Thursday 13 October 2011

গ্রামীণ নারীদের জীবনমান উন্নয়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দরকার : রোকেয়া কবীর

শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গ্রামীণ নারীরা যেসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস সেদিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে২০০৭-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের একটি সাধারণ অধিবেশনে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতি, খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি সাধন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আদিবাসীসহ গ্রামীণ নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়যদিও ১৯৯৫ সালেই বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত নারীবিষয়ক চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে খাদ্য উপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় গ্রামীণ নারীদের অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে এরকম একটি দিবস পালনের প্রস্তাব আনা হয়২০০৮-এর ১৫ অক্টোবর নিউইয়র্কে দিবসটি প্রথমবারের মতো উদযাপিত হয়তার পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজ দিবসটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে উদযাপন করে আসছে

বলাবাহুল্য যে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমুদয় খাদ্যই উপাদিত হয় গ্রামাঞ্চলেএই উপাদনপ্রক্রিয়ায় গ্রামীণ নারীসমাজ যে বিপুল পরিমাণ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শ্রমে অংশ নিয়ে থাকে, আমাদের দেশে তার কার্যকর স্বীকৃতি এখনো অনুপস্থিতআমরা জানি, গ্রামীণ কি শহুরে, শিক্ষিত কি নিরক্ষর, পেশাজীবী কি গার্হস্থ্যকর্মী সকল পর্যায়ের নারীদেরই কমবেশি পুনরুপাদনমূলক কাজে সময় ব্যয় করতে হয়, যে কাজ সর্বাংশে মজুরিহীনআর মজুরিহীন বলে এ কাজ সাধারণত কাজ বলেই স্বীকৃত হয় নাসমাজ কাজ বলে স্বীকৃতি দেয় কেবল উপাদনমূলক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে অর্থ উপার্জন করাকেখুব বেশি দিনের ঐতিহ্য না-থাকলেও বর্তমান বাংলাদেশের শহর পর্যায়ে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত নারী অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও কল-কারখানায় কাজ করে নগদ অর্থ উপার্জন করছেনকিন্তু গ্রামাঞ্চলের নারীরা পুনরুপাদনমূলক কাজে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নেয়ার পাশাপাশি উপাদনমূলক কাজ, বিশেষ করে কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অংশ নিলেও তারা এ কাজে কোনো অর্থ পান নাঅবশ্য দিনমজুর হিসেবে যেসব নারী অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করেন, তারা পুরুষ শ্রমিকের চাইতে কম হলেও কিছু মজুরি পেয়ে থাকেন

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব মতে, কৃষিকাজে বাংলাদেশের একজন পুরুষ যেখানে শ্রম দেন বছরে ১৮শ ঘণ্টা, একজন নারী সেখানে দেন ২৬শ ঘণ্টাঅর্থা কৃষক পরিবারের একজন নারী কৃষিকাজে দৈনিক সাত ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করে থাকেনএ হিসেব অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, বিশেষত যারা কৃষিকাজ বলতে কেবল মাঠের কাজকেই বুঝে থাকেনবাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে, বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় নারীরা মাঠের কাজে অধিক পরিমাণে অংশ নিলেও সারাদেশের বাস্তবতা একইরকম নয়কোনো কোনো এলাকায় মাঠের কাজে নারী উপস্থিতি কম দেখা যায়কিন্তু এর মানে এ নয় যে ওই এলাকার নারীরাও কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অংশ নেন নাবস্তুতপক্ষে কৃষিকাজের আওতা অনেক ব্যাপ্তবীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, পুকুরে মাছ চাষ, বাড়িতে হাঁসমুরগি ও গবাদি পশুপালন, খোঁয়াড় ও গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, নানারকম কৃষি সরঞ্জাম তৈরি, আঙিনা ও বাড়ির পাশে শাকসবজি চাষ ও নিয়মিত সেচকাজ, বাড়ির আশেপাশে ফুল, ফল ও ভেষজ গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, ইত্যাদি কাজও কৃষিকাজেরই আওতাভুক্ত; যার সিংহভাগই সম্পাদন করেন গ্রামীণ নারীরাকাজেই ফসলের মাঠে নারীদের শারীরিক উপস্থিতি পুরুষের তুলনায় কম দৃষ্ট হলেও কৃষিকাজের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যানুযায়ী এক্ষেত্রে নারীরাই যে অংশগ্রহণ ও শ্রমদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেইএক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষিকাজের ১৩টি ধাপের মধ্যে নারীরা ৯টি ধাপের কাজে সরাসরি সম্পন্ন করে থাকেন

