নেয় না; দ্বিতীয়ত, এদেশের সিংহভাগ নারীরই পরিবারের অন্য কারো অর্থ সহযোগিতা ছাড়া নিজ খরচে চিকিৎসা করবার সামর্থ্য নেই; তৃতীয়ত, যৌনরোগের চিকিৎসা করানোর খবর রাষ্ট্র হলে সমাজে দুর্নাম ছড়াবার সম্ভাবনা থাকে; এবং চতুর্থত, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো এ ধরনের চিকিৎসার জন্য গেলে মেয়েদের সাথে পেশাদারি আচরণ করে না।

বাংলাদেশে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার গত কয়েক বছরে অনেকটা কমেছে। বর্তমানে এই হার বছরে প্রতি লাখে ১৯৪ জন, ২০০১-এ যা ছিল ৩২২। যদিও এক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে, তারপরও এই মাতৃমৃত্যু অগ্রহণযোগ্য। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে চিকিৎসাহীনতা কিংবা অবহেলায় একজন মা মারা যাওয়াও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, যাতায়াতের অব্যবস্থা, সামাজিক সংস্কার, পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধজনিত অবহেলা, শরীর পরিণত হবার আগেই গর্ভধারণ করতে বাধ্য হওয়া, ইত্যাদি কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এই হার ১৪৩-এ নামিয়ে আনতে হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে।

সম্প্রতি কেয়ারের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে শুধু নারী নির্যাতনের কারণে প্রতি বছর ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা খরচ হয়, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এ চিত্র দেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতারই স্মারক বহন করে, যে বর্বরতা এদেশে এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। স্বীকার করতে বাধা নেই যে, হাজার বছর ধরে টিকে থাকা বৈষম্যমূলক সংস্কৃতি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। এই বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে অপনোদন করা না-গেলে নারী নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সচেতনতা সৃষ্টি, বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নির্যাতনমূলক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হলেও মূল লক্ষ্যটা পরিকল্পিত হওয়া উচিত বৈষম্য বিলোপের জন্যই।

বর্তমান সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির তৃতীয় পর্ব বাস্তবায়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর অধীনে পরিচালিত এই প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি সংস্থাসমূহের সাথে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনে সহিংসতা হ্রাস করা এবং সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণ; নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সমন্বিত গুণগতমানসম্পন্ন, দক্ষ ও টেকসইসেবা প্রদান; সমন্বিত/আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের মাধ্যমে নারী নির্যাতন সম্পর্কিত কার্যক্রম গ্রহণে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ; নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার অর্জন এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যেই আটটি মেডিকেল কলেজে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিসি সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে ৪০টি ও উপজেলা পর্যায়ে ২০টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল খোলা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি ও অন্য সাতটি মেডিকেল কলেজে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন, নির্যাতিতদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ, নারী নির্যাতন বিষয়ক জাতীয় ডাটাবেইজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার (হটলাইন ১০৯২১) স্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরেও চলছে নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্যাতনবিরোধী গণসচেতনতা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে পাস হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০। এই সবকিছু মিলিয়ে সরকারি যে তৎপরতা দৃশ্যমান হচ্ছে তা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটা ভালো সুফল দেবে বলেই আশা করা যায়। তবে আমাদের মনে হয়, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি অর্থ মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা হতো এবং সমাজে বিদ্যমান সার্বিক বৈষম্য বিলোপের জন্য প্রকল্পের আওতায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারিত হতো তাহলে সুদূরপ্রসারী অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারত। সেটা হওয়া জরুরিও। কারণ নির্যাতন ও বৈষম্যময় পরিবেশ নারীর ক্ষমতায়নের অনেক বড়ো অন্তরায়।

জাতীয় বাজেট দেশের সকল মানুষের বাজেট। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত জাতীয় বাজেটের লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, জাতীয় বাজেটের স্বার্থ মূলত পুরুষদের দিকেই ধাবিত হয়। কারণ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা পুরুষের সমস্তরে নেই। সেজন্য নারীসমাজের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি ছিল, নারীকে চিহ্নিত করে বাজেট ঘোষণা করা। গত কয়েক বছর ধরে বিদ্যমান অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, যেটা আশাব্যঞ্জক। সর্বশেষ ২০১২-’১৩ অর্থবছরে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডারভিত্তিক বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। এ প্রক্রিয়ায় ক্রমশ সবকটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটই জেন্ডারভিত্তিক করা হবে বলে আমরা আশা করি। তাছাড়া আমাদের বাজেটের আরেকটা বড়ো দুর্বলতা হলো সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় করতে না-পারা। যদি বাজেট ব্যয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি না-করা হয় এবং ব্যয়িত বাজেট কতটা প্রভাব রাখল তা মনিটর করা না-হয়, তাহলে নারীর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ও জেন্ডারভিত্তিক বাজেট নির্ধারণও তেমন সুফল বয়ে আনতে পারবে না।