পুনরুপাদনমূলক কাজে নারী যেমন মজুরিবিহীন শ্রম দিয়ে থাকেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রে নারীর শ্রমটাকেও মজুরিবিহীন শ্রম বলেই ধরে নেয়া হয়নিজের পরিবারের জন্য কাজ করে তার বিপরীতে নগদ পারিশ্রমিক নেয়া বা নেয়ার প্রস্তাব ওঠানোটা আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো গ্রহণযোগ্য নয়কিন্তু পরিবারের উপার্জনে তার অংশগ্রহণের স্বীকৃতিটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকারতাছাড়া কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবারের যে মোটমাট উপার্জন, যে উপার্জনের পেছনে নারীর শ্রম পুরুষের চেয়ে বেশি, সে উপার্জন পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে ব্যয়িত হবার সংস্কৃতিটাও চালু হওয়া জরুরিদুঃখজনক যে, সে সংস্কৃতি আমাদের দেশে ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত

দেখা যায়, যে কাজে অর্থ নেই, অর্থাগমের সম্ভাবনা নেই, সে কাজগুলোর ক্ষেত্রে সমাজ সহজেই নারীনেতৃত্ব মেনে নেয়কিন্তু যখনই কাজটা নগদ অর্থের সম্ভাবনা দেখায় বা অর্থাগম হতে শুরু করে, তখনই সেটার নেতৃত্ব চলে যায় পুরুষের হাতে, তা সে যে কর্মই হোকএক্ষেত্রেও তাই ঘটেকৃষি উপাদনপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই ঘনিষ্ঠ হলেও যখন কৃষিপণ্য বিক্রির প্রসঙ্গ আসে, তখন তা পরিবারের পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেনঅর্থা কৃষিপণ্যের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ পরিবারকর্তা পুরুষের হাতে চলে যায়এটাই পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির নিয়মআর এ নিয়মে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তারাই একক সিদ্ধান্তে সেই অর্থ খরচের পরিকল্পনা করেন ও খরচ করেনমুশকিল হলো, একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে এ পরিকল্পনায় পরিবারের নারীসদস্যদের প্রয়োজন ও চাহিদা সমান গুরুত্ব পাবার কথা থাকলেও, কার্যত কোনোই গুরুত্ব পায় না

গ্রামীণ নারীর সাধারণ ও প্রজননস্বাস্থ্যজনিত জটিলতা, পুষ্টিহীনতা, বিনোদনহীনতা, পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পানি ও জ্বালানির অপ্রতুলতা, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধার অনুপস্থিতি ইত্যাদি প্রয়োজনকে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনই মনে করা হয় নানানা অপ্রাপ্তি ও সমস্যা-সীমাবদ্ধতার মধ্যে হাবুডুবু খেয়েও তাদের একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে যেতে হয়, যেখানে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, শারীরিক সুস্থতা-অসুস্থতাকে মোটেই পাত্তা দেয়া হয় নাতাছাড়া গর্ভে সন্তান ধারণ ও সন্তান জন্মদান করেই তাদের দায় ফুরায় নানবজাত শিশুর লালনপালনের পুরো ভারও তাদের কাঁধেই বর্তায়এ এক ভয়াবহ অবিচার, যার শিকার হয়ে চলেছে আমাদের কোটি কোটি সর্বংসহা গ্রামীণ নারীগোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আছে নানারকম পারিবারিক-সামাজিক হয়রানি ও নির্যাতনের ধকলগ্রামীণ নারীরা শহরের নারীদের তুলনায় অনেক রেশি নির্যাতনের শিকার হনযৌন হয়রানি, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ফতোয়া, পাচার ইত্যাদি নির্যাতনের একটা বেড়াজালের মধ্যে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করতে তারা বাধ্য হনপ্রায়ই এসব সমস্যার প্রতিকার পান না দরিদ্র গ্রামীণ নারীরা