নারীর ক্ষমতায়ন বলতে সমগ্র নারীসমাজের ক্ষমতায়নকে বুঝতে হবে এবং সেক্ষেত্রে উল্লিখিত সবকটি বিষয়কেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত করে দেখা দরকার। অবশ্য এটা ঠিক যে, নারীদের মধ্যকার একটা ক্ষুদ্র অংশ আজ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অংশত ক্ষমতায়িত হয়েছেন। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমান অবস্থায়ও এ সংখ্যা আরো বাড়বে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এ গতিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না। গতি আরো বাড়াতে হবে, সেজন্য বড়ো বড়ো প্রতিবন্ধকতা দূর হবার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।

নারী আজও যেমন উত্তরাধিকারে সমঅধিকার অর্জন করতে পারে নি; এমনকি একমাত্র সন্তান মেয়ে হলেও সে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পায় না। এই বিধান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিতে এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকে এ অধিকার দিতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী রাজনৈতিক দলসমূহের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করা ও এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে এলে নারী সংসদ সদস্যদের জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। তাতে টেবিল চাপড়িয়ে বা কণ্ঠ উঁচিয়ে দলকে ভোট দেয়াই তাঁদের প্রধান কাজ হবে না, বরং রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার মানসিকতা তৈরি হবে। উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের পথে দেখা দেওয়া বাধাগুলো অপসারণেও।

আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান সরকার ও সংসদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজগুণে আজ নারীরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রশাসনের অনেক শীর্ষস্থানীয় পদেও আজ নারীরা আছেন। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়েও অনেক বড়ো বড়ো করপোরেট ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার আজ সাফল্যের সাথে সামলাচ্ছেন নারীরা। সরকারি-বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা হাল ধরে আছেন। অনেকে সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। অপ্রচলিত পেশা ও কাজেও আজ অনেক নারী কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন; এমনকি সর্বশেষ এভারেস্টশৃঙ্গ জয় করেও আমাদের বোনেরা দেখিয়েছে যে, তারা নিষ্ঠা ও যোগ্যতায়ও আজ আর কারো থেকে পিছিয়ে নেই। এই গতিটাকে আমাদের আরো সামনে এগিয়ে নিতে হবে। সেজন্য নারীদের কোনো অন্যায্য সুবিধার দরকার নেই, দরকার কেবল তার চারপাশে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে সেগুলো দূর করবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এরকম একটি বাধা হলো নারীর কাঁধে চেপে বসা গার্হস্থ্য ও প্রজনন কর্মভার। সনাতনী এই কর্মভার নারীকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে।

যদি গার্হস্থ্য দায়-দায়িত্বগুলো পরিবারের সবাই মিলে ভাগ করে করবার সংস্কৃতি তৈরি করা যায়, তাহলে নারী নিজেকে বিকশিত করবার সুযোগ পাবে। গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন সহজ করার জন্য প্রত্যেক ঘরে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুব্যবস্থাপনা পৌঁছে দিতে হবে। পর্যাপ্ত শিশু দিবাযতœকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যাতায়াত সুগম করতে হবে। এসব করা হলে সংসার সামলিয়েও নারী অন্য কাজে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া এতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এর বাইরে বিয়ে করা না-করা এবং কটি সন্তান কখন নেবে না-নেবে ইত্যাদি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার স্বাধীনতা যদি নারীরা ভোগ করতে পারে, তাহলে তাদের এই ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসর হওয়া আরো একটু সহজ হবে। আর এসব সুযোগ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র নারীদের দিয়েই রেখেছে, এখন দরকার আমরা যারা তাদের সেই সুযোগ ভোগে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত, তাদের এ কাজে নিরস্ত হওয়া। 

Wednesday, 5 September 2012

গ্রামীণ ব্যাংক, ড. ইউনূস এবং নারীর ক্ষমতায়ন : রোকেয়া কবীর

যুক্তি বা বাস্তবতা দিয়ে যাচাই না-করে হুজুগে চলা এবং ভাবাবেগে তাড়িত হবার বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আমাদের কুখ্যাতি থেকেই ‘চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছনে দৌড়ানো’র পরিচিত প্রবাদটির প্রচলন। সাধারণত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, যুক্তি দিয়ে বিচার করবার প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত মানুষের মধ্যেই এ প্রবণতা লক্ষণীয় হবার কথা। কিন্তু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কিছু সাধারণ প্রভাব সবার মধ্যে থেকে যাওয়াটি অস্বাভাবিক নয়; বিশেষত যে সমাজে বিদ্যায়তনগুলোতে যুক্তি, বুদ্ধি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা এখনো যথাযথ স্থান করে নিতে পারে নি, সেখানে এমন প্রবণতা শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও থেকে যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে হুমায়ূন আহমেদের দুঃখজনক অকালমৃত্যু-পরবর্তী একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়কেন্দ্রিক ঘটনাবলি এবং আমাদের জাতীয় অহংকার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবলোকন করে মনে হচ্ছে, আমাদের এখানে যাঁরা শিক্ষিত ও আলোকিত বলে বিবেচিত, এ সময়ের পপুলার ভাষায় ‘সিভিল সমাজ’-এর অংশ, তাঁদেরও অনেকের কথা বা বক্তব্য অনেকটা ‘চিলে কান নেয়ার’ লক্ষণদুষ্ট।

ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সরকারি দল ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সিভিল সমাজের একটি বড়ো অংশই তাঁদের বক্তব্যে ও লেখায় ড. ইউনূসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা বলতে চান, সরকারের পদক্ষেপের কারণে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। দেশের সবেধন নীলমণি নোবেল বিজয়ী একজন বাংলাদেশি ব্যক্তির (কেউ কেউ বলেন মুসলিম) নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টাকে আমরা জাতি হিসেবে মর্যাদা দিতে পারি নি। অনেকে আবার বলছেন, অন্য কেউ কেউ নোবেল প্রাপ্তির আশায় ছিলেন, কিন্তু পান নি বলেই হিংসার বশবর্তী হয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ কেউ আরো খানিকটা এগিয়ে বলছেন, সরকারের পদক্ষেপের ফলে নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের পথিকৃৎ মডেল হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃত গ্রামীণ ব্যাংকের উপকারভোগী নারীদের ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারের এই পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে অনন্য অবদান রাখা সংগঠনটিকে ধ্বংস করে দেশকে অনেকদূর পিছিয়ে দেবে।

আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এখানে বাস্তবতার যথাযথ বিশ্লেষণ না-করেই ড. ইউনূসের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশংসনীয় মডেল এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিকে ভুলভাবে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয় দুটিকে আলাদা করে না-দেখলে প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হবার  আশংকা থেকে যাবে।

দারিদ্র্য দূরীকরণের অন্যতম বাধা দুর্নীতি দূর করতে কমবেশি আমরা সবাই সোচ্চার। দুর্নীতি দূর করবার মূল প্রক্রিয়া হিসেবে রাষ্ট্রসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করবার বিষয়টি আমরা সবাই মিলে চিহ্নিত করেছি, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে ড. ইউনূসকেও সর্বদাই সম্মুখসারিতে সরব হিসেবে পেয়েছি আমরা। অথচ গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর সফল রূপকারকে নিয়ে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে ৭০০ কোটি টাকার অনিয়মের বিষয়টি উদঘাটিত হবার পর সরকার যখন গ্রামীণ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে, তখনই আমরা ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে এই যুক্তিতে সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি, যেটা সম্পূর্ণভাবে একটি স্ববিরোধী ও আত্ম-পরাজয়ী অবস্থান। তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পদ্মাসেতু প্রকল্প, দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ ব্যবহারের নীতি প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ের মতো গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে পদক্ষেপেও সরকারের বিচক্ষণতা ও পেশাদারিত্বের ঘাটতি রয়েছে। সরকারের এই সীমাবদ্ধতা এবং ব্যর্থতার সমালোচনা নিশ্চয়ই হওয়া উচিত এবং এর বিরুদ্ধে সরব হওয়া সকল নাগরিকের দায়িত্ব। সরকারের পদক্ষেপ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’-- অনেকের এই বক্তব্যের ভিত্তি আছে ধরে নিলেও বিশেষ মর্যাদা, ভাবমূর্তি আর আন্তর্জাতিক প্রভাবের দোহাই দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া যাবে না, এমন কথা বলা প্রকৃতপক্ষে জবাবদিহিতার বিষয়টিকে দুর্বল এবং উচ্চকোটি বা এলিট পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে। এই মনোভাব ‘আইনের চোখে সকলেরই সমান’-- গণতন্ত্রের এই ভিত্তিটাকে দুর্বল করে দেয়।

বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভূমিকার জন্য বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বারবারই যেমন সম্মান কুড়িয়েছে, তেমনি এর বিপরীতে ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দুর্নীতি ও ভাবমূর্তি ভূলণ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি সবক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পিস্তল ঠেকিয়ে কারো জিনিসপত্র কেড়ে নিলে তা হয় ছিনতাই, গরিব কেউ অগোচরে অন্যের ঘর থেকে টাকাপয়সা বা মালসম্পদ সরিয়ে নিলে তা হয় চুরি, ফাইল আটকিয়ে টাকাসহ অন্যান্য সুবিধা নিলে তা হয় ঘুষ, আর উচ্চপর্যায়ে থেকে সাগরচুরি (পুকুরচুরি)-র ঘটনাগুলোকে আমরা সচরাচর দুর্নীতি/কেলেংকারী হিসেবেই দেখি। তাদেরকে আমরা চোর বলি না। সমাজে ছোট চোরদের মতো তারা সংকুচিত ভাব নিয়ে চলেন না, বরং মিডিয়া থেকে শুরু করে সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সকলের সাথেই তাদের দাপটের সাথে চলাফেরা করতে দেখি।

ভাষা আন্দোলনসহ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণসহ সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে যেমন বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে, তেমনি ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা ও পরবর্তী সময়ে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনাটি তাদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ, মার্কিন সরকারসহ ন্যাটোভুক্ত দেশের সরকারগুলোর কাছে কখনই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা ঘটনা নয় বরং চিহ্নিত হয় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। আর ১৯৭৫ সালের আগস্ট হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে দেশকে সামরিক শাসন ও পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেবার ঘটনায় মার্কিন সরকার ও তার মিত্রদের ভূমিকা কারো অজানা নয়।

দেশের ভাবমূর্তি লিঙ্গনিরপেক্ষ বিষয়ও নয়। তসলিমা নাসরিনকে যখন দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়, সারা পৃথিবীতেই তখন নিন্দার ঝড় ওঠে, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিও ভূলুণ্ঠিত হয়; কিন্তু তখনো আমাদের দেশের হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কজন নারী-মানবাধিকার এবং আইনি অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায় নি। বাংলাদেশের উচ্চ মাতৃমৃত্যু হার, বাল্যবিবাহ, বাল্যমাতৃত্ব এখনো অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারা এখনো সংরক্ষিত। এগুলোও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করছে। কারণ বাংলাদেশের যে সকল অর্জন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশকে প্রশংসনীয় জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, যেমন জনসংখ্যার হার কমানো, কৃষিতে বিপ্লব, ক্ষুদ্রঋণ, গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানার প্রসার ও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তার প্রতিটিই মূলত নারীদের অদৃশ্য, বিনা ও অল্প বেতনের শ্রমের মধ্য দিয়ে অর্জিত। দুঃখজনকভাবে আমরা দেখি, বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় (রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে) যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা ‘আমরা দেশের জন্য বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আনি, কাজেই সরকারের কাছ থেকে আমাদের আর্থিকসহ অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্য’-- ব্যবসায়ী ও শিল্প-মালিকদের এই অবাস্তব দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছেন। অথচ এর বিপরীতে শ্রমিকনারী ন্যূনতম জীবনধারণ উপযোগী বেতনও পাচ্ছেন না। যদিও এই শ্রমিকনারীদের অতি সস্তা শ্রমের বিনিময়েই উল্লিখিত বৈদেশিক মুদ্রাগুলো আসছে। আমরা মার্কস-এর সারপ্লাস ভ্যালু সম্পর্কে জানি। তবে এটা বুঝতে মার্কস পড়ারও দরকার হয় না যে, বাংলাদেশে শ্রমিকনারীদের শ্রম অতি কম মূল্যে পাওয়া যায় বলেই অন্যদেশ থেকে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানা এখানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। মালিক বা এখানকার ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা কাঁচামাল দেখে তারা এখানে আসছে না।

আমরা জানি, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে ঢাকা শহর পৃথিবীর ১৪০টি শহরের মধ্যে বসবাসের উপযোগিতার দিক থেকে ১৪০তম, অর্থাৎ প্রায় বসবাসের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায়। এজন্য দায়ী কারা? সরকার, রাজনৈতিক দল, এনজিও, ব্যবসায়ী ও তাদের বিভিন্ন সংগঠন ও নগর পরিকল্পনাবিদগণসহ অনেকেই এবং ভূমিদস্যুরা তো অবশ্যই। কিন্তু এ বিষয়ে কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। কেবল ভাবমূর্তি হলে এত মাথাব্যথা হতো না, যদি রাষ্ট্র, তার নীতি ও এর বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখে না পড়ত, যা মানুষের জীবন-জীবিকাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের বর্তমান যে মডেল, তার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়ন আদৌ সম্ভব কি না সেটা দেখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। গ্রাম ও বস্তিবাসী নারীদের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের কাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক নারী অধিকার ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের মাধ্যমে এটা উপলব্ধি করা দুরূহ নয় যে, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ মডেল কোনোক্রমেই কার্যকরী কোনো মডেল নয়। দীর্ঘ ব্যাখ্যায় না-গিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়, বর্তমানে যে সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে তাকে চ্যালেঞ্জ না-করে বা তার কাঠামো, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন না-করে দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। গ্রামীণ মডেল স্ট্যাটাস ক্যু বজায় রেখেই ক্ষুদ্রঋণসহ অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনা করছে। সুতরাং এর দ্বারা নারী বা দরিদ্রের ক্ষমতায়ন কতটুকু সম্ভব তা সহজেই বোধগম্য।