সহজেই বোধগম্য যে, গ্রামীণ কৃষিপরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েশিশুদের অবস্থাও হয় অতিশয় করুণসাধারণত এদের স্কুলে পাঠাতেই চাওয়া হয় নাপাঠালেও প্রাথমিক পর্যায়ের পর তাদের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো খুব একটা উসাহ দেখায় নাএখনো পরিবারগুলোর এই নিরুসাহের পেছনে কাজ করে প্রধানত মেয়েদের অত শিক্ষার দরকার নেইধরনের রক্ষণশীল ও পশ্চাপদ ধারণাযৌন হয়রানির শিকার হওয়া বা শিকারের আশঙ্কা, কাছাকাছি বিদ্যালয় না-থাকা, যাতায়াত সমস্যা ইত্যাদিও এক্ষেত্রে কমবেশি ভূমিকা রাখেসব মিলিয়ে পরিবারগুলো চায়, মেয়েরা অনর্থক স্কুলে না-গিয়ে বাড়িতে থেকে পরিবারের নৈমিত্তিক কাজে হাত লাগাক ও বিয়ের পাত্রী হিসেবে শারীরিক-মানসিকভাবে তৈরি হোকএর পর দেখতে-না-দেখতে তাদের শৈশব-কৈশোর ছিনতাই হয়ে যায় বিয়ে নামক প্রায়-অনিবার্য সনাতনী বাস্তবতার হাতে

ইউএনডিপির ২০০৯ সালের এমডিজি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঝরে পড়া কিশোরীদের ৪১ ভাগকে স্কুল ত্যাগ করতে হয় বাল্যবিবাহের কারণেস্বামীর বাড়ি গিয়ে এই কিশোরীদের অবিশ্রান্তভাবে নতুন সংসারের ঘাঁনি টানার দায়িত্ব নিতে হয়এদের একাংশ নিজে শিশু অবস্থায়ই আরেক শিশুর মা হয় বা মা হতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েসন্তান ও সংসারের ভারে কাবু হতে হতে যারা বেঁচে যায়, তাদের জীবনেও আর কোনো রং থাকে না, সুযোগ থাকে না জীবনের ভালোমন্দ নিয়ে ভাববারওএ যেন এক বিশাল চক্রের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া, যেখানে নিজে নিজে থামবার আর কোনো সুযোগ নেইবিয়ের আগে যে কিশোরী তার মায়ের সারাদিনের মাত্রাতিরিক্ত কর্মভার কমাতে মাকে কিছু সহায়তা দিত, নতুন সংসারে এসে তার কাঁধেও চেপে বসে মায়ের সমান কর্মভার, যদিও তার পাশে কেউ থাকে না তাকে সহায়তা দেবার জন্য

আমরা জানি, একাংশ গ্রামীণ নারী, যাদের নিজেদের চাষ জমি নেই, দারিদ্র্যপীড়িত ও অনিরাপদ গ্রামীণ জীবনের নিগড় থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি স্বাধীন ও স্বপ্নময় জীবনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পদার্পণ করেছেন ও করছেনগ্রামীণ নারীদের এই অংশই বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত গার্মেন্টসের প্রধান শ্রমশক্তিগবেষণাতথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই নারী, যাদের সিংহভাগই গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিতগার্মেন্টস মালিকরা কারখানার শ্রমিক হিসেবে এসব অল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর ও অদক্ষ গ্রামীণ নারীদের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখান, কারণ এদের শ্রম খুব কম মজুরির বিনিময়ে কেনা যায়এখানেও যে তারা খুব ভালো থাকেন, তা বলা যায় নামজুরি ও বোনাসসহ অন্যান্য সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে নারীশ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হনতাদের কাজ করতে হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেতার ওপরে রয়েছে জীবন ও শরীরের নিরাপত্তাহীনতাএত কিছুর পরও এরা নিজেরা কষ্টে থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে নিয়মিত গ্রামে বসবাস তাদের স্বজনদের কাছে পাঠানএই টাকা তাদের পরিবারে যেমন বিশেষ আনন্দের সঞ্চার ঘটায়, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও রাখে কমবেশি ইতিবাচক প্রভাব

অনিশ্চিত জীবন থেকে উদ্ধার পেতে ও একটি ভালো জীবনের আশায় শহরে এসে একাংশ গ্রামীণ নারী প্রতারণারও শিকার হনবিদেশে কাজে পাঠাবার নামে কার্যত তাদের যৌনকর্মী হিসেবে পাচার করে দেয়া হয়প্রতিনিয়ত এরকম খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলেও পাচারের ঘটনা এখনো বন্ধ হয় নিকষ্টেসৃষ্টে যোগাড় করা টাকার বিনিময়ে কিছু মেয়ে বিদেশে কাজে যাবার সুযোগ পেলেও, ভাষা ও কাজ বিষয়ে প্রশিক্ষণ না-থাকায় তারা ভালো কাজ যেমন যোগাড় করতে পারেন না, তেমনি তাদের নানা সমস্যায়ও পড়তে হয়    

গ্রামের নিস্তরঙ্গ অর্থনীতির পরিসর ছেড়ে গ্রামীণ নারীদের শহরে কাজের আশায় অভিবাসনের প্রবণতা এখনো চলমানমাসে মাসে নগদ অর্থ হাতে পাবার মতো অভিজ্ঞতা সিংহভাগ গ্রামীণ নারীর জীবনে কখনোই ঘটে নাশহরে এলে সেটা ঘটতে পারে এই সম্ভাবনাটি গ্রামীণ কিশোরী-যুবতী ও তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে শহরে অভিবাসনেঅথচ গ্রামাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা গেলে শহরমুখী না-হয়েও গ্রামীণ নারীরা বর্তমান অবস্থার চাইতে অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের নিশ্চয়তা পেতে পারেন
বলা যায়, গ্রামীণ নারীদের বিদ্যমান অবস্থাটা প্রত্যাশিত নয়, কাজেই এতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যকরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কঠোর পরিশ্রমী ও উপাদনসক্ষম গ্রামীণ নারীদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারলেই কেবল আমরা বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবসের চেতনার প্রতি সম্মান দেখাতে পারবসেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার সুযোগ আছেএখানে প্রাসঙ্গিক কিছু সুপারিশ যুক্ত হলো, যেসব সুপারিশ উদ্যোগে রূপান্তরিত হলে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায় :
  1. কৃষিকাজের সনাতনী যে পদ্ধতি, তাতে পরিবর্তন আনার জন্য কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তিতে উসাহিত করা ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা দেয়া দরকারএতে করে কৃষি উপাদনের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নারী-পুরুষের শারীরিক পরিশ্রমও অনেকখানি লাঘব হবে
  2. গ্রামাঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে উন্নত জীবনের আশায় নারী-পুরুষের বর্তমান শহরমুখী স্রোতটিকে নিরুসাহিত করা যায়উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক সনাতনী হাঁসমুরগি পালন ও শবজিচাষের মতো প্রকল্পের বাইরে বেরোতে হবে, স্থাপন করতে হবে কারিগরিভিত্তিক আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্পন্ন নিরাপদ কর্মক্ষেত্র
  3. কম সন্তান নেবার ব্যাপারে প্রচারণায় বর্তমানে যে ভাটা পড়েছে, তাতে নতুন করে জোয়ার আনতে হবেগ্রামীণ নারী-পুরুষকে বোঝাতে হবে যে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরে কম সদস্যের পরিবারের সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব আছেএ ধরনের প্রচারণার পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী গ্রামীণ নারী-পুরুষের জন্য সহজলভ্য ও সুলভ করতে হবে
  4. পুনরুপাদনমূলক কাজ পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে ভাগাভাগি করে করবার সামাজিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবেঅত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ প্রচারণা চালাতে হবে যে, পারিবারিক ও সামাজিক কাজ কেবল নারীর নয়, নারী-পুরুষ সকলের