এটা পরিষ্কার যে দরিদ্র নারীরা যখন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কোনো একটা জিনিস তৈরি করে, তখন সেখানে তারা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও শ্রম বিনিয়োগ করে থাকে। আমরা জানি তাদের কোনো শিক্ষা নেই, প্রশিক্ষণ নেই। স্বল্প পুঁজিতে তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎ সুবিধা ক্রয় করে পণ্যের মানোন্নয়ন করতে পারে না। সুতরাং তারা যখন তাদের পণ্য বাজারজাত করবার উদ্যোগ নেয়, তখন তাদের শ্রমের মূল্য বাদ দিয়েই তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়। কারণ তা করা না-হলে তারা বাজারে টিকে থাকতে পারে না। ক্ষুদ্রঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ উচ্চহারে (কম করে হলেও ২৫%) সুদ দিতে হয়, তাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে রেট অব রিটার্ন যা আসে, তা আদৌ লাভজনক হয় কি না, বিশেষজ্ঞদের সে হিসাব করে দেখা দরকার। এই হিসেবটা করা হলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, এ পদ্ধতিতে দারিদ্র্য দূরীকরণ আদৌ সম্ভব নয়।

তবে হ্যাঁ, গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানেরও কিছু কৃতিত্ব আছে, তবে সেটা দারিদ্র্য বিমোচনে নয়, বরং সারভাইভাল বা কোনোভাবে টিকে থাকতে সহায়তা করায়। মূলত কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের সাবজিস্টেন্স ইকোনমির যে মূল আধার : পতিত জমি, জঙ্গল, জলাভূমি থেকে দরিদ্র নারীগোষ্ঠী তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য, লাকড়ি, ঘরকন্নার কাজের জিনিসপত্র, পানি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পারত বিনামূল্যে কেবল তাদের শ্রম দিয়ে, তা খুব দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ছে জমি, জলাভূমি, জঙ্গল ইত্যাদির বাণিজ্যিক ব্যবহারের ফলে। এই অবস্থায় দরিদ্র নারীদের শ্রম ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ব্যবহার করে তারা টিকে থাকছে। এছাড়াও, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এই মিথকে ভেঙে দিতে পেরেছে যে, ‘দরিদ্র ও নারীরা ঋণপ্রাপ্তির উপযুক্ত বা ব্যাংকেবল নয়’। ক্ষুদ্রঋণ প্রথাগত দাদন ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদের ঋণচক্র থেকে নারী ও দরিদ্রদের মুক্ত হতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিওদের বিভিন্ন কর্মসূচি নারীদের কতগুলো সামাজিক দাসপ্রথার কবল থেকেও মুক্ত করেছে। উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৯৫-’৯৬ সালে যখন বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিওর তত্ত্বাবধানে গ্রামের দরিদ্র নারীদের লাগানো তুঁতগাছ কেটে ফেলা হলো, তখন বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সরেজমিনে ওখানে গিয়ে দেখেছি যে, জোতদার শ্রেণি ধান-পাটের মৌসুমে সস্তাশ্রমের জোগান দেবার জন্য মৌসুমী বিয়ে করত এবং মৌসুম শেষ হলে কিছু টাকাপয়সা ও কাপড়চোপড় দিয়ে অস্থায়ী বৌটিকে বিদায় করে দিত। এনজিওর মাধ্যমে তুঁতগাছ লাগানো ও আয়মূলক কাজে দরিদ্র নারীরা যুক্ত হওয়ায় মৌসুমী বিয়ে করা তখন তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এজন্যই ধর্মীয় কুসংস্কারের সুড়সুড়ি দিয়ে তখন তুঁতগাছ কাটা হয়েছিল। কিংবা উদাহরণ দেয়া যায় ১৯৯৮-এর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাটিরও। ওখানে তৃণমূল জনসংগঠনের জনসভায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মাধ্যমে যে আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল, তার নেপথ্যে কাজ করেছিল এনজিওসমূহের ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনার ফলে দাদন ব্যবসায়ে ভাটা পড়ার প্রভাব। দাদন ব্যবসায়ীরাই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে এই আক্রমণ পরিচালনায় ইন্ধন জুগিয়েছিল।

নারীর ক্ষমতায়নসংক্রান্ত আলোচনার সময় একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতা হিসেবে নারীদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নয়; বরং জামানতবিহীন ঋণ নিয়েও নারী ভেগে যেতে পারবে না-বলেই তাদের গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ আমাদের সমাজে নারীর অবাধ চলাচল ও অভিবাসনের সুযোগ খুব সীমিত। ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানে যে, দরিদ্র নারীদের ঋণ দিলে তা যে করেই হোক ফেরত আনা যাবে। নারীরা সাধারণত ঋণখেলাপি হয় না। আমাদের সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা এবং নানা সীমাবদ্ধতা ও বৈশিষ্ট্যই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম, তৈরি পোশাক, চিংড়ি ঘের-এর মতো খাতগুলোতে নারী অংশগ্রহণের প্রাধান্যের কারণ।

সিভিল সোসাইটি ও দেশ-বিদেশের অনেকেই যখন গ্রামীণ ব্যাংকের স্বচ্ছতার প্রশ্নে নেয়া সরকারি উদ্যোগের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন, তখন তাঁরা বলছেন যে, নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে বিরক্ত করা যাবে না। এখানে স্পষ্টভাবে দুটি জিনিস বলা দরকার যে সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে প্রথমেই ঢালাওভাবে ‘বিরক্ত করা’ হিসেবে অভিহিত করাটি নিরপেক্ষতাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি নয়; যেকোনো যুক্তিতে তা হবে ব্যাংকটির কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টাকে ব্যাহত করার নামান্তর। দ্বিতীয়ত, সরকারের ওপরও যুক্তিসংগতভাবে এই চাপ রাখতে হবে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ যেন কোনোভাবেই পেশাদারিত্বের মানকে ক্ষুণ্ন না-করে বা ব্যাংকটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করার পর্যায়ে পর্যবসিত না হয়। এ দুই প্রশ্নেই কোনো ছাড় দেবার উপায় নেই। অনেকের বক্তব্য ও তৎপরতা দেখে মনে হয়, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে যেন সরকারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ করে ভাবা হচ্ছে। যেন তিনিই কেবল দেশের ভালোমন্দ নিয়ে নিরন্তর ভাবনাচিন্তা করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে আমার মায়ের বলা একটা কথা মনে পড়ে। মা বলতেন, ‘রাজা চিন্তায় মরেন রাজ্য নিয়ে, আর যোগী চিন্তায় মরে তার ন্যাংটি নিয়ে’। ড. ইউনূস চিন্তা করবেন তাঁর সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল নিয়ে তাতে দোষের কিছু নেই। তবে ভুলে গেলে চলে না যে, ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান/দল বড়ো, প্রতিষ্ঠান/দলের চেয়ে দেশ বড়ো (এ উপদেশ অবশ্য আমরা রাজনীতিবিদদের সব সময়ই দিয়ে থাকি)। অনেকে বলছেন, পদ্মাসেতুর অর্থসাহায্য বন্ধে তাঁর ভূমিকা আছে, এ বিষয়ে আমি সন্দিহান। ৯ আগস্ট দেশের বাইরে থেকে ফিরে এসেই ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে ৬০ জন নারীনেত্রীর বিবৃতিতে আমারও স্বাক্ষরদানের কথা কয়েকজনের কাছে শুনতে পেয়ে বেশ বিস্মিত হয়েছি। আমি ভাবতে পারি না কারোর সঙ্গে যোগাযোগ না-করে, মত না-নিয়ে বিবৃতিতে নাম ব্যবহার করার নির্দেশ ড. ইউনূস দিয়ে থাকতে পারেন! অনেক সময় বাঁশের চেয়ে যেমন কঞ্চি দড় হয়, তেমনি এটা গ্রামীণ ব্যাংকেরই কেউ ড. ইউনূসের কাছে তার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য করেছেন বলে ধারণা করি। তবে এই ঘটনা এই আশঙ্কাকে কিছুটা ভিত্তি দেয় যে, তিনি দেশের জনগণের স্বার্থের বাইরে গ্রামীণ ব্যাংক ও নিজেকে নিয়েই বেশি চিন্তিত।

যাহোক, যাঁরা নারীর ক্ষমতায়ন বিঘ্নিত হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে সরকারের বিরুদ্ধে এবং গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁদের কাছে নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমার কয়েকটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়নে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও উত্তরাধিকারে সমঅধিকার বেশি জরুরি নাকি ক্ষুদ্রঋণ? এই প্রশ্নের কারণ, নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে যখন ধর্মীয় লেবাসধারী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে সহিংস পন্থায় রাস্তায়, মসজিদে, মাদ্রাসায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়, তখন নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বর্তমানে সরব অনেক ব্যক্তিকেই আমরা কোনো কথা বলতে শুনি নি। আরেকটি প্রশ্ন হলো, আমরা বলতে শুনি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হচ্ছে ৮০ লাখ দরিদ্র নারী! ব্যাপারটা কি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মালিক বাংলাদেশের জনগণ’-এর মতো? রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কতটা প্রতিফলন ঘটে না-ঘটে তা আমরা আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়েই দেখতে পাই। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় দরিদ্র নারীদের সিদ্ধান্তের মূল্য কতটুকু তা নিশ্চয়ই এ অভিজ্ঞতা থেকেই অনুমান করা যায়। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হয় যে, সার্বিকভাবে নারীদের প্রয়োজনের অগ্রাধিকার যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পানি, রান্নাঘরের জ্বালানি, চলাচলের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো আরো অনেক কিছু, সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গড়ে ওঠা প্রায় ৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং যেগুলোর মালিকানা নিয়ে রয়েছে নানা অস্বচ্ছতা, সেগুলোকে অগ্রাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত কি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা ও কথিত মালিক দরিদ্র নারীরা নিয়েছিলেন?