  5. গ্রামীণ মেয়েশিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমানো ও বাল্যবিবাহ রোধে বিদ্যমান উদ্যোগকে আরো জোরদার ও কার্যকর করতে হবে 
  6. পুকুর ও নদীর পানি দূষণ রোধ করতে হবে ও নিরাপদ পানীয়জলের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পরিবারের খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের দুর্ভোগ পোহাতে না-হয়
  7. একদিকে বনজঙ্গল ধ্বংস করা, অন্যদিকে পরিবারের দৈনন্দিন জ্বালানি ও শাকপাতা সংগ্রহের দায় কেবল নারীদের ওপর চাপিয়ে রাখার যে সংস্কৃতি সেটা বদলাবার উদ্যোগ নিতে হবেএছাড়া গ্রামাঞ্চলে ভরতুকি দিয়ে হলেও সস্তায় গ্যাস পাবার বন্দোবস্ত করতে হবে
  8. ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত পারিবারিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোকে সার্বক্ষণিক চিকিসক, প্রয়োজনীয় চিকিসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রসহ সক্রিয় করতে হবে এবং ক্লিনিকগুলোতে ঝামেলামুক্তভাবে দরিদ্র নারীদের চিকিসা নেবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবেযেখানে এ ধরনের ক্লিনিক নেই, সেখানে তা স্থাপন করবার ব্যবস্থা করতে হবে      
  9. যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনকে কঠোরহস্তে দমন করবার ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের আওতায়ই কার্যকর ও সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবেনারী ও মেয়েশিশু পাচার রোধে বহুপাক্ষিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে 
  10. গ্রামীণ নারীদের মধ্যে যারা দেশের অভ্যন্তরে শহরে ও বিদেশে কাজ করতে যেতে আগ্রহী, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে তারা অজ্ঞতার কারণে প্রতারণার শিকার না-হন এবং ভালো মানের নিরাপদ কাজে যুক্ত হতে পারেনএক্ষেত্রে মেয়েদের শরীর ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানেও যত্নবান হতে হবে

আমরা দেখেছি, অপর্যাপ্ত হলেও উল্লিখিত কোনো কোনো খাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নানা সময়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তার কার্যকর বাস্তবায়ন, নিবিড় মনিটরিং ও ফলোআপের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা এবং সুনির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না-থাকায় প্রত্যাশিত সুফল আসে নিবিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস ২০১১ উদযাপনের প্রাক্কালে আমরা আশা করি, আগামী বার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মোট খাদ্য উপাদনে বিনিয়োজিত অর্ধেক শ্রম প্রদানকারী গ্রামীণ নারীদের অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বিশেষভাবে উদোগী হবে

2 comments:

  1. ১৫ অক্টোবর গ্রামীণ নারী দিবসের দিনে লেখাটি দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়েছে।
    http://www.sangbad.com.bd/?view=details&archiev=yes&arch_date=15-10-2011&type=gold&data=Games&pub_no=863&menu_id=20&news_type_id=1&val=80964

    এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪ডটকমে
    http://banglareport24.com/2011/10/15/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%A3-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8/

    ReplyDelete
  2. This Ramadan has come to us Ramadan Speacial. Here you will find everything necessary for Ramadan.
    Ramadan Speacial
    Islamic Life
    Home Page

    ReplyDelete

লেখাটি সম্পর্কে আপনার মত জানান (যদি থাকে)