আসলে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে ক্ষুদ্রঋণকে বড়ো করে দেখানোটা একটা বড়ো ফাঁকি। জেন্ডারকে মূলধারাকরণের প্রশ্নে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা উঠলেই আন্তর্জাতিক অর্থ সরবরাহকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়, নারীদের জন্য বিরাট অংকের বরাদ্দ রয়েছে, যা দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ দেয়া হচ্ছে। এটা আমি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ‘গ্লোবাল কমিটি অব দা সিভিল সোসাইটি অন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক’-এর জেন্ডার ফোকাল পারসন হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্টসহ অন্যদের সঙ্গে কাজ করবার সময় মোকাবেলা করেছি। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের ওমেন অ্যাডভাইজরি প্যানেলের মেম্বার হিসেবে কাজ করবার সময়ও। বস্তুতপক্ষে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন যেমন হয় না, তেমনি তা জেন্ডার অসমতা দূরীকরণের কাজেও ব্যয় হয় না। ২০০০ সালের আগপর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দরিদ্র নারীদের উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে ঘূর্ণায়মাণ ঋণ তহবিলের সিড মানি হিসেবে অনুদান প্রদান করত। এই অর্থ উন্নয়ন সংস্থাগুলো ৫-৬ শতাংশের মতো অতি স্বল্প সার্ভিস চার্জে (বিনিয়োজিত অর্থ লেনদেনের ব্যয় ও টাকার মূল্যমান ধরে রাখার জন্য যতটুকু অতিরিক্ত আদায় করা দরকার) দরিদ্র ও নারীদের মধ্যে বিতরণ করত ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে। কিন্তু মূলত গ্রামীণ ব্যাংক মডেলের সাফল্যের দোহাই দিয়ে (যা মূলত গ্রামীণের উচ্চ সুদ ও ঋণ আদায় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করার একটি উসিলা ছিল), বিশ্বব্যাংকের চাপে সব দাতাসংস্থাই পরে এই তহবিল প্রদান বন্ধ করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে তহবিল বন্ধ করার প্রকৃত কারণ ছিল, সহনীয় সার্ভিস চার্জ সম্বলিত এ ধরনের অর্থ ছাড় করা হলে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো যেসব প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দূর করা। আমি মনে করি, গ্রামীণ ব্যাংকজাতীয় বড়ো ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর স্বার্থে এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সিড মানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটাই বরং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহারকে বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং উচ্চ মুনাফা ব্যতিরেকে দরিদ্র নারী-পুরুষদের আর্থিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে স্বাবলম্বী হবার নামে মুনাফামুখী ঋণদানকারী সংস্থায় রূপান্তরিত করেছে। এই প্রবণতাকে দেশব্যাপী বা আরো যথার্থভাবে বললে বিশ্বব্যাপী এক ক্ষতিকর রূপদানে এ মডেলটি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে প্রিয়ভাজন ‘মডেল’-এ পরিণত হয়েছে। এর উদাহরণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে লভ্য, যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে; যেমন লাইবেরিয়ান ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা এলএপিও, যারা ১০০ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয় এবং যেখানে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ইউএসএ (ড. ইউনূস যার বোর্ড মেম্বার), সিটি মাইক্রোফাইন্যান্স এবং স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক অর্থলগ্নি করছে।

কাজেই গ্রামীণ-এর ক্ষুদ্রঋণ মডেলকে দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের একমাত্র মহৌষধ হিসেবে দাঁড় করানোর নানা ঝুঁকি আছে। ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বব্যাংকের স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি (সেপ) অনুসরণ করে অনেক দেশেই দুর্যোগ নেমে এসেছে, যা আমরা জানি। এর বিপরীতে যেসব দেশ নিজস্ব নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, যেমন মালয়েশিয়া; তারা সার্থকভাবেই বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পেরেছে। তাই গ্রামীণ মডেলকে একমাত্র উপায় বিবেচনা করে দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গৃহীত বৈষম্য দূর করায় কার্যকর বিভিন্ন পদক্ষেপকে গৌন ভাববার ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। তা না হলে আমরা ভবিষ্যতে বড়ো ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। দেশকে নিয়ে, দেশের সমাজ-রাজনীতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন এমন অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকগণ যদি আমার এই আশঙ্কাটির বিষয়ে একটু আলোকপাত করেন, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে ধারণা করি। 

রোকেয়া কবীর মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী

Monday, 9 May 2011

আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়াশীলরা নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করছে : রোকেয়া কবীর


গত তিন দশক ধরে ক্রমাগতভাবে তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা ঘরের বাইরে এসে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেনতারা ইউনিয়ন পরিষদসহ তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন নেতৃত্বে বিভিন্নভাবে জায়গা করে নিচ্ছেনসাম্প্রতিক নির্বাচনসমূহে ভোটার হিসেবে নারীর ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির বিষয়টিও উল্লেখযোগ্যপ্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর এ সাফল্য বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নারী সংগঠন ও এনজিওসমূহের দীর্ঘদিনের আন্দোলেনরই ফসলএ সাফল্যের ফলে সরকারও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেশুধু তাই নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার চাপও সরকারকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে বাধ্য করছেএরই ফসল হিসেবে নবম জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে, মন্ত্রিসভায় ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী স্থান করে নিয়েছেনসংসদ সদস্য হিসেবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করেছেন, সুযোগ পেলে তাঁরাও দক্ষতা দেখাতে পারেনপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার সরকার গঠনের পর থেকেই নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে একের পর এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছেনএসব আমাদের মনে আশার সঞ্চার করছেকিন্তু এ আশার আলো ম্লান হয়ে যায়, যখন দেখি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী বর্বর সংহিসতার শিকার হচ্ছেসম্প্রতি নারীর ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় দোররা মারার বেশ কিছু খবরও এসেছে মিডিয়ায়ফতোয়াবাজদের হিংস্রতার শিকার হয়ে নারী যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সফল নারীরা দরিদ্র অসহায় এসব নারীর সহায়তায় কতটা এগিয়ে আসছেন। 

১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে নারীদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের আইন পাস হওয়ার পর বহু নারী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হননির্বাচিত হওয়ার পর সমাজের কাছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে দেয়া প্রতিশ্রতি পালন করতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁদের যথেষ্ট ক্ষমতা ও সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে নাতারপরও তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছেনএই সমস্ত উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠনও তাদের সহযোগিতা করেছেতৃণমূলের নারীর এ অগ্রগতিকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ভালোভাবে নিতে পারে নিকারণ এতে তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত লেগেছে২০০১-এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন পর্যায়ে ইতঃপূর্বে নির্বাচিত নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেনঅনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের বোরকা পরে নমনীয় হয়ে চলতে বাধ্য করা হয়েছেএমনকি ওই স্বার্থান্বেষী মহলের কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের নারী নেতৃত্বকে চরম অপমানও করেছেকিন্তু নির্যাতিত নারীরা এতে দমে যান নিতাঁরা সংগঠিত হয়ে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রত্যাখান করেছেন ২০০৮-এর নির্বাচনে

আশার কথা, ২০০৮-এ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেশবাসীও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নীতিনির্ধারণী পর্যায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সরব অংশগ্রহণের সুযোগ পুনরায় কিছুটা হলেও অবারিত হওয়ার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হওয়ার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছেএর ফলে সমাজে তাদের ক্ষমতা সংহত করার উদ্দেশ্যে এরা হিংস্র আচরণের মাধ্যমে নারীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নারীকে দোররা মেরে গলায় জুতার মালা পরিয়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেএ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ভূমিকা ন্যাক্কারজনকতারা এই ধরনের নারী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে প্রায়ই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাকেবল ওপর থেকে চাপ সৃষ্টি হলে কিছু করার চেষ্টা করে থাকে, যা প্রায়ই যথাযথ হয় না
লক্ষ করা গেছে, দরিদ্র নারীরাই প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থানেষী মহলের নির্যাতনের শিকার হয় বেশিএ বিবেচনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবেশিক্ষাই হতে পারে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির বড়ো হাতিয়ারএক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষা অধিক ফলপ্রসূ হতে পারেএছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু পরিবারের নারীরাও তুলনামূলকভাবে অধিক হারে নির্যাতনের শিকারযশোরে সম্প্রতি এক দলিত কিশোরীকে গণধর্ষণের ঘটনা এসবেরই ধারাবাহিক ফলকাজেই এই নির্যাতিতদের রক্ষায়ও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।       

অভিযুক্তরা যত প্রভাবশালীই হোক, তারা যেন পার পেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবেআইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না সে বিষয়ে মনিটরিংও জোরদার করতে হবেপ্রশাসনকে গতিশীল করতে হবেপ্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে কাজ হবে, নইলে নয়; এ সংস্কৃতির অবসান হওয়া আবশ্যকপ্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর না-হলে এরা একসময় বেপরোয়া হয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইবে

সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবেস্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরই নৈতিক দায়িত্বএটা মনে করার কোনো সুযোগ নেই যে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কেবল নারীরাই সোচ্চার হবেননারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এই মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় হওয়া সকলের নাগরিক দায়িত্বও বটেকারণ মানবাধিকার ক্রমাগত লঙ্ঘিত হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না